“একটি ক্ষুদ্র সংসারজীবনের ব্যর্থ স্নেহ, অসহায় মানুষের একটি সাধারণ অনিবার্য হৃদয়বেদনা অপূর্ব কল্পনাশক্তির যাদুমন্ত্রে নিখিল বিশ্বের অন্তলীন মর্মব্যথায়, আদিমাতা ধরিত্রীর বেদনাপীড়িত সন্তানমমতার এক সর্বব্যাপী বিষাদ-সঙ্গীতে রূপান্তরিত হইয়াছে।”—আলোচনা করো।

‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায় কবি বিশেষ এক কাহিনীসূত্র অবলম্বন করে এক নির্বিশেষ তজ্বলোকে উত্তীর্ণ হওয়ার শক্তি দেখিয়েছেন। -আলোচনা করো।
দ্বারপ্রান্তে লীন স্তব্ধ মর্মাহত চারি বৎসরের কন্যাটির বেদনা কিভাবে উদাসী বসুন্ধরার দূরবিস্তারী বেদনার সঙ্গে এক হয়ে গেল তা’ ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতা অবলম্বনে বিশ্লেষণ করো।

‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটি শুরু হয়েছে গল্প বলার ভঙ্গিতে। চাকরিজীবী বাঙালি মধ্যবিত্ত গৃহস্থের সাংসারিক জীবনের চিত্র বর্ণনায় কবি নিতান্ত গদ্যময় ভাষা ব্যবহার করেছেন। পূজাবকাশের পর গৃহস্বামী ফিরে যাচ্ছেন প্রবাসে কর্মস্থলে। গৃহিণী যাত্রার আয়োজন করে দিতে ব্যস্ত। সে ব্যস্ততায় আসন্ন বিচ্ছেদের বেদনা চাপা পড়ে আছে। প্রবাসে কখন কি প্রয়োজন হবে ভেবে নানা খুঁটিনাটি জিনিস সাজিয়ে দিচ্ছেন গৃহিণী। খাদ্যদ্রব্য থেকে ওষুধপত্র কিছুই বাদ পড়েনি। স্বামীর বিদেশ যাত্রার আয়োজনের মধ্যে গৃহিণী হৃদয়ের মমতাকে উজাড় করে দিয়েছেন। সঞ্চিত দ্রব্যগুলোর চিত্র কবি বেশ বিশদ বর্ণনা করেছেন। ‘সোনামুগ’, ‘সরু চাল’, ‘গুড়ের পাটালি’, ‘রাই সরিষার তেল’ প্রভৃতি খাদ্যবস্তুর উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম্য গৃহস্থ জীবনের পরিবেশটা যথাযথভাবে ফুটে উঠেছে। কবিতার এই গদ্যময় বাস্তবতার বর্ণনার ভাষাও আবেগ-বর্জিত, সাধারণ। ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথ যে ভঙ্গিতে সাধারণ জীবনের ছবি পরিস্ফুট করেন- এখানেও ভঙ্গিটা অনুরূপ। কবিতাটি এইভাবে একটি অতি সাধারণ জীবনের স্তর থেকে শুরু হয়েছে। বিদায় মুহূর্তে উদ্বেল গৃহিণীর অশ্রু গোপনের চেষ্টা একেবারের জন্য একটা বেদনার মাধুরী সৃষ্টি করে।

