আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
প্রাচীনকাল থেকেই আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনার সন্ধান পাওয়া যায়। চিনের দার্শনিক মেনসিয়াস, মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল এবং ইতালির দার্শনিক মেকিয়াভেলির রচনার কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৬৪৮ সালে জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব, অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে এক তাৎপর্যপু ভূমিকা পালন করে। বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্বত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সাবেকি কূটনীতির দ্বারা পরিচালিত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পর্যালোচনা গুরুত্ব লাভ করে। অবশ্য এ সময় আন্তর্জাতিক ছেলে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনাকে প্রাধান্য দেওয়া হত। বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি স্বতন্ত্র পাঠ্যবিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কোনো সুস্পষ্ট সংজ্ঞা না থাকলে সাধারণভাবে বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল এমন একটি বিষয়। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক, অ-রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানআন্তর্জাতিক সংগঠন, যুদ্ধ ও শান্তি, নিরস্ত্রীকরণ, জোটগঠন, আণবিক সন্ত্রাস-সহ সমগ্র আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ই এইচ কার-এর মতে, দীর্ঘকাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল বিষয় ছিল যুদ্ধ প্রতিরোধের উপায় অনুসন্ধান। লার্কে ও সৈয়দ এই অভিমত পোষণ করেন যে, দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী যুগে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে কূটনৈতিক ইতিহাস বোঝাত। এসময় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ণয়ে কূটনীতিকরা মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন। অনেকে মনে করতেন, আন্তর্জাতিক আইন ও সংগঠনের সাহায্যে যাবতীয় আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে লিগ অব নেশন্স প্রতিষ্ঠার ফলে এই ধারণা মূর্ত হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতির আমূল পটপরিবর্তনের ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির আত্মপ্রকাশ ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (UNO) প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দ্বিমেব্লকরণ (Bi-polarisation) ঘটে। এর ফলশ্রুতিস্বরূপ উদ্ভব হয় ঠান্ডা লড়াই (cold war)-এর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী এই সময়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তত্ত্বগত আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বাস্তবতার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রধান আলোচ্য হয়ে ওঠে। বস্তুত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি সতত পরিবর্তনশীল ও গতিশীল বিষয়। বিগত বিশ শতকের তিনের দশক থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি স্বতন্ত্র পাঠ্যবিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সমাজের পরিবর্তনশীল ধারাকে অনুসরণ করে চলেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিশীল প্রকৃতির দিকে লক্ষ রেখে অনেকে এই অভিমত পোষণ করেন যে, একটি পরিবর্তনশীল পাঠ্যবিষয়রূপে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এখনও এক পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে।
১৯৩৫ সালে স্যার আলফ্রেড জিমার্ন আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অংশ হিসেবে গণ্য করার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু বন্ধু বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি স্বতন্ত্র বিষয়সূচি রয়েছে। বহুকাল ধরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অংশ হিসেবে থাকলেও বর্তমানে তা একটি স্বতন্ত্র বিষয়রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। পামার এবং পারকিনসের মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এমন কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে যা তাকে অন্যান্য বিষয় থেকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। অনেকের মতে, কতকগুলি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলে তবেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে স্বতন্ত্র শাস্ত্রের মর্যাদা দেওয়া যায়। যেমন, একটি নির্দিষ্ট আলোচ্যসূচি (Subject matter) ছাড়াও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি সুস্পষ্ট ধারণা-কাঠামো (Conceptual Framework) থাকা প্রয়োজন। এ ছাড়া একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক সুবিন্যস্ত তাত্ত্বিক ভিত্তি থাকাও আবশ্যক বলে মনে করা হয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিধি
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ধারাবাহিক চর্চা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি নির্দিষ্ট আলোচ্যসূচি তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। তবে এমন একটি গতিশীল বিষয়ের ক্ষেত্রে আলোচ্যসূচির নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কারণ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্যসূচি দ্রুত পরিবর্তনশীল। এ ছাড়া একটি স্বতন্ত্র পাঠ্যবিষয়রূপে গড়ে ওঠার জন্য যে সুস্পষ্ট ধারণা-কাঠামো ও সুবিনান্ত তাত্ত্বিক ভিত্তি থাকা দরকার তা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আছে বলে দাবি করা হয়। আবদুল ও সৈয়দ-এরতে, তত্ত্ব ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অনুধাবন সম্ভব নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে- র পরে কুইনসি রাইট, মটন ক্যাপলান, চার্লস মেকল্যান্ড, কেনেথ উম্পসনপ্রমুখ লেখক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার (International System) তত্ত্বগত আলোচনার সূত্রপাত করেন। তবে ক্রমবর্ধমান জটিলতা এবং পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে কোনো তত্ত্বের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
