অক্ষয়কুমার বড়াল, দেবেন্দ্রনাথ সেন, গােবিন্দদাস ও কামিনী রায়ের কবিপ্রতিভা
পুরাণ-ইতিহাস মন্থন করে তার সঙ্গে বিদেশি কাব্যের ভাববস্তুর মিশ্রণে মহাকাব্য ও আখ্যায়িকা কাব্য রচনার যে ব্যাপক প্রয়াস উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ জুড়ে চলছিল বিহারীলালের মন্ময় লিরিক কবিতায় তার অবসান সূচিত হল। অন্তর্মুখী ভাবপ্রেরণাতেও যে উৎকৃষ্ট কাব্য রচনা করা যায় বিহারীলাল তা দৃষ্টান্ত দ্বারা প্রমাণ করে দেন। বৃহত্তর পাঠক-সমাজে বিহারীলালের ব্যাপক পরিচিতি ছিল না ঠিকই, কিন্তু সমসাময়িক কবি-সমাজে তার কবিতার নতুন সুর গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সেই প্রভাব বিস্তৃত। পরে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে বাঙলা কাব্যে রবীন্দ্রনাথের একচ্ছত্র প্রতিষ্ঠা অবিসংবাদিত হয়ে ওঠে। তার প্রথম পরিণত কাব্য ‘মানসী’ প্রকাশিত হয় ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দে, সোনার তরী ১৮৯৪ খ্রীষ্টাব্দে। বিহারীলাল থেকে রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পূর্ববর্তী কাল বলতে যে সময়সীমার প্রতি এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে তা তারিখের হিসাবে নির্দিষ্ট করে দেওয়া সম্ভব নয়। খুব শিথিলভাবে উনবিংশ শতাব্দীর অষ্টম দশকের মধ্যভাগ থেকে শেষ দশকের মাঝামাঝি- অর্থাৎ ‘সােনার তরী’ প্রকাশ পর্যন্ত এই পর্বটির সীমা নির্দেশ করা যায়। এই সময়ে বাঙলা কাব্যে এক নতুন অধ্যায়ের সুস্পষ্ট সূচনা হয়। যাদের কাব্যসৃষ্টিতে আধুনিক বাঙলা কবিতায় এই নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় তাঁরা বয়সের দিক থেকে সকলেই রবীন্দ্র-সমসাময়িক হলেও রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থেকে মুক্ত এবং স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কবি। রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন এই কালের কয়েকজন প্রধান কবির কাব্যপ্রকৃতিই এখানে আলােচিত হবে।
(ক) অক্ষয়কুমার বড়াল (১৮৬০-১৯১৮) -এর কাব্যগুলির নাম ‘প্রদীপ’ (১২৯০ বঙ্গাব্দ), ‘কনকাঞ্জলি’ (১২৯২), ‘ভুল’ (১২৯৪), ‘শঙ্খ’ (১৩১৭) এবং ‘এষা’ (১৩১৯)। কবি অক্ষয় বড়াল বিহারীলালের কাব্যপদ্ধতিকে অনুসরণ করলেও তার সাহিত্যগুরুর প্রভাব অনেকটা পরিমাণই অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। সুকুমার সেন যথার্থই বলেছেন- “অক্ষয়কুমারের ভাবােচ্ছাস সংযত এবং বিষয়বস্তু সংহত ও স্পষ্টতর। গুরুর আনন্দমগ্নতার কোন রেশ শিষ্যের রচনায় নাই। তবে গুরুর রচনাশৈথিল্যও নাই।” বয়সে রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক হলেও অক্ষয়কুমার কবিতায় রবীন্দ্রনাথের দ্বারাও কিছুটা প্রভাবিত হয়েছেন। প্রেমই তাঁর কাব্যের প্রধান বিষয়। সংসার-বন্ধনের স্থূলতা থেকে মুক্ত থেকে এক স্নিগ্ধ প্রশান্ত হৃদয়ানুভূতিরূপে পত্নী-প্রেম তাঁর কাব্যে প্রকাশিত হয়েছে। ‘ভুল’, ‘কনকাঞ্জলি’ প্রভৃতি প্রথম দিকের কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিতে দেখা যায় “আপনারই হৃদগত কামনার ও তাহারই চির-অতৃপ্ত পিপাসার বিগ্রহরূপে এক মানসী-প্রতিমা তাহার কবিস্বপ্ন আচ্ছন্ন করিয়াছে।” কবির এই মনােভাব ভাষা পায়—
“পড়ে আছি নদী-কূলে শ্যামদূর্বাদলে-
কি যেন মদিরা পানে
কি যেন প্রেমের গান
কি যেন নারীর রূপে ছেয়েছে সকলে।”
প্রভৃতি চরণে। এই অতি-মর্ত্য-প্রেমভাবনা, কবির ব্যক্তিগত জীবনের এক শােকাবহ ঘটনায় বাস্তব জগতের সঙ্গে সামঞ্জস্যে মিলিত হয়ে অভিনব রূপে দেখা দেয় তার ‘এষা’ কাব্যে। ‘এষা’ কবি- পত্নীর মৃত্যুজনিত শােকগাথা। যে প্রেম ও সৌন্দর্য অধরারূপে চরাচরে ব্যাপ্ত দেখেছিলেন শােকানুভূতি-বিদ্ধ হৃদয়ে সেই প্রেমকেই কবি আপন পত্নীর ভালােবাসার সীমার মধ্যে মূর্তরূপে উপলব্ধি করলেন। এই নতুন উপলব্ধির সঙ্গে মিশ্রিত হল মৃত্যুজনিত রহস্যবােধ। দুঃসহ শােকই মিলনসূত্ররূপে কবির রােমান্টিক প্রেম-কল্পনাকে বাস্তব সংসারে প্রত্যক্ষতার সীমার সঙ্গে মিলিয়ে দিল। ‘এষা’ কাব্যের মুখবন্ধে কবি লিখেছেন—
“নহে কল্পনার লীলা—স্বরগ নরক;
বাস্তব জগৎ এই মর্মান্তিক ব্যথা।
নহে ছন্দ, ভাববন্ধ বাক্য রসাত্মক;
মানবীর তরে কাদি, যাচি না দেবতা।”
‘এষা’ ই অক্ষয়কুমারের শ্রেষ্ঠতম কাব্যগ্রন্থ এবং বাঙলা গীতিকাব্যে এই গ্রন্থ একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সংযােজন। আবেগের প্রবলতা কবিকে বাইরে চঞ্চল করেনি, হৃদয়কে গভীরভাবে ভাবমগ্ন করেছে এবং তাঁর রচনায় প্রকাশ পেয়েছে নারীপ্রেমের স্নিগ্ধ শান্ত রূপএটাই অক্ষয়কুমারের রচনার বৈশিষ্ট্য। সংলাপের একটি কবিতায় দেখা যায়, ভাবাবেগের আলােড়ন শাস্ত হয়ে এলে এবং অচরিতার্থতার বেদনা জুড়িয়ে গেলে প্রশান্তির প্রলেপে নারীর মহিমা নতুন রসরূপে দেখা দেয়—
“আমার পরাণ ভাসিয়া যায়, পড়ে তা উছলি।
কেন এক মহাকাব্য হয়ে ওতপ্রােত!…
হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়ে এস, সখি তবে;
রূপ-বনে প্রেম-কাব্য মিশাই নীরবে।”
রবীন্দ্রনাথের মত অক্ষয়কুমারও ছিলেন ব্রাউনিং-এর ভক্ত পাঠক, তার কাব্যে ব্রাউনিং এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সংযত ও পরিমিত ভাষা, শব্দচয়ন ও পদলালিত্যের সঙ্গে ভাবগাম্ভীর্যের সমন্বয় তার রচনাশৈলীর বৈশিষ্ট্য। ডঃ সুকুমার সেন এইভাবে-দেবেন্দ্রনাথ সেন ও গােবিন্দচন্দ্র দাসের সঙ্গে অক্ষয়কুমার বড়ালের তুলনা করেছেনঃ “দেবেন্দ্রনাথ সেনের সঙ্গেও অক্ষয়কুমারের মিল আছে, সে হইল গার্হস্থ্য প্রেমে। উভয়েরই কাব্যস্ফৃর্তির উৎস বাল্যপ্রেম। তবে দেবেন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতা ঘরের সীমানায় ঘেরা, আর অক্ষয়কুমারের কাব্যলক্ষ্মী অন্তঃপুরবাসিনী হয়েও অবরােধের বাহিরে বিচরণশীলা। ভগবদ্ভক্তির প্রকাশও উভয়ের কবিতার একটা সমান ধর্ম (তবে সে প্রকাশের মাত্রা বিভিন্ন)। গােবিন্দচন্দ্র দাস ও অক্ষয়কুমারের মধ্যে সাধ পাইতেছি, ভাবাবেগের তীব্রতায়। গােবিন্দদাসের আবেগ passionate বাসনাবিল; অক্ষয়কুমারের আবেগ ইন্টেলেকচুয়াল, ভাবনা-উদ্বেল। এই কারণে একই ভাবের কবিতায় অক্ষয়কুমার যতটা সার্থক হইয়াছেন গােবিন্দচন্দ্র ততটা নন। অথচ অনুভূতির বাস্তবতা ও তীব্রতা গােবিন্দচন্দ্রের কবিতায় যতটা প্রত্যক্ষ অক্ষয়কুমারের কবিতায় ততটা নয়। দুইজনেই নারীরূপের উপাসক। একজন চাহেন নারীরূপকে ইন্দ্রিয়বাঁধনে ধরিয়া উপভােগ করিতে, অপরজন চাহেন সে রূপমাধুরী ধ্যানকল্পনায় অনুভব করিতে।” গােবিন্দচন্দ্র জোর গলায় বলেন, “আমি ভালবাসি অস্থিমাংসসহ”, আর অক্ষয়কুমার স্বপ্ন দেখেন, “কি যেন নারীর রূপ ছেয়েছে সকলে।” দুজনেই স্ত্রীবিয়ােগের পর তাদের স্মৃতি-কাব্য লিখেছিলেন।
(খ)
“প্রকৃতি সাথে হয় কবিচিত্ত বিনিময়;
সংসার বােঝে না সেই জীবন্ত স্বপন,
ওই আঁখির মিলন।”
উপরে উদ্ধৃত চরণ কয়েকটিতে দেবেন্দ্রনাথ সেন (১৮৪৫-১৯২০)-এর কবি-প্রকৃতির বিশিষ্টতার পরিচয় আছে। দেবেন্দ্রনাথ বিশেষভাবে রূপ-পিপাসিত কবি। বিমূর্ত সৌন্দর্যবােধের প্রতি তার আকর্ষণ নেই, তিনি সৌন্দর্যকে পেতে চান ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আস্বাদ্যমান রূপে, নির্দিষ্ট আকারের সীমায় মূর্তিবদ্ধ সৌন্দর্যের প্রতিই তার একাগ্র আকর্ষণ। তাই বার বার তার কবিতায় আঁখির মিলনের কথা পাই। মােহিতলালের কথায়, “তাঁহার প্রতিভা আত্মমুগ্ধ; তিনি আপন হৃদয়ের স্বতােৎসারিত ভাব-নির্বরিণীর মধ্যে আপনাকে মুক্তি দিবার চেষ্টা করিয়াছেন; আপনার অন্তরে যে স্পর্শমণি পাইয়াছেন তাহার স্পর্শে জগৎ জীবনকে সােনায় সােনা করিতে চাহিয়াছেন; তিনি পঞ্চেন্দ্রিয়ের পঞ্চদীপ জ্বালিয়া অনাবিল প্রীতির মন্ত্রে সৌন্দর্যলক্ষ্মীর আরাধনা করিয়াছেন কোনপ্রকার চিন্তা বা বিচারকে তিনি সে পূজাগৃহে পদক্ষেপ করিতে দেন নাই। বিহারীলালের ধ্যান ছিল, দেবেন্দ্রনাথের কেবল আরতি। এই সৌন্দর্যমুগ্ধ কবির সৌন্দর্যসাধনায় একটি নতুন দিক ফুটিয়াছে-নয়ন ও হৃদয়, এই দুইয়ের পরিচর্যায় সর্বেন্দ্রিয়ের উল্লাসব্যঞ্জক এক নূতন কাব্যকলার উদ্ভব হইয়াছে।” আত্মপরিচয় প্রসঙ্গে কবি ঠিকই বলিয়াছেন—
“চিরদিন চিরদিন রূপের পূজারী আমি
রূপের পূজারী।”
দেবেন্দ্রনাথের অধিকাংশ কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ‘ভারতী’, ‘সাহিত্য’, ‘প্রবাসী’ প্রভৃতি তৎকালীন শ্রেষ্ঠ সাময়িকপত্রে। তাঁর কাব্যসংকলনগুলির মধ্যে বিখ্যাত ‘অলােকগুচ্ছ’ (১৩০৭), ‘গােলাপগুচ্ছ’, ‘পারিজাতগুচ্ছ’, ‘শেফালীগুচ্ছ’ এবং ‘অপূর্ব নৈবেদ্য’।
কবিজীবনের প্রথমে দেবেন্দ্রনাথ যে মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, তার পরিচয় মেলে তার ‘উর্মিলা কাব্য’ ও অসমাপ্ত ‘দশানন বধ’ কবিতায়। তাঁর কাব্যভাষায় শেষ পর্যন্ত এই প্রভাবের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। তার ফুলবালা কবিতাগুলিতে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবও চোখে পড়। কোনও কোনও সমালােচকের মতে দেবেন্দ্রনাথের রচনাশৈলীতে মধুসূদনের রীতি ও বিহারীলালের রীতি সম্মিলিত হয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ ভাবুক হলেও বিহারীলালের মত আত্মহারা নন, তাঁর কবিতার বিষয়ও বিশুদ্ধ ভাবনির্ভর ও বস্তুভারবর্জিত নয়। স্বাভাবিকভাবেই নারীপ্রেমের বিচিত্র প্রকাশ দেবেন্দ্রনাথের কাব্যে বেশি স্থান পেয়েছে। পরবর্তীকালে বাৎসল্যকেও প্রাধান্য পেতে দেখা যায়।
দাম্পত্যপ্রেম, বাৎসল্যপ্রীতি ও ভগবদভাবএই তিনদিকেই দেবেন্দ্রনাথের সহজাত প্রবণতা। নিপীড়িত ও বঞ্চিতদের প্রতি কবি হৃদয়ের সমবেদনা প্রবাহিত হয়েছে। সনেট-রচনায় দেবেন্দ্রনাথ যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দান করেছেন। বাক্যবন্ধ, ভাষা-আদি ব্যবহারে তিনি প্রধানতঃ মধুসূদনেরই অনুসরণ করেছে। দেবেন্দ্রনাথের সনেটে মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথের প্রভাব-সত্ত্বেও মৌলিকতার পরিচয় মেলে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা দেবেন্দ্রনাথের যে কত প্রিয় ছিল, রবীন্দ্রবাবুর সনেট কবিতায় তার প্রমাণ মেলে। প্রিয়তমার প্রতি সহজ সরল আবেগে ও রস-মাধুর্যে মনােমুগ্ধকর—
‘নয়নে নয়নে কথা ভাল নাহি লাগে,
আধ গ্লাস জল যেন নিদাঘের কালে;
চারিধারে গুরুজন; চল অন্তরালে;
দোহার হিয়ার মাঝে কি অতৃপ্তি জাগে।’
সুকুমার সেনকে অনুসরণ করে আমরা বলতে পারি, নব্য রােমান্টিক কবিদের মধ্যে দেবেন্দ্রনাথ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি গার্হস্থ-কবি, বাঙালি মেয়ের ঘরােয়া রূপ-সজ্জা, তার প্রেমসেবার সৌরভ কবিচিত্তকে সর্বদাই আবিষ্ট করে রেখেছে এবং সেইজন্য কবির কল্পনাও সর্বত্র নারীরশৈশব সঙ্গিনীর ও প্রিয়ার সঙ্গসুখ বিচিত্রভাবে অনুভব করে ফিরেছে। দেবেন্দ্রনাথের কবিতায় ফুলের সমারােহ ও দোপাটি, বনতুলসী, গুলে-কোওলি, সদা সােহাগিন, হর-শিঙ্গার ইত্যাদি কবিপ্রসিদ্ধিহীন ফুলগুলিকেও তিনি তার কবিতায় পরম সমাদরে স্থান দিয়েছেন। দেবেন্দ্রনাথের রচনা-বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “..রােমান্টিক ভাবস্বর্গ, আবেগের বন্যা-প্রবাহ, না পাওয়ায় প্রচণ্ড হাহাকার, প্রেমের তীব্র আসক্তি -এ সমস্ত চিরাচরিত রোমান্টিক প্রকরণের পাশ কাটিয়ে দেবেন্দ্রনাথ সহজ জীবনের পরিচিত সুর ধরেছিলেন বলেই আজও তাকে আমরা যেন আমাদের কালের কবি বলে মনে করি।”
(গ) গােবিন্দচন্দ্র দাস (১৮৫৫-১৯১৮) জন্মগ্রহণ করেছিলেন পূর্ববঙ্গে, সেখানেই তার জীবন অতিবাহিত হয়েছিল। ইংরেজি শিক্ষার সুযােগ তিনি পাননি। আধুনিক সাহিত্যচর্চার প্রধান কেন্দ্র কলিকাতার সঙ্গেও তার কোনও যােগাযােগ ছিল না। তবু তাঁর রচনায় আধুনিক ব্যক্তিত্ববােধের প্রবল শক্তিদীপ্ত প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তিগত জীবনে গােবিন্দচন্দ্র প্রভূত অশান্তি-উপদ্রব ভােগ করেছিলেন, তাকে প্রতিকূল অদৃষ্টের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে অবিরাম। কিন্তু তিনি অবসন্ন হয়ে কোনও শক্তির কাছেই মাথা নত করেননি,তাঁর কবিতাও তার সেই পৌরুষে দীপ্ত। অবশ্য কবির নিদারুণ ক্ষোভ কোনও কোনও কবিতায় আগ্নেয় জ্বালায় প্রকাশিত হয়, কিন্তু তাতে তার কাব্য রচনা বাধাগ্রস্ত হয়নি। বরং তার ফলে তার কবিতার রস ও রূপ এক বিশেষ স্বাতন্ত্র লাভ করেছে। রােমান্টিক কল্পলােকের সুষমা, সৌন্দর্যের অপ্রাকৃত কান্তি, প্রেমের দেহাতীত বােধের কৃত্রিমতা থেকে গােবিন্দচন্দ্রই বাংলা কবিতাকে রক্তমাংসের বাস্তব উষ্ণতা দান করেছেন।
গােবিন্দচন্দ্রের কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ‘প্রসূন’ (আনুমানিক ১৮৭০ খ্রীঃ), ‘প্রেম ও ফুল’ (১৮৮৮), ‘কুঙ্কুম’ (১৮৯২), ‘চন্দন’ (১৮৯৬), ‘ফুলরেণু’ (১৮৯৬), ‘কস্তুরী’ (১৩০২ বঙ্গাব্দ), ‘বৈজয়ন্তী’ (১৩১৩ বঙ্গাব্দ)। কাব্যরীতির দিক থেকে দেবেন্দ্রনাথ সেনের সঙ্গে তার সাদৃশ্য ও বৈপরীত্য দুই-ই দেখা যায়। দুজনেরই বিষয় প্রেম, বিশেষতঃ দাম্পত্য-প্রেম। দেবেন্দ্রনাথের কবিত্ব পত্নীত্বের আদর্শকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে এবং প্রেমের রসমাধুর্যেই তার প্রেম কবিতার ব্যঞ্জনা পরিস্ফুট। গােবিন্দচন্দ্রের কবিত্ব তাঁর যৌবনসঙ্গিনী পত্নীর প্রেমকে কেন্দ্র করে যৌবন প্রেমস্বপ্নের স্মৃতিপথেই প্রবাহিত হয়েছিল। কিন্তু তাঁর কবিতায় প্রেমের প্রকাশ সম্পূর্ণরূপে পত্নীকেন্দ্রিক নয় এবং তার মধ্যে দেহের আকর্ষণ অত্যন্ত স্পষ্ট। গােবিন্দচন্দ্র তাঁর দেহচেতনাকে অকুণ্ঠিতভাবেই ব্যক্ত করেন—
“আমি এরে ভালবাসি অস্থিমাংসসহ।
আমি ও নারীর রূপে,
আমি ও মাংসের স্তুপে,
কামনার কমনীয় কেলি কালীদহ”
এই তীব্র নিরাবরণ ইন্দ্রিয়চেতনার দৃপ্ত প্রকাশ বাঙলা কাব্যসাহিত্যে অভিনব। এখানেই সমসাময়িক কবিদের মধ্যে গােবিন্দদাসের প্রখর স্বাতন্ত্র্য। প্রেমের এই দুর্নিবার আবেগতীব্রতার কাছে সবকিছুই তুচ্ছ, অবাস্তব—
“বিশাল ব্রহ্মাণ্ড হয় তােক স্বপ্নময়,
সে আমি অনন্ত সত্য অনাদি অব্যয়’।”
গােবিন্দচন্দ্র দাসের প্রতিভা ছিল, অনুভূতিতেও গভীরতা ছিল, তার কাব্যের পশ্চাৎপটে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতায় দুঃখবহনের প্রচণ্গুতা অনুভব করা যায়। কিন্তু কাব্যপ্রকরণে অনেক সময়ই ভাবের অসংযম ও ভাষার শিথিলতা চোখে পড়ে। সনেট রচনায় তার ব্যর্থতা সবথেকে বেশি পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়। কোথাও কোথাও অবশ্য ভাবের ও ভাষার লালিত্য তাঁর রঁচনাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে—
“বহিছে শীতল বায়ু—পরাণ পাতিয়া,
জানিনা, কেমন ঘুমন্তভাবে আছি দাঁড়াইয়া।
সেই চুল, সেই ফুল, সে দাড়িম্ব শির,
সেই শ্যাম-অঙ্গে বিলসিত কম্পিত সমীর।”
পূর্ববঙ্গবাসী গােবিন্দদাসের কবিতায় পূর্ববঙ্গের বিশেষ আবহাওয়ার প্রতিফলন এবং কথনভঙ্গি বিশেষ ধরনের বাস্তবরস সৃষ্টি করেছে, যেমন এই অংশে—
“ধুইয়া দিয়াছে চুল খৈল-গিলা দিয়া,
পেছন দুয়ারে বসি রউদে শুকায়,
পউষের নীলানীল’ বাতাস আসিয়া
এলাইয়া মেলাইয়া পলাইয়া যায়?”
পর্বতের বর্ণনায় কবি যে চিত্রকল্প গড়ে তােলেন ‘আকাশে হেলান দিয়ে ঘুমায় পর্বত’ কিংবা ‘সাগরের উক্তি’ কবিতায় কবি-হৃদয় যে সাগর-মূর্তি ধারণ করে—
‘হৃদয়ে লুকান মাের কি যে সে বিপ্লব ঘাের
প্রলয়ের ধ্বংসমূর্তি গ্রামে চরাচর।’
তাতে কবির শক্তিমত্তারই পরিচয় পাওয়া যায়। স্বদেশ স্বদেশ করিস কারে এ দেশ তােদের নয়’—স্বদেশী যুগে বহুশ্রুত এই দেশপ্রেমাত্মক এই কবিতাটি গােবিন্দদাসেরই রচনা। কবি-কৃতি বিষয়ে অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, “গােবিন্দচন্দ্র দাস সহজাত কবিত্বপ্রতিভার জন্য ‘স্বভাবকবি’ নামেই বিখ্যাত হয়েছিলেন। প্রয়ােজনীয় শিক্ষার অভাবে তার কাব্যে অনেক সময় মার্জিত রুচির অভাব লক্ষ্য করা যায় এবং শিল্পনৈপুণ্যের ত্রুটিও তার কাব্যকে শিষ্টসমাজে প্রবেশের পক্ষে বাধার সৃষ্টি করেছিল। তাঁর কাব্যের এই দুটি টিকে বাদ গিলে এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে গােবিন্দদাসের কাব্যের সুর এতাবৎ বাঙলা সাহিত্যে ছিল অশ্রুত এবং পরবর্তীকালেও অপর কোন কবি এমন আবেগপুত, দেহাশ্রিত ইন্দ্রিয়ধর্মী প্রেমের কবিতা বাঙলা সাহিত্যকে উপহার দিতে পারেন নি।… বাঙলা ভাষায় এমন আবেগ-তাড়িত, উন্মাদনা-মথিত, প্যাশন’-পূর্ণ কবিতা আর কখনাে লিখিত হয়নি। শিক্ষার অভাব, দারিদ্র্যের কশাঘাত এবং ভাগ্যের লাঞ্ছনা তাকে কখনাে সংযত হতে দেয়নি, তাই তাঁর অন্তরের আকুলতা এমন অকুণ্ঠ অভিব্যক্তি লাভ করেছে। প্রধানতঃ এ-জাতীয় প্রেমের কবিতার জন্যই গােবিন্দ দাসের এত সুখ্যাতি বা অখ্যাতি হলেও প্রকৃতি এবং স্বদেশপ্রেমও তাঁর কাব্যে যথাযােগ্য মর্যাদা লাভ করেছে।”
(ঘ) উনিশ শতকের মহিলা কবিদের মধ্যে কামিনী রায় (১৮৫৪-১৯৩৩) সর্বাপেক্ষা বিশিষ্ট। বালিকা বয়স থেকে জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত তিনি কাব্য রচনায় ব্ৰতী ছিলেন। তার কাব্যসাধনার ধারা হেমচন্দ্রের যুগ থেকে রবীন্দ্রযুগ পর্যন্ত বিস্তৃত। কামিনী রায় কবি-হিসেবে প্রথমে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতিলাভ করেছিলেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ আলাে ও ছায়া (১৮৮৯) হেমচন্দ্রের লিখিত ভূমিকাসহ প্রকাশিত হয়েছিল। সমসাময়িক কবিদের মধ্যে কামিনী রায়ই রবীন্দ্রনাথের দ্বারা সর্বাধিক পরিমাণে প্রভাবিত হয়েছিলেন। পূর্ববর্তী কাব্যধারার সঙ্গেও তাঁর যােগ ছিল। কামিনীর কবিদৃষ্টি আত্মগত হলেও বাইরের জগতের প্রতি উদাসীন, কিংবা বিহারীলালের মত আত্মভাববিভাের অথবা অক্ষয়কুমার বড়ালের মত ভাব তন্ময় নয়। তার কবিতায় বিষয়নিষ্ঠা, নীতিচিন্তা ও উপদেশে পূর্বগামী কবিদের রচনাধারার সঙ্গে যােগ লক্ষ্য করা যায়। কবির ভাষা পরিমিত ও সংযত তবে ছন্দে বৈচিত্র্য ও সঙ্গীতময়তার অভাব।
