আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভিন্ন তত্ত্ব
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি গতিশীল বিষয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি ও পরিধি নিয়ত পরিবর্তনশীল। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনাকে কোনো একটি গণ্ডির মধ্যে সীমিত করে রাখা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা যেভাবে দ্রুত বদলে যাচ্ছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্য বিষয়সূচিরও পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই গতিশীল বিষয়কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে, এর খুঁটিনাটি দিকগুলি বিচারবিশ্লেষণ করতে গিয়ে কিছু তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পন্ডিতরা বিভিন্ন তত্ত্বের মাধ্যমে এই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে দেখতে চেয়েছেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষণে যেসব তত্ত্বের পরিচয় পাওয়া যায় তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বগুলি হল- [1] বাস্তববাদ, [2] উদারনীতিবাদ, [3] বহুত্ববাদ, [4] বিশ্ব-ব্যবস্থাজ্ঞাপক মতবাদ।
[1] বাস্তববাদ: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভিন্ন তত্বের মধ্যে বাস্তববা তত্ত্ব সবচেয়ে প্রভাবশালী তত্বরূপে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিশ্লেষণে এই তত্ত্বের সন্ধার কৌটিলা, মেকিয়াভেলি ও হক্সের রচনায় পাওয়া যায়। আধুনিককালে। এইচ কার, হাবাট বাটারফিল্ড, সোয়ার্জেন বার্গার, জর্জ এফ কেরান, মধু রাইট, ফ্রেডারিক সামান, কেনেথ টম্পসন, বারটান্ড রাসেল, হ্যান্স ডে মর্গেনঘাউ প্রমুখের রচনার হাত ধরে এই তত্ত্বের বিকাশ ঘটে। মর্গেনথাউ ইস Politics Among Nations এবং The Decline of Democratic Polite গ্রন্থে এই তত্ত্বের বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক আইনকে লঙ্ঘন করে যাবতীয় শান্তিকামী উদ্যোগকে বিফল করে জাতীয় রাষ্ট্রগুলি কেন আবার একই মহাযুদ্ধে লিপ্ত হল তার বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা দিতে গিয়েই বাস্তববাদী তত্ত্বে জন্ম হয়। ক্ষমতা অর্জন ও ক্ষমতা অনুশীলনের সাহায্যে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করাই হল এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। বাস্তববাদ মনে করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ক্ষমতার লড়াইকে কেন্দ্র কন্ট্রে চালিত হয়। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক বিদ্বেষ, দ্বিচারিতা প্রভৃতি বিষয় মানবপ্রকৃতির মধ্যে দেখা যায়। বাস্তববাদী তত্ত্ব অনুসারে মানব প্রকৃতির মধে নিহিত এই বিধিগুলি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আচরণকেও প্রভাবিত করে। যেমন-বিদেশনীতির বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাষ্ট্রনায়করা মুখে নৈতিকতার কথা বললেও বাস্তবে ভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
বাস্তববাদের প্রধান প্রবক্তা মর্গেনথাউ এই তত্ত্বের ছয়টি মৌলিক নীতির কথা ঘোষণা করেন। এই নীতিগুলি হল-① রাজনীতি বৈষয়িক বিরি দ্বারা চালিত হয়। রাজনীতির সঙ্গে বিষয়-আশয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ② জাতীয় স্বার্থের ধারণা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় স্বার্থের ধারণা ছাড়া আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে অনুসন্ধান করা সম্ভব নয়। ③ জাতীয় স্বার্থের ধারণা কোনো অনড় ধারণা নয়। জাতীয় স্বার্থ কখনো স্থায়ীভাবে চিরকালের জন্য নির্দিষ্ট থাকে না। পরিস্থিতি অনুযায়ী প্র পরিবর্তন ঘটে। রাষ্ট্রের কাজকর্মের মধ্যে কোনো সর্বজনীন নৈতিক ধারণাকে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। বাস্তববাদ মনে করে, রাষ্ট্রীয় নীতিকে বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে, প্রয়োজনে বাস্তবের সঙ্গে আপসও করা যেতে পারে। ⑤ কোনো জাতির নৈতিক আশা-আকাঙ্খাকে সর্বজনীন বলে গণ্য করা যায় না। ক্ষমতাকেন্দ্রিক স্বার্থের ধারণাই প্রধান বিচার্য বিষয়। ⑥ রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারবিবেচনা করে দেখতে হবে।
[2] উদারনীতিবাদ: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের
বিশ্লেষণে উদারনীতিবাদের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে এই তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। উদারনৈতিক আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উদারনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উৎস নিহিত রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উদারনীতিবাগী দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান প্রবক্তা প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯১৯ সালে বিশ্বশান্তির উদ্দেশ্যে পেশ করা উইলসদের ১৪ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে উদারনীতিবাদের তাত্ত্বিক সূচনা ঘটে।