[1] সাধারণ অনুমান ও বিধি: একটি স্বতন্ত্র বিষয়ের ক্ষেত্রে যেভাবে তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাধারণ অনুমান ও বিধি গড়ে তোলা হয় সেই পদ্ধতিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। কুইনসি রাইট তাঁর The Study of War গ্রন্থে ১৪৮০ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে সংঘটিত ২৭৮টি যুদ্ধ পর্যালোচনার পরে কিছু সাধারণ বিধি ও অনুমান গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পটপরিবর্তনের ফলে তা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। মর্গেনথাউ-এর মতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি দ্রুত পরিবর্তনশীল। এই কারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সাধারণ বিধি ও অনুমানের কার্যকারিতা সম্পর্কে সংশয়ের অবকাশ থেকে যায়। মর্গেনঘাউ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষণে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী। তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে অন্যান্য রাজনীতির মতোই ক্ষমতার লড়াই বলে মনে করেন। তাঁর মতে, “Interna- tional Politics, like all politics, is struggle for power.”। স্ট্যানলি এইচ হস্ম্যান-এর বক্তব্য হল, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সেইসব উপাদান ও কাজকর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যা বিশ্বের মূল একক হিসেবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি ও ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে (“The discipline of Inter- national relations is concerned with the factors and activities which affect the external policies and power of the basic Units into which the World is divided”)|
[2] নয়া বিশ্বব্যবস্থা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক সমাজ এবং রাজনীতি ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হওয়ার ফলে পুরোনো জাতীয় রাষ্ট্র নতুন রাজনৈতিক রূপ নিয়েছে। অসংখ্য অ-রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা বা কারক Non-State Actors) আন্তর্জাতিক সমাজকে প্রভাবিত করে চলেছে। ফলে জাতীয় অর্থনীতির পুনর্বিন্যাস ঘটেছে। জাতীয় রাষ্ট্রের অপ্রতিরোধ্য সার্বভৌম ক্ষমতা বজায় রাখা যাচ্ছে না। স্বেচ্ছায় বা চাপের ফলে রাষ্ট্রগুলি আঞ্চলিক গোষ্ঠী গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে ঠান্ডা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটায় একমুখী বিশ্ব (Unipolar World) গড়ে উঠেছে। নয়া বিশ্বব্যবস্থায় বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (WTO), বিশ্বব্যাংক (World Bank), আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (IMF) প্রভৃতির পৃষ্ঠপোষকতায় বিশ্বায়নের প্রভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলির অর্থনীতির দ্রুত পটপরিবর্তন ঘটে চলেছে। পারমাণবিক যুদ্ধের ভীতি, আণবিক সন্ত্রাস, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, মহাশক্তিধর (Super Power) রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিনি আধিপত্য, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নিষ্ক্রিয়তা ইত্যাদির ফলে জাতীয় রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার সাবেকি সংজ্ঞার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি ও পরিধি এক নতুন সন্ধিক্ষপ পর্বের (Tran- sition Period) সম্মুখীন হয়েছে।
[3] আন্তঃবিজ্ঞানমূলক বিষয়: বর্তমানে কোনো রাষ্ট্র তার পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ করতে গিয়ে শুধুমাত্র নিজের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক অবস্থান তথা সামরিক সামর্থ্যের বিশ্লেষণ করে ক্ষান্ত হয় না। এর পাশাপাশি অন্যান্য রাষ্ট্রের জনমত, মানবসম্পদ, সামরিক সামর্থ্য, প্রাকৃতিক সম্পদ, ভৌগোলিক অবস্থান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার উদ্ভাবন ইত্যাদি বিষয়গুলিও পর্যালোচনা করে দেখে। এই কারণে ওলসন বলেছেন যে,আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে একটি আন্তঃবিজ্ঞানমূলক (Inter-disciplinary) বিষয়রূপে গণ্য করা উচিত। সিসিল ডি ক্ল্যাব-এর মতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ব, গণিতশাস্ত্র, পরিসংখ্যান, নৃতত্ব এবং যোগাযোগ বিজ্ঞানের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করে বিষয়টিকে সমৃদ্ধ করেছেন। বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষণা অন্যান্য বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষণায় অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানের অবদান থাকলেও রাজনৈতিক উপাদানের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ভৌতবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা বা রসায়নবিদ্যার মতো প্রকৃত বিজ্ঞানের মর্যাদা লাভ না করলেও এটিকে নিঃসংশয়ে একটি গতিশীল সামাজিক বিজ্ঞানরূপে অভিহিত করা যায়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পাঠ্য বিষয়সূচি অনড় নয়। প্রকৃতিগত দিক থেকে এ কথা বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা দ্রুত পরিবর্তনশীল। আর এই পরিবর্তনশীলতার নিরিখেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি ও পরিধি নির্ধারিত হতে পারে।