ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো?

উপনিবেশিক ভারতের সেনাবাহিনীর বিকাশ

বিডিসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে বাণিজ্য করতে এসে পলাশীর যুদ্ধে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ও বক্সারের যুদ্ধের ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে জয় লাভের মাধ্যমে বাংলার রাজশক্তি দখল করে। পরবর্তী এক শতাব্দীর মধ্যে ভারতের সুবিস্তিত অঞ্চলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা, প্রসার ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। ডেভিড ওমিসি লিখেছেন যে, ‘ভারতের ব্রিটিশ রাত ছিল একটি সেনা সুরক্ষিত দুর্গের মত।’ ভারতের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হলো –

১. সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠা

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আগেই সেনাবাহিনীর গঠনের তৎপর হয়। দক্ষিণ ভারতের ইঙ্গ ফরাসি দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন স্ট্রিঞ্জার লরেন্স ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয়দের নিয়ে একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বৃটেনের বাড়তি রাজকীয় নৌবাহিনী এ দেশে নিয়ে আসেন। পলাশীর যুদ্ধে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভ ও ব্রিটেন থেকে নৌবাহিনী ভারতে এনে সেনাদলের শক্তি বৃদ্ধি করেন।

২. ইউরোপীয়দের প্রাধান্য

কর্নওয়ালিসের সময় থেকে সেনাবাহিনীর উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগ বন্ধ ছিল। সেনাবাহিনীর উৎসব পদগুলিতে সর্বদা ইউরোপীয় অফিসাররা নিযুক্ত হতেন। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের সেনা বিভাগের তিন হাজার টাকার বেশি বেতন পেত, এমন ভারতীয় সেনা সংখ্যা ছিল মাত্র তিনজন। কোম্পানি ডিরেক্টর অফ পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে অধিকাংশ ইউরোপীয় অফিসার কে নিয়োগ করতেন।

৩. নিয়োগের পছন্দ

ভারত ব্রিটিশ কোম্পানি সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেনাদল সৈন্য সংখ্যা ও বাড়াতে থাকে। পলে সেনা বাহিনীর বিভিন্ন স্তরে ভারতীয়রা নিযুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। সেনাবাহিনী নিয়োগে উচ্চবর্ণিয়রি বিশেষ প্রাধান্য পেত। অযোধ্যার উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণ ও ধনী রাজপুত্র কৃষক, বিহারে ভূমিহার ব্রাহ্মণ ও রাজপুত্রদের বিহারে ভূমিহার ব্রাহ্মণ ও রাজপুত্রদের অধিক সংখ্যায় নিয়োগ করা হতো। পরবর্তীকালে বাংলার পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে কোম্পানির আধিপত্যের প্রসার ঘটলে কিছু পাহাড়ি উপজাতি মানুষকে নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে বাহিনীতে নেপালের গোর্খাদের নিয়োগ শুরু হয়।। এরা শীঘ্রই সেনাবাহিনীতে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠে।

৪. সেনাবাহিনীর আয়তন বৃদ্ধি

ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্য প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর আয়তন বাড়তে থাকে। ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতে কোম্পানি সিপাহীদের সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার। এই সংখ্যা বেড়ে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে ১ লক্ষ ৫৮ হাজার এবং ১৮৫ খ্রিস্টাব্দে ২ লক্ষ ১৪ হাজার হয়। উনিশ শতকের শুরুতে আইন করে ভারত কুড়ি হাজার রাজকীয় সেনা মোতায়েন করা হয়। সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আদায় করা রাজস্বরে অন্তত ৪০ শতাংশ সেনাবাহিনীর পেছনে ব্যয় হতো।

৫. জাতপাতের বিষয়

সেনাবাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতীয় জাত পাতের নিয়ম কানুন গুলিকে গুরুত্ব দেওয়া হত। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের অংশগ্রহণকারী সিপাহী জাতিগুলিকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ইংরেজদের অনুগত উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পাঠান, পাঞ্জাবের জাঠ, উত্তর ভারতের রাজপুত, নেপালের গোর্খা প্রভৃতি জাতি গুলিকে যুদ্ধ-প্রযোগী জাতি হিসেবে চিহ্নিত করে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে আগ্রাধিকার দেয়া হয়। পিল কমিশনের ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে সুপারিশ অনুসারে বিভিন্ন জাতির মানুষের সমন্বয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী গঠন করা হয়।

৬. বেতন ও ভাতা

কোম্পানির সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত ভারতীয় সেনারা নিয়মিত বেতন, অবসরকালীন ভাতা, অন্যান্য ভাতা, পূর্ণবাসন ও অন্যান্য কিছু সুবিধা পেত। এজন্য ব্রিটিশদের সহায়তা নিজেদের জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পেয়ে তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য রক্ষার গুরু দায়িত্ব আন্তরিকভাবে পালন করতো। তবে ১৮২০ দশকে সেনাদের বিভিন্ন আর্থিক ও সামাজিক সুবিধা কমানো হলে তারা বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়।

উপসংহার

ঐতিহাসিক ডক্টর বিপান চন্দ্র তার গ্রন্থের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে ভারতের ব্রিটিশ রাজত্বের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ বলে উল্লেখ করেছেন। প্যার্সিভ্যাল স্পিয়ার লিখেছেন, “সিভিল সার্ভিস গভর্নরের দক্ষিণ অস্ত্র হলে সেনাবাহিনী ছিল তার বাম হস্ত।” ১. সেনাবাহিনীর শক্তির দ্বারা ভারতে কোম্পানির একছত্র রাজনৈতিক একাধিকপত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। ২. সেনাবাহিনী ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ধারাবাহিক সম্প্রসারণ এর সহায়তা করে। পলি সেনাবাহিনীর সহায়তায় ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ, অর্থাৎ মাত্র ১০০ বছরের মধ্যে ইংরেজ কোম্পানির ভারত জল সম্পূর্ণ করে। ৩. ভারতীয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্ভাব্য বিপদ বা সমস্যা থেকে কোম্পানি সাম্রাজকে রক্ষা করত সেনাবাহিনী। ৪. সেনারা সরকার বিরোধী কৃষক বিদ্রোহ, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, শ্রমিক ধর্মঘট প্রভৃতি নির্মমভাবে দমন করতো। ৫. বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিবাদে সেনাবাহিনীর বিশেষ গুরুত্ব ছিল।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment