আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করো। অথবা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে কী বোঝ? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য কী?

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে অনেক সময়

আন্তর্জাতিকরাজনীতির সমার্থক বলে মনে করা হয়, এর ফলে বিভ্রাপ্তির সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিখ্যাত লেখক হ্যান্স জে মর্গেনথাউ তাঁর Politics Among Nations গ্রন্থে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বদলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অধ্যাপক পামার ও পারকিনস, হলসটি এবং শ্লেইচার প্রমুখ লেখকরা তা করেননি। তাঁরা মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি দুটি আলাদা বিষয়, তাই এদের মধ্যে পার্থক্যও বিদ্যমান। তা ছাড়া, এঁরা বিশ্বাস করেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির চেয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিধি অনেক ব্যাপক, তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে কখনোই আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত করে দেখা ঠিক নয়। বস্তুত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য রয়েছে।

পাআন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে র্থক্য

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে যেসব পার্থক্য  রয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

[1] আলোচনাক্ষেত্রের পরিধিগত পার্থক্য: পন্ডিতদের   মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির তুলনায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনাগত পরিধি অনেক ব্যাপক। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুধু যে রাষ্ট্রগুলির মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে তাই নয়, অ-রাষ্ট্রীয় (Non-state) সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়েও আলোচনা করে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুধুমাত্র রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে না, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক সম্পর্ক নিয়েও বিচারবিশ্লেষণ করে। অধ্যাপক পামার ও পারকিনসের মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক উভয় ধরনের বিষয় নিয়েই আলোচনা করে। বস্তুত আন্তর্জাতিক রাজনীতি হল রাজনৈতিক সম্পর্কের আলোচ্যসূচির একটি অংশ মাত্র। আন্তর্জাতিক  সম্পর্কের পন্ডিতরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়বস্তুর   পরিধি অত্যন্ত সীমিত।

[2] বিষয়বস্তুগত পার্থক্য: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী তত্ত্বের  প্রবক্তা হ্যান্স জে মর্গেনথাউ আন্তর্জাতিক রাজনীতি বলতে প্রধানত ক্ষমতা লড়াইকে বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি শুধুমা ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিষয়গুলির সঙ্গে জড়িত, ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য ব নতুন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য বিরোধ সংঘর্ষের ধারণা সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অন্যদিকের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধে সহযোগিতামূলক ও প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ক, শত্রুতা ও মিন্নতামূল সম্পর্ক, সংঘর্ষ ও সমন্বয় সব কিছু নিয়েই আলোচনা করে। কাজে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু অনেক ব্যাপক এ কথা বলার অপেঞ্চন রাখে না, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়বস্তু সে তুলনায় যথে  সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে সীমিত।

[3] দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য: আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক  সম্পর্কের দৃষ্টিভঙ্গিজনিত পার্থক্য বিদ্যমান। কে জে হলসটি-র মতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলোচনাকে অনেক সময় পররাষ্ট্র সম্পর্কিত আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়। এখানে মূলত বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতার উপাদান, পারস্পরিক সম্পর্ক ও ক্রিয়াকলাপ প্রভৃতি ওপরে বেশি জোমা দেওয়া হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়টি তা নয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সঙ্গে রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন, যোগাযোগ ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক সংগঠন, বিশ্বযুদ্ধ প্রভৃতি বিষয়গুলি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে আন্তর্জাতিক সমাজের যে পরিচয় মেলে তা আংশিক, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সমকালীন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার একটি সামগ্রিক পরিচয়কে তুলে ধরতে চায়।

Leave a Comment