এর পরে আসে আর একটি চিত্র। গৃহদ্বারে বসে আছে গৃহস্বামীর চার বছরের শিশুকন্যা। কাজের ব্যস্ততায় মা তার দিকে আর নজর দিতে পারেনি। এতক্ষণ সে ছায়ার মত ঘুরছিল পিতার পাশে পাশে। এখন দ্বার দিয়ে বাইরে যাওয়ার সময়ে পিতা কন্যার কাছে বিদায় চাইল। মেয়েটি বিষণ্ণ চোখে পিতার দিকে চাইল, দ্বার রোধ করল না, উঠলও না, শুধু নিজ হৃদয়ের স্নেহের অধিকার ঘোষণা করে বলল, ‘যেতে আমি দিব না তোমায়’। শিশুর এই অবোধ দাবিকে কে মূল্য দেয়। বেদনার্ত হলেও পিতাকে শিশুর আবদার উপেক্ষা করে যেতে হয়। এই পর্যন্ত কবিতাতে বক্তব্য একটা সাধারণ বিদায়দৃশ্য বর্ণনার চেয়ে খুব বেশি কিছু নয়। প্রথম পাঠের সময়ে এই পর্যন্ত পড়েও বুঝতে পারা যায় না যে ঐ শিশুকণ্ঠে উচ্চারিত স্নেহের দাবির মধ্যে কোন গভীরতর তাৎপর্য নিহিত থাকতে পারে।

পিতা বিদায় নিয়ে পথে বেরিয়েছেন। পথের দু’ধারে শরতের ভরা ফসলের ক্ষেতের উপর রৌদ্র পড়েছে, আকাশে জমে আছে পুঞ্জ পুঞ্জ শুভ্র মেঘ। এমন নির্জন নিস্তব্ধ পথে চলতে চলতে প্রবাস যাত্রীর মনে কন্যার সেই উক্তিটি গুঞ্জরিত হচ্ছে। বিস্ময় এই যে, অতটুকু মেয়ে কোন শক্তিতে এমন প্রবল অধিকারের কথা ঘোষণা করল। সংসারে চলে যাওয়া তো অপ্রতিরোধ্য। আমরা হয়তো যেতে না দেবার ইচ্ছাটুকু প্রকাশ করতে পারি, কিন্তু ‘যেতে দেব না’—এমন প্রবল গর্বিত বাণী উচ্চারণ করতে পারি না; কারণ সে গর্ব ত’ চূর্ণ হয়ে যায়। যাকে আমরা ধরে রাখতে চাই প্রবহমান জীবনের স্রোত তাকে কোথায় টেনে নিয়ে যায়, কেউ জানে না। এ পর্যন্ত কবিতাটি সাধারণ ভাবুকতার স্তরে নিবদ্ধ, এর মধ্যে গূঢ় গভীর কল্পনার পরিচয় নেই। কিন্তু এরপর থেকেই কবিতাটিতে ভিন্নতর সুর লেগেছে। সাধারণ বিচ্ছেদ-বেদনা অসাধারণ কল্পনাশক্তির স্পর্শে রূপান্তরিত হয়েছে বিশ্বের অন্তর্নিহিত এক চিরন্তন বেদনাবোধে। নিতান্ত সাধারণ জীবনের কথা থেকে এভাবে গভীরতর জীবনজিজ্ঞাসায় উত্তীর্ণ হবার এই ভঙ্গিটুকু অভিনব।

“কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ, সমস্ত পৃথিবী।” এখান থেকে ভাষাভঙ্গির পরিবর্তন লক্ষণীয়। অকস্মাৎ কবির দৃষ্টির সামনে থেকে যেন বাস্তব সংসারের ব্যক্তিগত দুঃখ-বেদনার পদাখানা সরে গেছে। দুরে প্রসারিত আকাশ ও পৃথিবীর প্রতি কবির দৃষ্টি পড়েছে। এ পৃথিবী প্রতিমুহূর্তে নব নব রূপে প্রাণ সৃষ্টি করে তুলেছে। ধরিত্রীর বুক ভরে আছে এই প্রাণ সম্পর্কে। মাতার মত স্নেহব্যাকুলতায় বসুন্ধরা তাঁর এই হৃদয়ের ধনগুলি নিবিড় আলিঙ্গনে চিরকালের জন্য ধরে রাখতে চায়, যেন সেই আকাঙ্ক্ষা ‘যেতে নাহি দিব’ এই বাণীরূপে অভিব্যক্ত হচ্ছে। কিন্তু ইচ্ছা না থাকলেও এই ভালোবাসার বন্ধনকে শিথিল করতেই হয়, কারণ চিরকালের জন্য কিছুই ধরে রাখা যায় না। প্রাণপ্রবাহ সৃজনের মুহূর্ত থেকে কবির কাছে শিশুকণ্ঠের আর্তস্বর, বসুন্ধরার মর্মবিদারী হাহাকার একসূত্রে প্রথিত হয়ে একই অর্থ বহন করে।

