ইন্দো ইউরােপীয় ভাষাবংশের পরিচয় | ইন্দো-ইরানীয় শাখার পরিচয় | গ্রিক ও ইতালীয় ভাষাশাখার পরিচয় | ভাষার রূপতত্ত্ব বা আকৃতি অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগ

ভাষার রূপতত্ত্ব বা আকৃতি অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগ করার পদ্ধতিগত সুবিধা কী? এই পদ্ধতিটি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলােচনা করাে।

রূপতত্ত্বগত বিশ্লেষণে বিভিন্ন ভাষার সাংগঠনিক অবয়ব সুস্পষ্ট হয়। এই পদ্ধতিতে প্রাথমিকভাবে বিশ্বের ভাষাসমূহকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়—

  • অনন্বয়ী বা অসমবায়ী (Isolating বা Positional) ভাষা এবং
  • সমবায়ী ভাষা।

যে সব ভাষায় উপসর্গ-অনুসর্গ-প্রত্যয় বিভক্তির অস্তিত্ব নেই এবং বাক্যে অবস্থান অনুযায়ী শব্দের কারকত্ব বা অন্য ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়, সেইসব ভাষাই হল অনন্বয়ী বা অসমবায়ী ভাষা। চিনা ভাষা এবং ভােট-চিনা ভাষাবংশের বেশ কয়েকটি ভারতীয় ভাষা এই শ্রেণির। সমবায়ী ভাষার এসব উপাদান আছে।

রূপতত্ত্ব অনুযায়ী সমবায়ী শ্রেণির ভাষাগুলি মুক্তাম্বয়ী (Agglutinaling) বর্গ, অত্যন্বয়ী (Incorporating) বর্গ এবং সমন্বয়ী (Inflectional/Synthetic) বর্গ-এই তিনপ্রকার বর্গে বিভক্ত।

মুক্তান্বয়ী বর্গ: এই বর্গের ভাষাগুলিতে উপসর্গ-অনুসর্গ- প্রত্যয়-বিভক্তি শব্দ বা পদগঠনে যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমনি বাক্যে স্বাধীন পদ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। তুর্কি, সােয়াহিলি ভাষা এবং আলতাইক, ফিনাে-উগ্রীয় বা উরানীয় ও দ্রাবিড় ভাষাবংশের বিভিন্ন ভাষা এই বর্গের অন্তর্গত।

অত্যন্বয়ী বর্গ: এই বর্গের ভাষাগুলিতে ভাষার অর্থদ্যোতক ক্ষুদ্রতম অংশ হল বাক্য। বাক্যের বাইরে এ ভাষার শব্দের স্বাধীন অর্থ নেই বলে এ ভাষার বাক্য-নিরপেক্ষ শব্দগুলি অসম্পূর্ণ ভাবের বাহক মাত্র। এস্কিমো ভাষা এই বর্গের ভাষা।

সমন্বয়ী বর্গ: এই জাতীয় বর্গের ভাষাগুলিতে উপসর্গ অনুসর্গ-প্রত্যয়-বিভক্তি শব্দ বা পদ গঠনেই কেবল ব্যবহৃত হয়, বাক্যে স্বাধীন পদ হিসেবে কখনােই ব্যবহৃত হয় না। সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি, আরবি, হিন্দুস্থানি (হিন্দি ও উর্দু) প্রভৃতি এই বর্গের ভাষা।

ইন্দো ইউরােপীয় ভাষাবংশের পরিচয়

আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যতগুলি ভাষাবংশ বা ভাষাপরিবার আছে, তাদের মধ্যে ইন্দো-ইউরােপীয়ই শ্রেষ্ঠ। আনুমানিক ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দক্ষিণ রাশিয়ার উরাল পর্বতের পাদদেশে (মতান্তরে মধ্য ইউরােপে) এই ভাষাপরিবারের আদি ভাষার জন্ম। ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষার আদি রূপ বা মূল ভাষার কোনাে নিদর্শন পাওয়া যায়নি। সে কারণেই, সেই মূল ভাষা থেকে জন্ম নেওয়া প্রাচীন ভাষাগুলির (যেমন—বৈদিক, আবেস্তীয়, গ্রিক, লাতিন, প্রাচীন পারসিক ইত্যাদি) মধ্যে তুলনামূলক আলােচনা করে মূল ভাষার একটি অনুমান-নির্ভর রূপ গড়ে তােলা হয়েছে। আনুমানিক ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মূল ইন্দো- ইউরােপীয় জাতি আর্যরা তাদের আদি বাসস্থান থেকে ক্রমশ এশিয়া ও ইউরােপের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে মূল আর্যভাষা থেকে ক্রমশ দশটি প্রাচীন ভাষাশাখার জন্ম হয়—

  • ইন্দো-ইরানীয় (Indo-Iranian),
  • বালতাে-স্লাভিক (Balto-Slavic),
  • আলবেনীয় (Albanian),
  • আরমেনীয় (Armenian),
  • গ্রিক (Greek),
  • ইতালীয় (talic),
  • কেলতীয় (Celtic),
  • তিউনিশীয় বা জার্মানিক (Germanic),
  • তােখারীয় (Tokharian) এবং
  • হিত্তীয় (Hittite)।