আন্তর্জাতিক উদারনীতিবাদের মূল নীতিগুলি হল-① আন্তর্জাতিক সমাজের বহুজাতিভিত্তিক বাস্তবতাকে স্বীকৃতিদান। ② যুদ্ধ বা যুদ্ধ সংক্রাত প্রস্তুতি বর্জন। ③ বিভিন্ন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকৃতিদান। ④ আন্তর্জাতিক বিবাদের শান্তিপূর্ণ সমাধান ইত্যাদি।
প্রসঙ্গত বলা যায়, উদারনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে উদারনৈতিক আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শ তুলে ধরে, তা ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে চরম সংকটের সম্মুখীন হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশেষত ন্যাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদ এই আদর্শকে সম্পূর্ণরূপে ধবংস করে দেয়। পরবর্তীকালে ১৯৭০-এর দশকে নয়া উদারনীতিবাদের সূচনা ঘটে। তারপর ১৯৯৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নয়া উদারনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ করা হয়।
[3 ] বহুত্ববাদ: আন্তর্জাতিক উদারনীতিবাদের একটি নতুন ধারা হল বহুত্ববাদ। ১৯৭০-এর দশকে বহুত্ববাদ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি মৌলিক তত্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে। বহুত্ববাদ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একক প্রাধান্যের জায়গায় বিভিন্ন ধরনের অ-রাষ্ট্রীয় (Non-state) আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ওপরে পুরুত্ব দেয়। বহুত্ববাদ মনে করে, আধুনিক সমাজে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সব ধরনের কাজকর্ম রাষ্ট্র একা করে উঠতে পারে না, রাষ্ট্রের পক্ষে এককভাবে সব ধরনের প্রয়োজনীয় পরিসেবা দেওয়া সম্ভব নয়। বহুত্ববাদী লেখকদের মতে, আধুনিক আন্তর্জাতিক সমাজে এমন অনেক সমস্যা রয়েছে যার সমাধান রাজনীতিবিদের পক্ষে করে ওঠা দুকর, এর জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞদের। বহুত্ববাদের অন্যতম প্রবক্তা ডেভিড মিক্সানি এবং আর্নস্ট হাস আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে সার্বভৌম রাষ্ট্রের পরিপূরক সত্তা হিসেবে দেখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এই তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা রবাট কেওহেন এবং জোশেফ নাই তাঁদের রচনায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাময়িক রাজনৈতিক দিকের বদলে অর্থনৈতিক সম্পর্কের দিকটির ওপরেই বেশি গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। বহুত্ববাদ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তি বা অতিবৃহৎ শক্তির আধিপতা প্রতিষ্ঠারপরিবর্তে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার দিকটিকেই তুলে ধরতে চায়। বস্তুত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপাদান হিসেবে রাষ্ট্রের পাশাপাশি অ-রাষ্ট্রীয় সংস্থার ভূমিকা গুরুত্ব সহকারে বিশ্লেষণ করাই বহুত্ববাদের মূল উদ্দেশ্য।
[4] বিশ্ব-ব্যবস্থাজ্ঞাপক তত্ত্ব: বিশ্ব-ব্যবস্থাজ্ঞাপক তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা হলেন ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন। এ ছাড়া এই তত্ত্বের সঙ্গে আরও যাঁদের নাম যুক্ত রয়েছে তাঁরা হলেন আন্দ্রে ফ্রাঙ্ক, রউল প্রেবিশ প্রমুখ। মূলত মার্কসবাদের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত এই তত্ত্ব পৃথিবীব্যাপী উন্নয়ন ও অনুন্নয়নের মূল কারণ অনুসন্ধান করতে চায়। এর পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ উদ্ঘাটনেও তাঁদের সমান আগ্রহ।
বিশ্ব-ব্যবস্থাজ্ঞাপক তত্ত্ব মনে করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে ক্ষমতার স্তরবিন্যাস মূলত অর্থনৈতিক কাঠামোর দ্বারাই নির্ধারিত হয়ে থাকে। বিশ্বব্যবস্থা হল-বিশ্ব-অর্থনীতির এক প্রতিভূ মাত্র। আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় অঞ্চল এবং প্রান্তিক অঞ্চলের পাশাপাশি সহাবস্থানের দিকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেন্দ্রীয় অঞ্চলগুলি উন্নত অর্থনৈতিক কাজকর্মের ভরকেন্দ্র। এখানকার শিল্প, পরিসেবা, কৃষি সব কিছুই খুব উন্নত। অন্যদিকে প্রাপ্তিক অঞ্চলগুলি স্বভাবতই অনুন্নত। এদের ভূমিকা কাঁচামাল এবং সম্ভা শ্রম বা শ্রমিক সরবরাহ করা। ওয়ালারস্টাইনের মতে, কেন্দ্রীয় ও প্রান্তিক অঞ্চলের সম্পর্ক প্রধানত শোষণমূলক। তবে বিশ্ব- ব্যবস্থাজ্ঞাপক তত্ত্বের প্রবক্তারা বিশ্বাস করেন, বিশ্বের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা একদিন এমন এক সংকটে এসে দাঁড়াবে যেখানে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলির বিকল্প হিসেবে উঠে আসবে উন্নয়নশীল দুনিয়া। কাজেই বিশ্বব্যবস্থার পুঁজিবাদী কাঠামো চিরস্থায়ী নয়, তার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।