প্রেমের ধর্ম প্রিয়জনকে চিরদিনের জন্যে ধরে রাখা, কিন্তু এ বিশ্বে স্থিতির কোনও স্থান নেই। এ বিশ্বে অবিরাম গতিতে জীবনস্রোত প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এই বিশ্বনিয়মকে বাধা দেবার ক্ষমতা প্রেমের শক্তিরও নেই। বিশ্বে নিরন্তর ধ্বনি উঠছে ‘যেতে নাহি দিব’ কিন্তু প্রলয় সমুদ্রবাহী সৃজনের স্রোতে জীবনধারা ছুটে চলেছে, ব্যর্থ ভালবাসার বেদনায় তাই আকাশ, পৃথিবী আচ্ছন্ন। এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই বসুন্ধরার বিষাদমূর্তিই এই কবিতায় বড় হয়ে উঠেছে। জীবনে প্রেম মিথ্যা নয়, কিন্তু সেই চিরজীবী প্রেম মরণ, পীড়িত। চলমান জীবনপ্রবাহের ওপর অচঞ্চল মেঘের ছায়ার মত প্রেম যেন আপনার ছায়া বিস্তার করে রেখেছে। কবিতার শেষ অংশে বিষাদ ও বেদনার বর্ণনায় ভাষা ব্যঞ্জনার নতুন শক্তিতে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। ‘আশাহীন শ্রান্ত আশা টানিয়া রেখেছে এক বিষাদ কুয়াশা বিশ্বময়’ ‘চঞ্চল স্রোতের নীড়ে আছে একখানি অচঞ্চল ছায়া’—’অশ্রুবৃষ্টিভরা, কোন্ মেঘের সে মায়া’ প্রভৃতি অংশে বাংলা ভাষাকে যেন প্রকাশ ক্ষমতার চূড়ান্ত সীমায় উপস্থিত করা হয়েছে।

কবিতার প্রথম অংশের ভাষার সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যায় কেমনভাবে কবি নিতান্ত সাধারণ জীবনের গদ্যময় বাস্তবতা থেকে অনায়াসে গভীরতর অনুভূতির স্তরে উত্তীর্ণ হয়ে এসেছেন। এই স্তরে বসুন্ধরাকেই কবি প্রকাশ করেছেন বিষাদমগ্ন উদাসিনী মাতৃমূর্তিতে। মাতা ধরিত্রী সৃষ্টি করেন, কিন্তু সৃষ্ট বস্তুকে রক্ষা করতে পারেন না। তিনি হৃদয়ের ভালবাসা উজাড় করে দেন, কিন্তু মৃত্যুর আঘাত থেকে নিজের হৃদয়ের ধনগুলিকে বাঁচাতে পারেন না। সত্যই কবিতাটি শেষ পর্যন্ত এক সর্বব্যাপী বিষাদ সঙ্গীতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। আসলে মহাকবির কাব্যসৃষ্টির মূল রহস্যই হল বিশেষ থেকে সামান্যের দিকে অগ্রসর হয়ে যাওয়া। প্রাত্যহিকতার এক বিশেষ অভিজ্ঞতা আলোচ্য কবিতাতেও যেন চিরন্তন সাধারণ সত্যে স্থিত হয়ে কবিতাটির কাব্যমূল্য বৃদ্ধি করেছে।

অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment