একাঙ্কিকা নাটকের স্বরূপবৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে বাঙলা একাঙ্কিকা নাটক সম্পর্কে আলোচনা কর।

একাঙ্ক নাটকের প্রকরণ সম্বন্ধে যা জান লেখ এবং একটি সার্থক একাঙ্কের উৎকর্ষের কারণগুলি নির্দেশ কর।
দৃষ্টান্তস্বরূপ কোন একটি বাংলা একাঙ্ক নাটক ধরে আলোচনা করে একাঙ্ক নাটকের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি বুঝিয়ে দাও।

পাঁচটি অঙ্কে বিন্যস্ত ঘটনাবিন্যাস এক বা একাধিক ঘটনার সমাবেশ, এক স্থান থেকে স্থানান্তরে, দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে পটভূমি কিংবা পাত্রপাত্রীর পরিবর্তন প্রভৃতি প্রচলিত নাট্যরূপের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। পঞ্চাঙ্ক নাটকের এই প্রচলিত রীতির বাইরেও যে তার অন্যরূপ প্রচলিত ছিল, পঞ্চদশ শতাব্দীর ইংরেজি সাহিত্যে ও প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে একাঙ্কিকার উল্লেখ থেকে বোঝা যায়। মধ্যযুগের ইংল্যান্ডের ‘Mystery’ ও ‘Miracle’ নাটকগুলিতে যীশুখ্রীষ্ট ও প্রাচীনকালের সাধুসন্তদের জীবনের দৃশ্য বিশেষভাবে উপস্থাপিত করা হত, একাঙ্কিকা নাটকের মূল উৎস তাদের মধ্যেই নিহিত। ছোটগল্প ও উপন্যাসের পার্থক্য যেমন মৌলিক, একটি ছোটগল্পকে বিস্তৃত ও পল্লবিত করলেই তাকে যেমন উপন্যাসে পরিণত করা যায় না কিংবা উপন্যাসকে সংক্ষেপিত করলে সেটি ছোটগল্প হয়ে ওঠে না, তেমনি একাঙ্কিকাকেও পঞ্চাঙ্ক নাটকের রূপ, কিংবা পঞ্চাঙ্ক নাটককে হ্রস্ব করে একাধিকার রূপদান সম্ভব নয় একাঙ্কিকার একটিমাত্র বিশেষ সুনির্বাচিত ঘটনা সংস্থান, বিশেষ পরিবেশ, ক্রমপ্রসারী সুসংলগ্ন দৃশ্য এবং একটি মাত্র চরিত্রের অবলম্বনে, তার গাঢ়বদ্ধ সংহত রূপে একটি বিশেষ ভাবানুভূতিকে দর্শক বা পাঠকের চিত্তে সঞ্চারিত করে দেওয়া হয়। একাঙ্কিকার ঘটনাপ্রবাহ যবনিকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গেই নায়ক-চরিত্রে ভেতর-বাইরের দ্বন্দ্ব এবং অন্যান্য চরিত্রের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের সংঘাতের মধ্য দিয়ে তীব্রগতিতে ক্রম-পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়ে ক্লাইম্যাক্স বা পরিণতির শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছায়। পঞ্চমাঙ্ক নাটকের মত একাঙ্কিকাও কমেডি বা ট্র্যাজেডি হতে পারে, কিন্তু নাটকের চরম মুহূর্তে উপস্থিত হওয়ার আগে তার ট্র্যাজেডি বা কমেডির রূপ আভাসিত হয় না। একাঙ্কিকার চরিত্র, একটি বিশেষ ভাব, হাস্য পরিবেশ ইত্যাদির মধ্যে যে কোনও একটি উপাদানের অবলম্বনে নাট্যরস সৃজিত হতে পারে।

আধুনিক যুগে জীবনযাত্রার জটিলতা বৃদ্ধি, কর্মব্যস্ত জীবনে সময়াভাব, জীবনের ঊর্ধ্বশ্বাস দ্রুতগতি, ব্যক্তির জীবনে বিচ্ছিন্নতার সংকট, শত খন্ডিত অস্তিত্বের সমস্যা ও বেদনা প্রভৃতি কারণে একাঙ্কিকা নাটকের বিপুল প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায়। এই শতাব্দীতে অজস্র রসোত্তীর্ণ একাঙ্কিকা নাটক রচিত হয়েছে। Norman Mckinne-এর The Bishop’s Candlestick, Oliver Conway-এর Becky Sharp, লেডি গ্রেগরির The Gaol Gate ও The Rising of the Moon, হাউসম্যানের Under Fire, গওয়র্দির The Little Man প্রভৃতি রসোত্তীর্ণ একাঙ্ক নাটকের উদাহরণ। জেলেদের ট্র্যাজিক জীবন নিয়ে রচিত সিঙ্গ-এর The Riders to the Sea গঠননৈপুণ্য ও করুণরসনিটোলতায় একটি অতুলনীয় একাঙ্ক নাটক। এই নাটকটি সমগ্র পৃথিবীর নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একাঙ্কিকা নাটকরূপে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছে।

বাঙলা একাঙ্ক নাটকের প্রবর্তক মন্মথ রায়। তার ‘একাঙ্কিকা’, ‘নব একাঙ্ক’, ‘ফকিরের পাথর’ ও ‘বিচিত্র একাঙ্ক’ সংকলন গ্রন্থগুলিতে অন্তর্ভুক্ত একাঙ্ক নাটকগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি নাটক নিঃসন্দেহে রসোত্তীর্ণ। তাঁর ‘একাঙ্কিকা’র অন্তর্ভুক্ত ও সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা ‘বিদ্যুৎপর্ণা’ পরীক্ষা করে দেখলেই এই জাতীয় নাটকের বৈশিষ্ট্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নাটকটি পড়তে হয় রুদ্ধ নিঃশ্বাসে, গীতিকবিতার মত তার সুসম্বন্ধ রূপ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের আবিষ্ট করে রাখে, আমাদের চেতনা টানটান হয়ে থাকে, এক মুহূর্তের জন্যও শিথিল বা বিক্ষিপ্ত হবার সুযোগ পায় না। নাটকটি পাঠ বা দর্শনের পরও গীতিকবিতার মতই তার ভাববস্তু আমাদের মনে দীর্ঘকাল ধরে অনুরণিত হতে থাকে। নাটকটির নায়িকা বিদ্যুৎপর্ণা বিষকন্যা, জীবনের অমৃতসুধা বিতরণের জন্য নয়, সকলকে বিষের জ্বালায় দগ্ধ ও অভিশপ্ত করার জন্যই এই পৃথিবীতে সে এসেছে। একাঙ্কিকার ক্ষুদ্র, সংহত, কেন্দ্রাভিমুখী রূপ বা আধারের জন্যই আমাদের অনুভব করতে হয়, এই বিষকন্যার তীব্র, জ্বালাময় রূপযৌবন হাবভাব ছলাকলার বিষ যেন নাটকটির মধ্যে তরল অগ্নিস্রোতের মতই প্রবাহিত হয়েছে, আমাদের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় যেন সেই জ্বালা ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্যুৎপর্ণা তার হাস্য-লাস্যে, রূপযৌবনের হিল্লোলে, কটাক্ষ-বিদ্রুপের চোখধাঁধানো আলোকচ্ছটায় চারদিকে তার সেই বিষ তথা সর্বনাশের তরল অগ্নিস্রোত ছড়িয়েছে। পুরোহিত তার গোপন কামনা ও প্রচ্ছন্ন ঈর্ষা নিয়ে শোচনীয় মৃত্যুবরণ করে এই ধ্বংস ও সর্বনাশের জীবন্ত প্রতীক বিষকন্যার চরণে লুটিয়ে পড়েছে। তাঁর ‘বিদ্যুৎপর্ণা, নাটকটি নায়িকার তীব্র কামনার উত্তেজনা-চঞ্চল হাস্য লাস্য-কটাক্ষ-বিদ্রূপে মোহ ও বিষময়ীরূপে, পরিবেশ-সংস্থান ও সংলাপনৈপুণ্যে সত্যই উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। বুদ্ধদেব বসু, নন্দগোপাল সেনগুপ্ত, প্রমথনাথ বিশী, পরিমল গোস্বামী প্রমুখ সাহিত্যিকেরা কয়েকটি একাঙ্ক নাটক লিখেছেন। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বনফুলের ‘দশভানে’র অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি নাটক মনোগ্রাহী রসোজ্জ্বল সৃষ্টি। তাঁর বিদ্রুপাত্মক একাঙ্ক কাব্যনাট্য ‘কবয়’, কাল্পনিক দেবদেবীদের নিয়ে রচিত ‘অন্তরীক্ষে’, ‘শিকাকাবাব’, ‘বানপ্রস্থ’ প্রভৃতি অভিনবত্বে, ঘটনা সংস্থানে, চরিত্রপরিকল্পনায় ও চিত্তাকর্ষক সংলাপে অতুলনীয়। দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের একাঙ্কিকা নাটকগুলিতে সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা চিত্রিত হয়েছে।

বহু মঞ্চসফল নাটকের রচয়িতা বিধায়ক ভট্টাচার্যের একাঙ্কিকা নাটকের সংখ্যা খুবই কম। তাঁর ‘কান্নাহাসির পালা’র অন্তর্ভুক্ত দুটি একাঙ্কিকার মধ্যে ‘কান্নার পালা’ গঠন-কৌশলে একটি নিটোল মুক্তাবিন্দুর মত রসোজ্জ্বল। সলিল সেনের ‘সন্ন্যাসী’ জনপ্রিয় একাঙ্কিকা। কিরণ মৈত্রের ‘এক অঙ্কে শেষ’ সংকলন-গ্রন্থের চারিটি একাঙ্ক নাটক রচনা-নৈপুণ্যে বিশিষ্ট। সোমেন্দ্রচন্দ্র নন্দী, সুনীল দত্ত, অজিত গঙ্গোপাধ্যায় প্রভৃতি নাট্যকারের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য একাঙ্ক নাটক রচনা করেছেন। শৈলেশ গুহনিয়োগীর ‘ফ্লু’, ‘রিহার্সাল’, ‘পলিটিকস’, ‘গোলপার্ক’, প্রভৃতি কৌতুকরসাশ্রিত নাটকগুলি জনপ্রিয়। ‘চিত্তরঞ্জন ঘোষের ‘কন্যকা’র তিনটি একাঙ্ক নাটকও রসোত্তীর্ণ রচনা। ইংরেজি একাঙ্কিকা সম্পর্কেই নয়, বাঙলা ভাষায় একাঙ্কিক নাটক সম্পর্কেও ফ্র্যাংক ভার্ননের এই মন্তব্য প্রযোজ্য : “It is important that good one act plays should continue to be written. This art-form is one of the hopes of England’s dramatic future.”

অনার্স বাংলা চতুর্থ পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment