কোনও শিল্পকেই যথাযথ সংজ্ঞা দানে বিভূষিত করা সম্ভব নয়। শিল্প মাত্রেই সৃষ্টি। সৃষ্টির কোনও সীমানা, স্বরূপ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। একালের সাহিত্যের সমৃদ্ধিতম ও জন প্রিয়তম শাখা। প্রায় গত দুশত বছরের বেশি সময় ধরে সারা বিশ্বজুড়ে এর পদচারণা চলছে। নানা ভাষায়, নানাভাবে নানা রীতিকে সুগঠিত এই উপন্যাসের যথাযথ পরিচয় উদঘাটন দুঃসাধ্য। তথাপি উপন্যাসের গতিবিধি ও প্রকরণ রীতির প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে বিভিন্ন সমালােচক সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন। যেমন E. M. Forster তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘A Spect of the Novel’ এ বলেছেন— A Fiction in prose of a certain extent. স্পষ্টই এখানে তিনি উপন্যাসকে একটি নির্দিষ্ট আয়তনের গদ্য কাহিনি বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে র্যালফ ফক্সের অভিমত- “The novel is not merely fietional prose, it is the prose of man’s life. The first art to attempt to take the whole man and give him expression.” তলে এসকল সংজ্ঞা উপন্যাসের সামগ্রিক পরিচয় দান করে না।
অষ্টাদশ শতকে ইংরেজী উপন্যাসের সূচনা লগ্নে হেনরি ফিল্ডিং তাঁর ‘Tom jones’ উপন্যাসে এ সম্পর্কে উপন্যাসের সংজ্ঞা নির্ধারণে অসাড়তা প্রমাণে ইঙ্গিত দিয়েছেন- “As I man in reality the found of a new province of writing, So I am at liberty to make went laues I please therein.” 1998 পর্যালােচনার খাতিরে উপন্যাসের সংজ্ঞা নির্দেশে বলা যেতে পারে- “বর্ণনাত্মক রীতিতে মানব জীবনের দ্বম্বমুখর কাহিনি গদ্য ভাষায় পরিবেশিত হয় যে সাহিত্য শাখাতে, তাকে উপন্যাস রূপে চিহ্নিত করা যায়।”
ইংরেজি নভেল এবং উপন্যাসের সম্পর্ক হল এই যে, উপন্যাসের ইংরেজি প্রতিশব্দ নভেল-এর উৎপত্তি ইতালিয়ান নভেল্লা (Novella) শব্দ থেকে। নভেল্লা শব্দের আক্ষরিক অর্থছােট নতুন বস্তু। ইতালিতে ‘নভেল্লা’ শব্দটি গদ্যে লেখা ছােট কাহিনি বােঝাতে ব্যবহৃত হত। পাঠকের কাছে নভেলের গুরুত্ব স্বীকৃত হত তার আকর্ষণীয় গল্প সৃষ্টিতে। গল্পের পরেই যখন বিভিন্ন চরিত্রের আচার আচরণ দ্বন্দ্ব মনস্তত্ত্ব অভিব্যক্তি হতে থাকে তখন নভেল আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। তাই নভেল গল্পের প্রাধান্য স্বীকৃত হয়।
আর উপন্যাস হল মূলতঃ বাস্তব নির্ভর। সমকালীন সমাজ ও পারিবারিক জীবনের বিশ্বাসযােগ্য দলিল হল উপন্যাস। বাস্তবতার বর্ণনা দান ও বিশ্লেষণই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। এর মূল মাপকাঠি হল জীবনমুখিতা তথা বাস্তব গানিতা। বিশ্বজগতের সীমাহীন বিচিত্র জীবন লীলা, মানব জীবনের বহুমুখী গতি প্রকৃতির সমগ্র ও শিল্প সমন্বিত রূপ চিত্ৰই উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। তাই উপন্যাস ভিন্ন শ্রেণিভুক্ত।
পদ্ধতি অনুযায়ী ও বিষয় অনুযায়ী উপন্যাসকে বারটি ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলি নিম্নরূপ—
- আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস- শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’
- আঞ্চলিক উপন্যাস- তারাশংকরের ‘হাসুলী বাঁকের উপকথা’
- ঐতিহাসিক উপন্যাস- বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাজসিংহ’
- সামাজিক উপন্যাস- শরৎচন্দ্রের ‘পল্লী সমাজ’
- রাজনৈতিক উপন্যাস- শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’
- মনস্তত্ত্বমূলক উপন্যাস- রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’
- চেতনা প্রবাহমূলক উপন্যাস- ধূর্জটি প্রসাদের ‘অন্তঃশীলা’
- মহাকাব্যিক উপন্যাস- রবীন্দ্রনাথের ‘গােরা’
- কাব্যধর্মী উপন্যাস- রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’
- কারা উপন্যাস- সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’
- পত্রোপন্যাস- শৈলজানন্দের ‘ক্রৌঞ মিথুন’
- গােয়েন্দা/অপরাধমূলক উপন্যাস- সত্যজিৎ রায়ের ‘ফেলুদা’