আফ্রিকায় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার বিবরণ দাও? এর ফলাফল লেখ?

সূচনা : এশিয়ার মতো আফ্রিকাতেও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ কায়েম হয়। উনিশ শতকের তৃতীয় পাঠ পর্যন্ত ইউরোপীয় বাসীর কাছে প্রায় সমগ্র আফ্রিকায় অজ্ঞাত, অনাবিস্কৃতি ছিল। আফ্রিকা তাদের কাছে ‘অন্ধকারচ্ছন্ন মহাদেশ’ নামে পরিচিত ছিল। উনিশ শতকের শেষারদের বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের মূল আকর্ষণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে আফ্রিকা।

আফ্রিকায় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা

১. পেক্ষাপট

(১) ধর্মপ্রচারক অভিযাত্রীদের প্রচেষ্টা : ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে স্কট, স্পেক, লিভিংস্টোন, স্ট্যানলি, পিটার্স, দিব্রাজা প্রমুখ ধর্ম প্রচারক ও অভিযাত্রীরা আফ্রিকায় আসতে শুরু করেন। তা আফ্রিকায় পা রাখার পর এখানকার বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের কথা জানতে পারে ও স্বদেশে গিয়ে তা প্রচার করেন।

(২) মনরো নীতি : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনরো নীতি ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের প্রয়োগের মাধ্যমে দক্ষিণ আমেরিকাতে ইউরোপীয়দের উপনিবেশ স্থাপন নিষিদ্ধ করে। তাই ইউরোপীয় দেশ গুলি আফ্রিকায় উপনিবেশ গড়ে তোলায় নজর দেয়।

(৩) লিওপোল্ডের উদ্যোগ : বেলজিয়ামরাজ দ্বিতীয় লিওপোল্ড এর উদ্যোগে ও সহায়তায় অভিযাত্রী স্ট্যানলি কঙ্গো অঞ্চল আবিষ্কার করেন। এছাড়াও লিওপোল্ট এর প্রচেষ্টায় ব্রাসেলস শহরে অনুষ্ঠিত ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের এক সম্মেলনে আন্তর্জাতিক আফ্রিকার সংঘর্ষ গঠিত হয় যার উদ্দেশ্য ছিল আফ্রিকায় সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণ ঘটানো।

(৪) বার্লিন সম্মেলন : আফ্রিকায় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে বার্লিন ইউরোপীয় দেশ গুলির এক সম্মেলন বসে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে। এই সম্মেলনে ইউরোপীয় দেশ বলে বিনা সংঘর্ষে নিজেদের মধ্যে আফ্রিকাকে ভাগ করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। এরপরে ইউরোপীয় দেশগুলোর আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল গুলি দখল করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে।

২. বিভিন্ন দেশের উপনিবেশ

(১) প্রথম পর্যায় (১৮০০-১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ) : (i) ওলন্দাজদের উপনিবেশ : ওলন্দাজ বণিক শক্তি বহু আগেই উত্তমাশা অন্তরীপ কেপ কলোনি ও কেপ-অব-গুড-হোপ) দখল করেছিল। প্রথম দিকে আগ্রহী না হলেও পরের দিকে ওলন্দাজরা এখানে বসবাস শুরু করে। পরে ওলন্দাজরা কেপ কলোনি ইংরেজদের বিক্রি করে দিলে তা ব্রিটিশ উপনিবেশ পরিণত হয়। পরবর্তীকালে লিমপোপো নদী পর্যন্ত সুবিস্তিত অঞ্চলে ওলন্দাজদের উপনিবেশ গড়ে উঠি। এই অঞ্চলের মধ্যে ওলন্দাজদের নতুন উপনিবেশগুলি ছিল- নাটাল, অরেঞ্জ নদীর উপত্যকা অঞ্চল এবং ট্রান্সভাল।

(ii) পর্তুগিজদের উপনিবেশ : ব্যবসায়ী বাণিজ্যিক আপেক্ষা লুণ্ঠতরাজের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পরতো গিজরা আফ্রিকায় উপনিবেশ গড়ে তোলে। এই পর্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনটি পর্তুগিজ উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল ‌-গিয়ানা উপকূল, সোফালা এবং অ্যাঙ্গোলা। (iii) ফরাসিদের উপনিবেশ : উনিশ শতকের প্রথম পদে উত্তর আফ্রিকার আলজেরিয়াতে ফরাসিরা প্রথম উপনিবেশ গড়ে তোলে। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে আগে পর্যন্ত স্থানীয় অধিবাসীদের বিরোধীদের কারণে আলজেরিয়ার উপনিবেশ টি ফ্রান্স সম্পূর্ণ ব্যবহার করতে পারেনি।

(২) দ্বিতীয় পর্যায় (১৮৭০-১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে) : (i) বেলজিয়ামের উপনিবেশ : ইতিপূর্বে বেলজিয়ামরাজ দ্বিতীয় লিওপোল্ড -অভিযান শুরু করে। আফ্রিকার কঙ্গো অঞ্চলের আবিষ্কর্তা স্ট্যানলিকে সামনে রেখে বেলজিয়ামে নেতৃত্বে ওই অভিযান প্রচারিত হয়। উপজাতিও নেতাদের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমকে কঙ্গো গঠিত হয় ‘কঙ্গো ফ্রি স্টেট’ । কঙ্গোর এই অঞ্চলে বেলজিয়ামরাজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় (১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে) । (ii) ফ্রান্স উপনিবেশ : এই পর্বের ফ্রান্সে একে একে টিউনিস, চাঁদ (কঙ্গো নদীর দক্ষিণ উপকূলবর্তী অঞ্চল) , সেনেগাল, দাহমীর, গিনি, মরক্কো (উত্তরা আফ্রিকা), মাদাগাস্কার দ্বীপ, সোমালিল্যান্ডের একাংশ, সমগ্র সাহারা এবং কঙ্গো নদী ও আইভরি কষ্টের মধ্যবর্তী অঞ্চল দখল করে নেয়।

(iii) পর্তুগাল উপনিবেশ : আয়তনের বিচারে ছোট হলেও পর্তুগাল ও আফ্রিকার উপনিবেশ দখলের প্রতিযোগিতায় নামে। প্রথমে পর্তুগাল কঙ্গোর দক্ষিণ উপকূলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তারা আফ্রিকার পশ্চিম এবং পূর্ব উপকূলে যথাক্রমে অ্যাঙ্গোলা ও মোজাম্বিক নামে দুই অঞ্চলে দখল নেয়। অ্যাংগুলার নাম হয় পর্তুগিজ পশ্চিম আফ্রিকা, মোজাম্বিকের নাম হয় পর্তুগিজ পূর্ব আফ্রিকা। এই দুই অংশের মধ্যে পর্তুগিজরা যোগসূত্র স্থাপনের উদ্যোগ নিলেও ব্রিটিশ বিরোধিতার কারণে তা সম্ভব হয়নি।

(iii) ইংল্যান্ড উপনিবেশ : আফ্রিকার উত্তরে কায়রো থেকে দক্ষিণে উত্তমাশা অন্তরীপ পর্যন্ত প্রায় সমস্ত স্থান ইংল্যান্ড দখল করে নেয়। ওলন্দাজদের কাছ থেকে কেপ কলোনি কেড়ে নিয়ে তারা উত্তর দিকের নাটাল, অরেঞ্জ এবং ট্রান্সভাল অঞ্চল গুলি দখল নেয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় এই অঞ্চল গুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে ব্রিটিশরা ইউনিয়ন অফ সাউথ আফ্রিকা গঠন করে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তী সময়ে উত্তর মিশর, সুদান, উগান্ডা, বেচুয়ানা ল্যান্ড, রোড এশিয়া ইত্যাদি অঞ্চলের ওপর ইংল্যান্ড নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব আফ্রিকা ছাড়াও জাম্বিয়া, সিয়েরা লিওন, গোল্ড কোস্ট, নাইজেরিয়া ও সোমালি ল্যান্ডের একাংশ ইংল্যান্ডের অধিকারে আসে। আফ্রিকার ব্যবচ্ছেদের পর জিব্রাল্টার, এডেন, সক্রোট্রা, জানজিবার এবং কেপটাউন ইত্যাদি অঞ্চলে ব্রিটিশরা নৌঘাটি নির্মাণ করে পরবর্তীকালে সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকা অধিকার করে ইংল্যান্ড যেখানে শ্বেতাঙ্গ শাসন প্রবর্তন ঘটায়।

(v) জার্মানি উপনিবেশ : আফ্রিকায় উপনিবেশ গড়ে তোলা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জার্মানি ও সামিল হয়েছিল। বিসমার প্রথম দিকে উপনিবেশ স্থাপনে আগ্রহী না হলেও সাম্রাজ্যবাদী, বুঝোয় এবং সরকারি সমর্থন পুষ্ট উপনিবেশবাদী সমিতি (ফ্লোটেন ভিরাইন) চাপে তিনি উপনিবেশবাদী হতে বাধ্য হন এবং বিস্তার নীতি গ্রহণ করেন। তার আমলে জার্মানি একে একে দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা, দক্ষিণ পূর্ব আফ্রিকা, ক্যামেরুন ও টোগোল্যান্ড ইত্যাদি অঞ্চল দখল করেন। (vi) ইতালি উপনিবেশ : ইতালীয় আফ্রিকা উপনিবেশ দখলের লক্ষ্যে উদ্যোগ নেয়। লোহিত সাগরে অবস্থিত ইরিত্রিয়া এবং আফ্রিকার পূর্ব উপকূল উপস্থিত সোমালি এন্ড ইতালি নিজের দখলে আনে। এই দুই উপনিবেশের মধ্যে যোগসূত্র গড়ে তোলা লক্ষ্য ইতালি আবিসিনিয়া দখলের পরিকল্পনা করে।

কিন্তু সেদুয়ার যুদ্ধে পরাজিত হলে ইতালি সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পরবর্তীকালে বেনিটো মুসোলিনি অবশ্য আবিসিনিয়াকে ইতালি সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে তুর্কুশের কাছ থেকে ইতালি ত্রিপল্লী অঞ্চল দখল করে নেন। (vii) স্পেন উপনিবেশ : স্পেন আফ্রিকায় খুব বেশি উপনিবেশের দখল নিতে না পারলে ওই ক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিম উপকূলীয় রিও-ডি-ওরো প্রদেশ এবং জিব্রাল্টারের বিপরীতে আফ্রিকার উপকূলে কয়েকটি স্থানে স্পেন তার উপনিবেশ গড়ে তোলে।

আফ্রিকায় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার ফলাফল

ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির আফ্রিকার ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়ে যেভাবে আফ্রিকাতে বন্টন করে নিয়েছিল তার ফলাফল ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ-

১. ইউরোপীয় সভ্যতার বিস্তার

ইউরোপীয়দের কাছে আফ্রিকা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ। ইউরোপীয় দেশগুলি আফ্রিকার উপনিবেশ গড়ে তোলার পর সেখানে ইউরোপীয় সভ্যতার অনুপ্রবেশ ঘটে। অন্ধকারচ্ছন্ন আফ্রিকা ধীরে ধীরে আধুনিক সভ্যতা সংস্কৃতি আলোক স্পর্শ করে।

২. ভৌমিক অখন্ডতার অবলুপ্তি

উনিশ শতকের শেষবার থেকে শুরু করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত আফ্রিকার প্রায় সমগ্র ভূভাগের ওপর ইউরোপীয়দের আধিপত্য কায়েম হয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আফ্রিকার শতকরা ১০ ভাগ অঞ্চলের ওপর ইউরোপীয়রা নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। কিন্তু পরবর্তী কুড়ি বছরের মধ্যে এই মহাদেশের শতকরা দশ ভাগ অঞ্চল ইউরোপীয় আধিপত্যের বাইরে স্বাধীন অস্তিত্ব ধরে রাখতে সফল হয়েছিল। আবিসিনিয়া, লিবিয়া এবং দক্ষিণের ট্রান্সভাল প্রজাতন্ত্র ছাড়া আফ্রিকার অন্য সমস্ত অঞ্চলগুলি ইউরোপীয়রা দখল করে নেয়।

৩. ইউরোপীয়দের অন্তর্দ্বন্দ

আফ্রিকায় উপনিবেশ দখল কে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় দেশ গুলির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের শুরু হয়। মিশর এবং সুদান দখল কে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে, মরক্কোকে কেন্দ্র করে ফ্রান্স জার্মানির মধ্যে, টিউনিস অঞ্চলের দখল নিয়ে ফ্রান্স ও ইতালির মধ্যে বিবাদ বাদে। এইভাবে আফ্রিকার বিভিন্ন উপনিবেশ দখল কে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল তা পরবর্তীকালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচনা সাহায্য করেছিল।

৪. আফ্রিকার পরাধীনতা

আফ্রিকা জুড়ি ইউরোপীয় উপনিবেশ গড়ে ওঠার আফ্রিকাবাসি স্বাধীনতা হারায়। শুধু তাই নয় এখানকার মানুষদের বন্দি করে নিয়ে গিয়ে ইউরোপ আমেরিকায় বাজারে দাস হিসেবে বিক্রি করা শুরু হয়। সার্বিকভাবে আফ্রিকা ভার্সেস ইউরোপীয়দের নির্মম শোষণ ও অত্যাচারের শিকার হয়।

আফ্রিকার ইউরোপীয় উপনিবেশ সমূহ

ব্রিটিশদের : মিশর, সুদান, কেনিয়া, উগান্ডা, উত্তর ও দক্ষিণ রোডাশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব আফ্রিকা, ইউনিয়ন অফ সাউথ আফ্রিকা, বেচুয়ানাল্যান্ড, উত্তর ও দক্ষিণ নাইজেরিয়া, গোল্ড কোস্ট, সিয়েরা লিয়ন, জাম্বিয়া, জানজিবার, নিয়াসাল্যান্ড, সোয়াজিল্যান্ড, বাসুটোল্যান্ড ও মরিশাস, জিব্রাল্টার, এডেন, সকোট্রা, এবং কেপটাউন।

ফরাসিদের : তিউনিশিয়া, মরক্কো, আলজিরিয়া, ফরাসি পশ্চিম আফ্রিকা, নিরক্ষীয় আফ্রিকা, গিনি, আপার ভল্টা, মাদাগাস্কার, ওকমোরো দ্বীপপুঞ্জ, সেনেগাল, দাহমীর।

পোর্তুগিজদের : পর্তুগিজ গিনি অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, মাদিরা ও সাওটমো দ্বীপ, গিয়ানা উপকূল, শোফালা।

জার্মানিদের : জার্মান পূর্ব আফ্রিকা, টোগোল্যান্ড ও ক্যামেরুন।

ইতালীয়দের : লিবিয়া, ইরিত্রিয়া ও ইতালিয়ান সোমালিল্যান্ড।

বেলজিয়ামবাসীদের : বেলজিয়াম, কঙ্গো, দ্বিতীয় লিওপোল্ড।

স্পেনীয়দের : রিও-ডা-ওরো, স্পেনীয় মারক্কো, স্পেনীয় গিনি, ফার্ন্যান্ডো দ্বীপ, ও ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment