“আমাদের রাজার বিজয়রথ তার উপর দিয়ে চলবে” -প্রসঙ্গটির ব্যাখ্যা দাও
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘গুরু’ নাটক থেকে সংগৃহীত এই উক্তিটি করেছে দাদাঠাকুর। আলােচ্য নাটকে দেখা যায়, দাদাঠাকুরের শিষ্য দ্বিতীয় যূনক খবর দেয়, তাদের দলের চণ্ডককে হত্যা করে ফেলেছে স্থবিরপত্তনের রাজা মন্থরগুপ্ত। চতুর্থ যূনক জানায়, শূনকদের মধ্য থেকে দশজনকে স্থবিরক সম্প্রদায়ের লােকেরা ধরে নিয়ে গেছে সম্ভবত কালঝন্টি দেবীর কাছে বলি দেওয়ার জন্য। তৃতীয় যূনক খবর দেয়, অচলায়তনের প্রাচীর আরও পঁয়তাল্লিশ হাত উঁচু করা হচ্ছে যূনকদের স্পর্শ থেকে অচলায়তনের বিশুদ্ধতাকে রক্ষা করার জন্য। বজ্রবিদারণ, কেয়ুরী, মহাশীতবতী, উয়ীঘবিজয়, অমিতায়ুর্ধারিণী ইত্যাদি নানাপ্রকার মন্ত্র বা বিশ-পঁচিশ হাজার রকমের প্রায়শ্চিত্ত বিধানে কু-সংস্কারের আঁতুরঘর হয়ে ওঠা অচলায়তনে সেখানকার রাজা যেভাবে নিম্নশ্রেণির যূনকদের হত্যা বা শাস্তির খেলায় মেতে উঠেছেন—তা দাদাঠাকুর সহ্য করতে পারছিলেন না। দাদাঠাকুরের মতে, পাপ এবং স্পর্ধা যখন আকাশস্পর্শী হয়ে আকাশের আলােকে ম্লান করে দেয়, তখন তাকে ধুলােয় মিশিয়ে দেওয়াই আশু কর্তব্য। তাই তিনি যুবকদের আহ্বান জানান, অচলায়তনের প্রাচীর ভেঙে দিয়ে তার ওপর দিয়ে রাজপথ তৈরি করে দিতে। আর এভাবেই অচলায়তনের সংস্কার, নিরর্থক শাস্ত্রবিধান, শুচিবায়ুগ্রস্ততার অবসান ঘটবে বলে দাদাঠাকুরের বিশ্বাস। আর এটাই মানবতাকে রক্ষা করতে চাওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা বা ভগবানের ইচ্ছা বলে দাদাঠাকুরের মত।
যূনকরা চাষ করে কেন? তাদের গানে এই চাষের আনন্দ কীভাবে ফুটে উঠেছে?
প্রকৃতি আমাদের অনেক কিছু উপহার দিয়েছে। কিন্তু সেগুলিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে জীবনযাপনের প্রণালীকে উন্নত করে তােলা মানুষের কাজ। গুরু’ নাটকে বর্ণিত যূনক নামক জাতিকে নিম্নশ্রেণি বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। কারণ তারা নাচগান করে সারাদিন খেটে চাষ করে, পুথিগত শিক্ষাগ্রহণ। করে সভ্যভদ্র হয় না। এদের তথাকথিত পাণ্ডিত্য নেই, ভদ্র আচার ব্যবহার শেখেনি, এরা চাষ করে ফসল ফলায় যা গ্রহণ করে মনুষ্যজাতি জীবনধারণ করছে। মাটিকে এরা খুব ভালােবাসে, তাই মাটিতে বুক দিয়ে ফসল ফলিয়ে মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এরা সকলের সমাজবন্ধু। সমাজের সেবা করাই এদের কাজ। এই কাজে এরা আনন্দিত ও বলীয়ান।
কাজই এদের গর্ব। এই গর্ব প্রকাশ পায় তাদের গানে। গান গেয়ে কষ্টকে লাঘব করে আনন্দে মেতে উঠে এরা চাষ করে—
“আমরা চাষ করি আনন্দে
মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে”।
গানের মধ্য দিয়ে এরা বাস্তবিক দুঃখ-যন্ত্রণাকে ভুলে থাকে, কঠোর পরিশ্রম করতে পারে। গানের মধ্য দিয়ে তাই এরা নতুন করে জীবন ফিরে পায় এবং সকলকে এই গানে ও নাচে মাতিয়ে তােলে। এদের কোনাে কাজে কোনাে লজ্জা নেই, ভয় নেই, দুঃখ নেই। তাই বলে ওঠে- “মোরা সব কাজেতে হাত লাগাই সব কাজে।”
“ভাই তােরা সব কাজই করতে পাস” -কে, কাকে, কেন এ প্রশ্ন করেছে?
