পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত নব্যযুবকদের সামাজিক দোষ দেখানোর উদ্দেশ্যেই ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ মধুসূদন রচনা করেছিলেন। আলোচ্য প্রহসনে নব্যযুবকদের যে কয়টি দোষ পরিস্ফুটনের আয়োজন করা হয়েছে সেগুলি যথাক্রমে নিম্নরূপ- (১) মদ্যপান, (২) বারবণিতাসক্তি, (৩) কুখাদ্য গ্রহণ, (৪) স্বাধীনতার নামে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন।
উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্য জীবন ও সভ্যতার নানা দোষ শিক্ষিত যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে। এদের মধ্যে মদ্যপান অন্যতম ছিল। মদ্যপান বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা নির্ণয় করতে গিয়ে সমালোচক জয়ন্ত গোস্বামী তাঁর ‘সমাজচিত্রে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা প্রহসন’ গ্রন্থে চারটি কারণ নির্দেশ করেছেন— (১) ইউরোপীয়দের মদ্যপানের দৃষ্টান্ত, (২) প্রগতিশীলতার উত্তেজনা, (৩) প্রত্যক্ষ কর্ম থেকে মুক্তির অবকাশ এবং (৪) মদ্যের সুলভতা। দৈনন্দিন মদ্যপানের ফলে যে বুদ্ধিনাশ, দাম্পত্যজীবনে অশান্তি, সামাজিক সম্পর্কের অশান্তি ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ইত্যাদির উদ্ভব হয় সে সমস্ত জেনেও উনিশ শতকের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত নবযুবকের দল মদ্যপান ত্যাগ করতে পারতো না।
হিন্দু কলেজের কৃতী ছাত্র রাজনারায়ণ বসু মদ্যপান করেন জানতে পারলে পিতা নন্দকিশোর বসু তিরস্কারের পরিবর্তে তাঁকে তাঁর সঙ্গে মদ্যপান করতে বলেন। দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় মনে করতেন সামাজিক সংস্কারকর্মে ব্রতী হলে মদ্যপানের মাধ্যমে প্রথম কুসংস্কার দূর করতে হবে। মদ্যপানে আহ্বান জানালে তা প্রত্যাখ্যান করা শিষ্টাচার বহির্ভূত বলে মনে করা হতো। এ সমস্ত তথ্য শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়। এমনকি সেকালে মহিলারাও মদ্যপানে পুরুষদের সমকক্ষ হয়ে উঠেছিলেন বলে জানা যায়। প্যারীচাঁদ মিত্র ‘মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়’ গ্রন্থে মদ্যপানের বিভীষিকার এক চিত্র প্রদান করেছেন। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলেই মদ্যপানে এমন আসক্ত হয়েছিল যে ‘সুলভ সমাচার’, ‘সংবাদ প্রভাকর’ ইত্যাদি নানা পত্রিকা মদ্যপানের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে অবহিত করার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিল। মদ্যপানের ফলে যে লজ্জা, ক্ষমা, দয়া, মায়া, মমতা, বিনয়, সত্যভাষিতা ইত্যাদি বিদূরিত হয় সে সম্পর্কে সকলকে জানানো হয়েছিল। এমনকি কলকাতায় প্যারীচাদ সরকার ‘মদ্যপান নিবারণী সভা” এবং কেশবচন্দ্র সেন ‘ভারত সংস্কারক সভা’ প্রতিষ্ঠা করে মদ্যপানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন।
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ, বিদেশি অনুগ্রহপুষ্ট মানুষের দল, জমিদার শ্রেণীজাত বাবু সম্প্রদায় ইয়ংবেঙ্গলের দল সকলেই পাল্লা দিয়ে মদ্যপান করতো। শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থপাঠে জানা যায়— “বাবু মহাশয়েরা দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া, বুলবুলির লড়াই দেখিয়া, সেতার, এসরাজ, বীণা প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি, ফুল আখড়াই, হাফ আখড়াই, পাঁচালী প্রভৃতি শুনিয়া, রাত্রিকালে বারাঙ্গনাদিগের গৃহে গৃহে গীতবাদ্য ও আমোদ-প্রমোদ করিয়া কাল কাটাইত এবং খড়দহের ও ঘোষপাড়ার মেলা এবং মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময়ে কলিকাতা হইতে বারাঙ্গনাদের সঙ্গে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিতে যাইত।” মদ্যপান ব্যতীত গণিকাসঙ্গ ও বাইজীদের প্রতি আসক্তির ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণকারী বাঙালি সমাজ খাদ্যাখাদ্যের ব্যাপারেও এদেশের নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে কুখাদ্য ভোজনকেই সভ্য হওয়ার পথ বলে মনে করত। মুরগীর মাংস, গো-মাংস ইত্যাদি নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ করেই ইয়ং বেঙ্গলের দল তৃপ্ত থাকত তাই নয়; তারা ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের রাগাবার জন্য বলতো- “আমরা গোরু খাইগো, আমরা গোরু খাইগো”। শিবানাথ শাস্ত্রীর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থ থেকে এ সমস্ত তথ্য জানা যায়।
সমালোচক অশোককুমার মিশ্র তাঁর ‘বাংলা প্রহসনের ইতিহাস’ গ্রন্থে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের যে বৈশিষ্ট্যগুলি দেখিয়েছেন সেগুলি হল—
- “(১) পোষাক পরিচ্ছদে সাহেবিয়ানা প্রদর্শন।
- (২) মাতৃভাষায় অবজ্ঞা নয়তো অজ্ঞতা-ইংরেজি ভাষা-প্রীতি।
- (৩) ফ্যাশনপ্রিয়তা।
- (৪) মদ্যপ্রীতি।
- (৫) বিদেশি উৎসবাদির প্রবর্তনে ঐকান্তিক আগ্রহ।
- (৬) দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ইংরেজি কেতার অনুসরণ।
- (৭) স্ত্রী শিক্ষার বিস্তার ও স্ত্রী স্বাধীনতার সমর্থন।
- (৮) হিন্দুবিদ্বেষী মনোভাবের প্রকাশ।”
ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত নব্যযুবকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’য় রূপায়িত হয়েছে। নবকুমার, কালীনাথ, চৈতন, শিবু ইত্যাদিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই এখানে প্রতিফলিত। উপরি-উক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি প্রায় সমস্তই ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’য় রূপায়িত হয়েছে। মদ্যপ্রীতি, প্রাত্যহিক জীবনে ইংরেজি কেতার অনুসরণ, সভা আহ্বান করে সম্মিলিত হয়ে পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে সভা পরিচালনা, ইংরাজি শব্দের ব্যবহার, পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণে মদ্যপানোন্মত্ত হয়ে নবকুমারের ভগ্নীর গণ্ডদেশ চুম্বন, বারাঙ্গনা প্রীতি, মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা, স্ত্রীলোকদের জন্য শিক্ষা ও স্বাধীনতা প্রসার, জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার সভ্যদের অখাদ্য-কুখাদ্য গ্রহণ ইত্যাদি সমস্তই ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রহসনে পরিবেশে, সংলাপে চরিত্রে, ঘটনার উপস্থাপনায় চিত্রিত হয়েছে। সুকুমার সেনের মতে, “জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার সভ্যদের আদর্শ হিন্দুকলেজের ছাত্রদের প্রতিষ্ঠিত ‘জ্ঞানোপার্জিক সভা’র অনুকরণে কল্পিত বলিয়াই মনে হয়।” [ বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস : তৃতীয় খণ্ড। ] রাজেন্দ্রলাল মিত্র ‘বিবিধার্থ সংগ্রহে’ লিখেছিলেন যে, নব্যবাবুদের দোষগুণ প্রদর্শনই আলোচ্য প্রহসনের লক্ষ্য। প্রতিটি ঘটনা এবং প্রতিটি চরিত্র জানা বা অজানা কোনো নব্যবাবুর ঘটনা। একেই কি বলে সভ্যতা? প্রহসনটি সকলের দ্বারাই উচ্চপ্রশংসিত হয়েছিল এবং যুবকদের সামাজিক দোষই সেখানে রূপায়িত হয়েছে।