কামিনী রায়ের রচনায় নারী হৃদয়ের প্রকাশ যতটা ঐকান্তিক, এমনটি ইতিপূর্বে কোন মহিলা- কবির রচনায় দেখা যায় না। দৈব-হত অথবা প্রিয়-বিড়ম্বিত নারী-প্রেমের সশঙ্ক কুণ্ঠা এবং ব্যক্তিনিরপেক্ষ আত্মলােপী নিঃস্বার্থতা ইহার কাব্যের বিশিষ্ট সুর’, এই সুর বৈষ্ণব কবিতার মত, কিন্তু কামিনী রায়ের রচনায় আরও ব্যক্তিগত, আধুনিক জীবনবােধে অভিষিক্ত—
“হয় হােক্ প্রিয়তম,
অনন্ত জীবনসম
অন্ধকারময়,
তােমার পথের পরে
অনন্ত কালের তরে
আলাে যদি রয়।”
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আলােছায়া’র অধিকাংশ কবিতায় প্রথম প্রেমের ভীরুতা ও বিচ্ছেদ-কাতরতা রূপায়িত। ‘মহাশ্বেতা’ ও ‘পুণ্ডরীক’ নামে যে দুটি দীর্ঘ কবিতা আছে, তাদের মধ্যে ভাব ও রচনার গাঢ়তা পরিস্ফুট। সংস্কৃত সাহিত্যের চরিত্র আশ্রয়ে কাব্যরচনা এই প্রথম। দ্বিতীয় গ্রন্থ মাল্য ‘নির্মাল্য’-এ (১৩২০ সাল) কবির প্রথম জীবনে লেখা কয়েকটি কবিতা স্থান পেয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট। অধিকাংশ কবিতায় পাই ‘ঔদাসীন্য প্রত্যাখ্যাত ও আশাহত নারীহৃদয়ের মৃদু অভিমান অনুযােগ ও আত্মবিলােপের সুর’—
“তােমার কণ্ঠের স্বর, তব দৃষ্টিখানি,
মনে হয়, আমি যেন চিরদিন জানি,
আশা হল তােমা হতে ভাল করে পাব
আপনার পরিচয়…”
‘একদিনের ছুটিতে’ কবি এই আশা প্রকাশ করেছেন, সমাজ সংস্কারের বাইরে ঈশ্বরের স্নেহদৃষ্টির অধীনে সব অভিমান ভুল বােঝাবুঝির অবসানে প্রিয়ের সঙ্গে তার মিলন হবে বাধাহীন।
কামিনী রায়ের অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ ‘পৌরাণিকী’ (১৩০৪ বঙ্গাব্দ), ‘গুঞ্জন’ (১৩১১ বঙ্গাব্দ), ‘অশােক-সঙ্গীত’ (১৯১৪ খ্রীঃ), ‘দীপ ও ধূপ’ (১৯২৯) ও ‘জীবনপথে’ (১৯৩০)। একটি ক্ষুদ্র নাটিকা ‘একলব্য’ এবং দুটি ‘ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি দ্রোণ’ ও ‘রামের প্রতি অহল্যা’ পৌরাণিকীতে স্থান পেয়েছে। ‘অশােক সঙ্গীত’ ও ‘জীবনপথে’ সনেট সংকলন। ‘দীপ ও ধূপে’র কয়েকটি কবিতায় অসহযােগ আন্দোলনের প্রতি কবির সহানুভূতির প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। জীবনপথের প্রথমাংশে প্রণয়স্মৃতিচারণা এবং দ্বিতীয় অংশে বিরহের আশ্রয়হীনতার বিষাদ চিত্রিত। ডঃ সুকুমার সেন বলেছেন- “কামিনী রায়ের কবিতার ভাষা সরল, সংযত এবং পরিমিত। ভাবের ও ভাষার সংযম ও শালীনতা ইহার রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। হৃদয়-দ্বন্দ্বের মধ্যে নৈতিক এবং বৃহত্তর আদর্শের সঙ্গীত অন্বেষণ ইহার কবিতার মর্মকথা। ইহাই কবির নারীহৃদয়ের আসল পরিচিতি। পৌরাণিক কাহিনীর প্রতি কবির যে বিশেষ আকর্ষণ ছিল তাহা পৈতৃক।”