গুরু নাটকে শূনকজাতির সহজ কর্মমুখর আনন্দময় জীবনযাপন দেখে পঞ্চক বিস্মিত হয়। আশ্রমের সংস্কারের বন্ধনে আবদ্ধ একঘেয়ে জীবন তার পছন্দের নয়। তাই সে বারবার সকল বাধানিষেধ অগ্রাহ্য করে যূনকদের সঙ্গে মিশতে চলে যায় বাইরে। আয়তনের বাইরের নিম্নশ্রেণির যূনকরা আপনমনে গান গেয়ে আনন্দের সঙ্গে চাষ করে জীবন অতিবাহিত করে। এদের এই মুক্ত উদার জীবনপ্রণালী দেখে পঞ্চক উপরােক্ত প্রশ্নটি করেছে। যুনকদের পথপ্রদর্শক দাদাঠাকুরের এসব কাজে কোনাে আপত্তি নেই শুনে পঞ্চক আরও বিস্মিত হয়। কারণ তাদের আশ্রমে প্রতিপদে কোনাে না-কোনাে নিয়ম বা বাধা আছে, যা না মানলে তাদের কঠোর প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে দাদাঠাকুর শূনকদের পথ চলতে সাহায্য করলেও তাদের চলার আনন্দকে বাঁধনে বেঁধে রাখেননি। তাই তারা আনন্দে নিজেদের মতাে করে প্রকৃতির সঙ্গে মিশতে পারে। মনের আনন্দে তারা চাষ করে, কাঁকুড় বা খেসারি ডালের চাষ করতে তাই তাদের মনে কোনাে বাধা নেই। লােহা পেটানাের ব্যাপারে তাদের কোনাে ছুৎমার্গ নেই। বজ্রবিদারণ, কেয়ূরী, মরীচী, মহাশীতবতী বা উন্নীযবিজয় মন্ত্র না জানার জন্য যূনকদের মধ্যে কোনাে আফশােস লক্ষ করা যায় না। যুনকদের এই নির্বাধ, স্বাধীন, কর্মমুখর জীবনই পঞ্চককে বিস্মিত করে তােলে।
“ঐ আমাদের দুর্লক্ষণ”—কার সম্পর্কে কেন এমন কথা বলা হয়েছে?
প্রশ্নোধৃত উক্তিটি ‘গুরু’ নাটকে বর্ণিত অচলায়তন নামক আশ্রমের উপাচার্যের। আশ্রমের নিয়মভঙ্গকারী পঞ্চক সম্পর্কে তিনি এ কথা বলেছেন। মহাপঞ্চকের ভাই পঞ্চক সকলের থেকে একেবারেই আলাদা। শুরু থেকেই আশ্রমের কোনাে নিয়মনীতির ওপর তার বিশ্বাস নেই। সব নিয়ম ভঙ্গ করাতেই তার আনন্দ। তাই সকলরকম প্রায়শ্চিত্ত তার কাজে লেগেছে। বালক মনের স্বাভাবিক কৌতুহলবশেই সুভদ্র উত্তর দিকের জানলা খুলেছে বলে সুভদ্রকে প্রায়শ্চিত্তের হাত থেকে রক্ষা করতে চেয়েছে তার সহমর্মী পঞ্চক। আশ্রমের কঠিন বেড়াজাল, কঠোর নিয়ম, কোনােটাই তাকে বাঁধতে পারেনি। তাই সে অনায়াসে আশ্রমের বাইরে ম্লেচ্ছজাতি বা যুনকদের সঙ্গে মেলামেশা করে, সারাদিন গান গেয়ে বেড়ায়, শিশুদের নিয়মভঙ্গের পরামর্শ দেয়। পাথরে যেহেতু মাটির কোনাে স্পর্শ থাকে না, তাই সেখান থেকে গাছ জন্মানাের কোনাে সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু সেই পাথর-প্রাচীরে ঘেরা সংস্কারাবদ্ধ অচলায়তনে কীভাবে পঞ্চকের মতাে মুক্ত-উদার-বিশৃঙ্খল বালক জন্মাল, সে কথা প্রতিপন্ন করতেই উপাচার্য এ কথা বলেছেন।