আমরা তাে অল্পে খুশি | করি তাে কার তাতে কী | কী হবে দুঃখ করে | রাত্তিরে দু-ভাই মিলে টান দিই গঞ্জিকাতে/সব দিন হয় না বাজার; হলে হয় মাত্রাছাড়া

“রাত্তিরে দু-ভাই মিলে টান দিই গঞ্জিকাতে/সব দিন হয় না বাজার; হলে হয় মাত্রাছাড়া”- উদ্ধৃতিটির মধ্য দিয়ে কোন জীবনসত্যের প্রকাশ ঘটেছে?

নুন কবিতায় কবি জয় গােস্বামী একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের অসহায়ভাবে কোনােরকমে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার কাহিনিকে বর্ণনা করেছেন। নিতান্ত বাধ্য হয়েই এই পরিবারের লােকেরা সাধারণ ভাতকাপড়েই নিজেদেরকে তৃপ্ত রাখতে শিখেছে। জীবনের যুদ্ধে ক্রমাগত লড়াই করতে থাকা মানুষগুলাের অপ্রাপ্তির তালিকা এতই দীর্ঘ যে, অত্যন্ত অল্পেই খুশি বা সন্তুষ্ট হওয়া ছাড়া তাদের অন্য কোনাে উপায় নেই। ধারদেনা এবং অসুখের মধ্যে দিয়ে কোনােরকমে দিন কেটে যায় তাদের। কিন্তু, কখনাে কখনাে তাদের এই দিনযাপনের গ্লানি বা যন্ত্রণা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তখন, পিতা-পুত্রের সম্পর্ক ভুলে একত্রে গাঁজা খায় তারা। উদ্দেশ্য, নেশার মধ্যে ডুবে গিয়ে কঠোর বাস্তবতাকে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে থাকা।

নিম্নবিত্ত জীবনে প্রতিদিন বাজার না হওয়াটাই এক স্বাভাবিক ঘটনা। এরই মধ্যে সুযােগ পেলে এবং সম্ভব হলে তাদের ইচ্ছে হয়ে যায় লাগামছাড়া। অভাবকে ভুলে গিয়ে মনের ভেতরে সযত্নে লালিত ভাবনা তখন ডানা মেলতে চায়। ফলে তাদের দারিদ্রক্লিষ্ট জীবন তখন কোনাে হিসেবনিকেশের ধার ধারে না। তাই অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা ভুলে, বাজার হয়ে যায় মাত্রাছাড়া। নিম্নবিত্ত মানুষদের বেহিসাবি জীবনদর্শনের প্রতি কবি ইঙ্গিত করেছেন উল্লিখিত উদ্ধৃতিটির শেষ পঙক্তিতে।

“কী হবে দুঃখ করে?”- কবির এই মন্তব্যের কারণ কী?

জয় গােস্বামীর ‘নুন কবিতায় নিম্নবিত্ত মানুষদের অল্পে খুশি হওয়া জীবনে যে অনেক কিছুরই অভাব আছে, সেই অপ্রাপ্তি নিয়ে দুঃখ না করার কথা বলা হয়েছে।

সাধারণ ভাতকাপড়ে আর অসুখে ধারদেনাতে যে-জীবন নিম্নবিত্ত মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম অতিবাহিত করে, অভাব আর বঞ্চনাই সেখানে অবলম্বন। কিন্তু তার মধ্যে থেকেও আনন্দ খুঁজে নেয় ওইসব নিম্নবিত্ত মানুষ। তাদের এই খুশি হওয়া মন থেকে নয়, খুশি না হয়ে উপায় নেই তাই। আসলে তারা জানে, তাদের জীবনে যতই অপ্রাপ্তি থাকুক না কেন, কিছুতেই তাদের সেই অভাব পূরণ হবে না। তাই, নিতান্ত বাধ্য হয়েই অত্যন্ত সামান্য উপকরণের মধ্যে থেকেই তারা আনন্দ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে, নিজেদের তৃপ্ত রাখতে শিখে নেয়।

এই নিম্নবিত্ত মানুষরা যতই তাদের দারিদ্রক্লিষ্ট জীবনের অপ্রাপ্তি বা যন্ত্রণাকে মানিয়ে নিয়ে দিনযাপনের চেষ্টা করুক না কেন, আসলে তারা নিজেদেরইবনা করে। এই আত্মপ্রবঞনা তাই যে-কোনাে মুহূর্তে বাস্তবের আঘাতে শেষ হয়ে যায়। রাতে বাড়ি ফিরে এইসব ক্ষুধাতুর নিম্নবিত্ত মানুষরা যখন ঠান্ডা ভাতে প্রয়ােজনীয় নুনটুকুও পান না, তখনই তার রাগ চড়ে যায়। আসলে, দারিদ্র্যের জ্বালায় তারা তখন হারিয়ে ফেলে তাদের সহনশীলতার শেষ মাত্রাও। বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম প্রয়ােজনীয়। দ্রব্যটুকু না পাওয়ার রাগই তখন তাদের মাথায় চড়ে বসে।

“করি তাে কার তাতে কী?” -মন্তব্যটির তাৎপর্য লেখাে।

কবি জয় গােস্বামীর নুন’কবিতায় রাত্তিরে বাড়ি ফিরে নিম্নবিত্ত মানুষেরা যখন ঠান্ডা ভাতে প্রয়ােজনীয় নুনটুকুও পায় না, তখনই তাদের মাথায় রাগ চড়ে যায় এবং তারা চিৎকার-স্ট্যাচামেচি করে সারা পাড়া মাথায় করে।

জীবনের দুঃখ, যন্ত্রণা আর অপূর্ণতাকে মেনে নিয়েই চলতে অভ্যস্ত নিম্নবিত্ত জীবন। সেই জীবনে সাধারণ ভাতকাপড়ই যথেষ্ট, রােজ বাজার করাও সেখানে সম্ভব হয় না। অসুখে আর ধারদেনাতে অভ্যস্ত হতে হয় তাদের। দুঃখকে ভুলে থাকার চেষ্টা করা হয় নেশার ঘােরে নিজেকে ডুবিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু সবকিছুকে জোর করে মেনে চলার মধ্যে জীবনে যে আত্মপ্রবঞ্চনা থাকে, এক মুহূর্তেই তা খসে যায় ক্ষুধার্ত মানুষের খিদের যন্ত্রণায়। গভীর রাতে বাড়ি ফিরে এসে ঠান্ডা ভাতে যখন নুনটুকুও থাকে না, তখন ক্রোধকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয় না। মুহূর্তের মধ্যেই শিথিল হয়ে যায় সামাজিক সৌজন্য বা শ্লীলতাবােধ। ফলত, সারা পাড়ায় তখন পৌঁছে যায় তাদের ক্ষোভের বেপরােয়া চিৎকার—“করি তাে কার তাতে কী?” মুহূর্তের ঔদ্ধত্য যেন ভেঙে দেয় এতদিন ধরে সবকিছু মেনে নেওয়ার শােভন প্রয়াসকে। সভ্য সমাজ যে তার আপাত ভদ্রতার শিক্ষা দেয় তার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের মতাে করে ভদ্রলােকের পৃথিবীকে অবজ্ঞা করার দুঃসাহস তখন শােনা যায় এই নিম্নবিত্ত মানুষদের কণ্ঠস্বরে।

“আমরা তাে অল্পে খুশি”— কোন্ প্রসঙ্গে বক্তা এ কথা বলেছেন? এই ‘অল্পে খুশি’ হওয়ার তাৎপর্য কী?

জয় গােস্বামীর ‘নুন’ কবিতায় সাধারণ ভাতকাপড়ে কায়ক্লেশে কোনােপ্রকারে কাটানাে নিম্নবিত্ত জীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকে অসুখ এবং ধারদেনা। অভাব আর অসুখে ভরা জীবনে তার রােজ আহারও জোটে না। এর মধ্যেই ‘হেসে খেলে, কষ্ট করে দিন কাটে নিম্নবিত্ত মানুষের; বলা ভালাে, তারা এভাবেই দিন কাটাতে বাধ্য হয়। এই অল্পে সন্তুষ্ট জীবন কাটানাে প্রসঙ্গেই মন্তব্যটি করা হয়েছে।

সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষদের জীবনে প্রতি পদক্ষেপে যেখানে অনিশ্চয়তা, অভাব আর অসুখ নিত্য সঙ্গী, অল্পে খুশি হওয়াটা সেখানে যেন একটা বাধ্যবাধকতা। “আমরা তাে অল্পে খুশি; কী হবে দুঃখ করে?” -তাদের সামনে দুঃখ থেকে মুক্তির যেহেতু কোনাে পথ নেই, তাই বাধ্য হয়ে নিয়তি বা ভাগ্যকে মেনে নেয় এই অভাবী মানুষরা। ফলে, ‘চলে যাওয়া দিনের এই ‘অল্পে খুশি’হওয়াই তাদের জীবনের অনিবার্য সত্য এবং ভবিতব্য। যদিও এরই সঙ্গে চলতে থাকে যন্ত্রণা ভুলে থাকার চেষ্টাও। তাই রাত্তিরে দু-ভাই মিলে টান দেয় গাঁজাতে। অর্থাৎ এই খুশি যে স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বাভাবিক নয়, তা বােঝা যায় তাদের নেশার ঘােরে ডুবে থাকার মধ্যেই। এইভাবে নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনকে আবরণহীনভাবে তুলে ধরেছেন কবি। অল্পে খুশি’, তাই সেখানে আনন্দের অভিব্যক্তি থাকে আসলে তা হয়ে ওঠে বাস্তবকে মেনে নেওয়া ও তার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার এক হৃদয়বিদারক ইতিহাস।

বাংলা সব প্রশ্ন উত্তর (একাদশ শ্রেণি)

Leave a Comment