এদের মধ্যে প্রথম চারটি কেন্তুম (Centum) বর্গের এবং শেষ ৬টি সতম্ (Satam) বর্গের ভাষাশাখা। ইউরােপের পশ্চিমপ্রান্ত থেকে পূর্বে ভারত পর্যন্ত যতগুলি দেশ, তার বেশিরভাগ ভাষাই ইন্দো-ইউরােপীয় জাতীয়।

ইন্দো-ইরানীয় শাখার পরিচয়

ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাবংশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ইন্দো-ইরানীয় শাখাটি দুটি উপশাখায় বিভক্ত—

  • ইরানীয় আর্য উপশাখা এবং 
  • ভারতীয় আর্য উপশাখা।

ইরানীয় আর্য শাখাটি বিস্তার লাভ করে সমগ্র প্রাচীন পারস্য জুড়ে-এলম এবং মেসােপটেমিয়া (প্রাচীন ইরাক)-র পূর্ব দিক থেকে ব্যাকট্রিয়া পর্যন্ত। ইরানীয় উপশাখার দুটি প্রাচীন ভাষা হল আবেস্তীয় এবং প্রাচীন পারসিক। এই দুটি ভাষাই প্রাচীন ইরানে প্রচলিত ছিল এবং তাদের মধ্যে সাদৃশ্যও ছিল যথেষ্ট। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে ইরানের ধর্মগুরু, পারসি ধর্মপ্রবর্তক জরাথুস্ট্র রচিত গাথাগুলির (গ্রন্থের নাম ‘আবেস্তা’ বা ‘জেন্দ আবেস্তা’) ভাষা ছিল আবেস্তীয় ভাষা। অন্যদিকে প্রাচীন পারসিক ছিল ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রদেশ পারস্ (>পারস্য)-এর ভাষা। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক কারণেই প্রাচীন পারসিক সমগ্র ইরানের রাজভাষা হয়ে দাঁড়ায়। প্রাচীন পারসিক থেকে মধ্যযুগে পবী ভাষা জন্ম নেয়, যে ভাষা থেকে ইরানের আধুনিক ভাষা ফারসির জন্ম। ইরানীয় উপশাখার অন্য দুটি আধুনিক ভাষা হল আফগানিস্তানের ভাষা পশ্তাে বা পুশতু (Pashtu) [পাঠান জাতির ভাষা] এবং পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের ভাষা বেলুচি (Baluchi)। অন্যদিকে ভারতে প্রবেশ করা ভারতীয় আর্য উপশাখার অন্তর্গত প্রাচীন যুগের ভাষা হল বৈদিক ভাষা; পরবর্তীকালের প্রচলিত ভাষাগুলির মধ্যে পালি, সংস্কৃত, প্রাকৃত ইত্যাদি এবং আধুনিক যুগের প্রচলিত ভাষাগুলির মধ্যে হিন্দুস্থানি (হিন্দি ও উর্দু), বাংলা, মারাঠি ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য।

গ্রিক ও ইতালীয় ভাষাশাখার সংক্ষিপ্ত পরিচয়

ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষা বংশের দুটি অন্যতম দুটি শাখা হল গ্রিক ও ইতালীয়।

গ্রিক: প্রাচীন গ্রিক ভাষা গ্রিস, এশিয়া মাইনর, সাইপ্রাস ও ইজিয়ান দ্বীপপুঞ্জে প্রচলিত ছিল। ক্রিট দ্বীপে পাওয়া একটি প্রত্নলেখতে গ্রিক ভাষার প্রাচীনতম (আনুমানিক ১৪৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রিক ভাষার বিভিন্ন উপভাষাগুলির মধ্যে অন্যতম হল আত্তিক ইওনিক (Attic lonic)। হােমারের দুই মহাকাব্য ইলিয়াড (lIliad) ও ওডিসি (Odyssey) [খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী] ইওনিক-এ লেখা। আর আত্তিক রূপে লেখা হয় পরবর্তীকালের উন্নত নাট্যসাহিত্য এবং ক্ল্যাসিকাল গদ্যসাহিত্য। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে আত্তিক ইওনিক নামক গ্রিক উপভাষাকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে গ্রিক সাধুভাষা কোইনে (Koine বা Coine)। এই ভাষা থেকেই আধুনিক গ্রিক ভাষার জন্ম।

ইতালীয়: ইতালীয় শাখার প্রধান ভাষা ঐতিহ্যশালী লাতিন ছিল প্রাচীন রােম সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্য ও প্রতিপত্তির নিদর্শন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের খ্রিস্টধর্মের এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাষা ছিল লাতিন। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত লাতিন ছিল ইউরােপের শিল্প সংস্কৃতিরও ধারক। লাতিনের বিভিন্ন আঞ্চলিক কথ্যরূপ থেকে আধুনিক ইতালীয় ভাষাসমূহের সৃষ্টি হয়। এগুলির মধ্যে প্রধান হল ফরাসি, স্পেনীয়, ইতালীয়, পাের্তুগিজ ইত্যাদি।

বাংলা সব প্রশ্ন উত্তর (একাদশ শ্রেণি)

Leave a Comment