সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগ
ভারতীয় সংস্কারকদের উদ্যোগে ছড়িয়ে পড়া সমাজ সংস্কার আন্দোলন গুলি ভারতীয় সমাজের কুসংস্কার বহু ধুলোবালি ঝেড়ে সমাজকে কলুষতামুক্ত করেছিল। আন্দোলনের প্রভাবে প্রাশ্চাত্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ভাবধারার মুক্ত বাতাস ভারতীয় সমাজে প্রবেশ করে এই সমাজে সার্বিক অগ্রগতি ঘটিয়েছিল। ভারতীয় সংস্থার আন্দোলন এ দেশের ব্রিটিশ সংস্কারকদের নীতিকেও যথেষ্ট প্রভাবিত করে। এই সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সমাজে বিভিন্ন কুসংস্কার দূর করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই পদক্ষেপ গুলি হল –
১. শিশুহত্যা রদ
ভারতীয় হিন্দু সমাজের নিষ্ঠুর ও অমানবিক শিশু হত্যার প্রথা প্রচলিত ছিল। বহু সন্তান হীন রা নারী ঈশ্বরের কাছে সন্তান কামনা করে বলত যে, তার একাধিক সন্তান জন্মগ্রহণ করলেও একটি সন্তান কে সে গঙ্গাসাগরে উৎসর্গ করবে। রাজপুতনা, মধ্য ও পশ্চিম ভারতের দরিদ্র রাজপুত, জাঠ ও মএওয়আট জাতির মধ্যে ও শিশু কন্যাকে হত্যার ও প্রথা প্রচলিত ছিল। ভবিষ্যতের পণপ্রথার ছাপ থেকে মুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে দরিদ্র পিতা মাতা অনেক সময় তাদের শিশু কন্যাকে হত্যা করত। সরকার ১৭৯৫ ও ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে দুটি পৃথক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে শিশু হত্যা নিষেধ করে। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে আইন প্রণয়ন করে নববিজিত অঞ্চল গুলিতে শিশু হত্যা নিষেধ করা হয়।।
২. সতীদাহ প্রথা রদ
ভারতীয় সমাজে দীর্ঘকাল ধরে সীতাদাহ প্রথা নামে এক অমানবিক প্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথা অনুসারে মৃত স্বামী চিতায় তার জীবন তো বিধবা স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা হতো। সরকার ১৮১২, ১৮১৫১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কয়েকটি বিধি নিষেদ ঘোষণা করে সীতাদাহ প্রথা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।। রাজা রামমোহন রায় সীতা দাহ প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন ও শক্তিশালী জনমত গড়ে তোলেন। শেষ পর্যন্ত বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ৪ ডিসেম্বর ১ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সীতা দাহ প্রথা নিষেধ করেন। এই আইনের সীতা দাহ প্রথাকে বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়।
৩. বিধবা বিবাহ আইন
হিন্দু সমাজে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে এবং বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। রক্ষণশীল হিন্দু নেতার বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে প্রচার করলে অভিধবা বিবাহ হিন্দু স্বাস্থ্যসম্মত বলে বিদ্যাসাগর বিভিন্ন শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন। শেষ পর্যন্ত বড়লাট লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ২৬ শে জুলাই বিধবা বিবাহকে আইন সম্মত বলে ঘোষণা করেন।
৪. নরবলি প্রথা রদ
উড়িষ্যার খোন্দ উপজাতি তাদের চাষের জমির উর্বরতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নরবলি দিত। বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ এই নরগলি প্রথার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তা বিশেষ সফল হয়নি। পরবর্তীকালে ১৮৪৭ ও ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ উদ্যোগে এই অমানবিক প্রথা অবসান ঘটে।
৫. সহবাস সম্মতি আইন
সহবাসের ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ফলে ১০-১১ বছরের বালিকা বধূ ফুলমনির মৃত্যুর ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই ঘটনায় অত্যন্ত বিচলিত তৎকালীন বড়লাট লর্ড ল্যান্সডাউনের উদ্যোগে স্যার অ্যান্ড্রূ স্কোবল ‘সহবাস সম্মতি বিল’ উত্থাপন করেন। এ আইনে বিবাহ সর্বনিম্ন বয়স ১০ থেকে বাড়িয়ে ১২ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
৬. দাসত্ব প্রথা রদ
ভারতীয় সমাজে প্রাচীনকাল থেকেই দাসত্ব প্রথা প্রচলিত ছিল। বড়লাট লর্ড অকল্যান্ড ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে এক আইনের মাধ্যমে ভারতের দাসত্ব প্রথা নিষেধ ঘোষণা করেন।
উপসংহার
বিডি সরকার প্রথম দিকে ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন মনোভাব গ্রহণ করলেও শেষ পর্যন্ত ভারতীয় সংস্কারকদের চাপে সেই উদাসীনতা ভঙ্গ হয়। সমাজ সংস্কারগণ সামাজিক অগ্রগতির বিভিন্ন উদ্যোগে যথেষ্ট সাফল্য লাভ করলেও কিছু কিছু বিষয় সরকারের আইনি সহায়তা অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। সংস্কারকদের সহযোগিতার সরকার যেসব আইন সহজে প্রবর্তন ও করতে সক্ষম হয়।