আধুনিক গণনাট্য আন্দোলনে ও গণনাট্য রচনায় বিজন ভট্টাচার্যের স্থান
বিজন ভট্টাচার্য (১৯১৭-১৯৭৮) বাঙলা নাট্যজগতে গণনাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি অত্যুৎকৃষ্ট রূপক-প্রতীক জাতীয় নাটক থাকা সত্ত্বেও বাঙলা নাট্যজগৎ যখন ঐতিহাসিক, পৌরাণিক এবং পারিবারিক-সামাজিক নাটকের ঘূর্ণাবর্তে কেবলি ঘুরপাক খেয়ে আবিল করে তুলেছিল পারিপার্শ্বিক জগৎকে, বিজন ভট্টাচার্যের আবির্ভাব তখন সেখানে যেন এক ঝলক মুক্তির হাওয়া নিয়ে এলাে। এতকাল বাংলা নাটক উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত সমাজের বহির্বর্তী বৃহত্তর জন-জীবনকে প্রায় স্পর্শ করতে পারেনি, গণনাট্য-আন্দোলনের মুখপত্রূপে বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ ই (১৯৪৪) সর্বপ্রথম গণ-জীবনের সঙ্গে নাটককে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করলাে। এই বিচারে বাঙলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে বিজন ভট্টাচার্যের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে অবশ্যই সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি জানাতে হবে। বস্তুত বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটক বাংলা নাটকের প্রচলিত ধারার আমূল পরিবর্তন সাধন করেছিল।
বিজন ভট্টাচার্যের নাট্যকৃতির আলােচনা-প্রসঙ্গে ‘গণনাট্য আন্দোলন’ বিষয়ে কিছুটা জ্ঞান থাকা আবশ্যক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অল্প পূর্বে ১৯৩৬ খ্রীঃ ‘ভারতীয় প্রগতি লেখক সঙ্ঘ’ প্রতিষ্ঠিত হলে প্রগতিবাদী বিশেষভাবে মার্ক্সবাদী লেখকগণ তাকে কেন্দ্র করে গােষ্ঠীবদ্ধ হতে থাকেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন সােভিয়েট রাশিয়াও যুক্ত হয়ে পড়ে, তখন মার্ক্সবাদী লেখকগণ ফ্যাসিস্ট-বিরােধী লেখক ও শিল্পীসঙ্ঘ গঠন করে জনযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠনে সচেষ্ট হন। তাদেরই প্রবর্তনায় বিজন ভট্টাচার্যের ‘আগুন’ (১৯৪৩) ও ‘জবানবন্দী’ (১৯৪৩) নাটিকাদ্বয় রচিত হয়; প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে উক্ত ফ্যাসি-বিরােধী লেখক ও শিল্পীসঘই নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে জন-সংযােগ করবার উদ্দেশ্যে ‘গণনাট্য সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সংগঠিতভাবে বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ (১৯৪৪) নাটক অভিনয়ের মধ্য দিয়েই গণনাট্য আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। যে পরিবেশে এবং সামাজিক প্রয়ােজনে বাঙলাদেশে এসময় একটা নবনাট্য আন্দোলন দেখা দিয়েছিল, সে বিষয়ে ডঃ অজিত ঘােষ বলেন “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব হইতেই সাধারণ নাট্যশালায় অবসাদ ও অবক্ষয়ের লক্ষণ প্রকটিত হইয়া উঠিল। ওই সব নাট্যশালা যে সব অসাধারণ অভিনেতা তাঁদের অদ্বিতীয় অভিনয় গুণে বাঁচাইয়া রাখিয়াছিলেন তাহাদের কেহ কেহ পরলােক গমন করিলেন। কেহ কেহ বা রঙ্গমঞ্চ হইতে সাময়িকভাবে অবসর লইলেন। তাহাদের অভাবে রঙ্গমঞ্চের আকর্ষণ একেবারে কমিয়া গেল।..সমাজের অবস্থা দ্রুত পরিবর্তন হইতেছিল।…নাট্যশালাকে পুনরুজ্জীবিত করিয়া তুলিতে পারে এমন কোন বলিষ্ঠ ভাবাশ্রয়ী উদ্দীপনাজনক নাটকও তখন রচিত হইতেছিল না। এইসব নানা কারণে সাধারণ নাট্যশালার অবস্থা তখন শােচনীয় হইয়া উঠিয়াছিল। নাটক ও মঞ্চকে বাঁচাইবার জন্য সাধারণ নাট্যশালার বাইরে তখন নবজীবনবাদী ও অদম্য উৎসাহী একদল নাট্যামােদী যুবকের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় নবনাট্য আন্দোলন গড়িয়া উঠিল।”
ফরিদপুর জেলার একটি গ্রামে জন্ম হলেও পিতার কর্মসূত্রে তার সঙ্গে বিজন বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চলেই ঘুরেছেন। অতঃপর পড়াশােনার জন্যই ১৯৩০ সাল থেকে কলকাতায় থাকতে আরম্ভ করেন। এখানে তিনি প্রথমে ছাত্র-রাজনীতি এবং পরে বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। বিজনের প্রথম সাহিত্য রচনা প্রচেষ্টা শুরু হয় ছােটগল্প ‘জলসা’ (১৯৩৯-৪৬) দিয়ে। তিনি আর কোন ছােটগল্প রচনা করেন নি বলেই মনে হয়। তবে তিনি তিনখানি উপন্যাস রচনা করেছিলেন- ‘জনপদ’ (১৯৪৫), ‘রাণী পালঙ্ক’ (১৯৫৯), ‘সােনালী মাছ’ (১৯৬০-৬২)। এ সব কথাসাহিত্য রচনা-সত্ত্বেও বিজন ভট্টাচার্য প্রধানতঃ নাট্যকার-রূপেই পরিচিত ছিলেন। কথাটা আর একটু স্পষ্টতর করে বলা যায়, নাট্যজগতের যাবতীয় দিকের সঙ্গেই তিনি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি একজন উচ্চমানের অভিনেতা ছিলেন এবং তার সে কৃতিত্ব শুধু মঞ্চেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি চলচ্চিত্র-অভিনয়েও যথেষ্ট পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন; বিজন নাট্যশিক্ষক ছিলেন এবং একজন উত্তম সংগঠকও ছিলেন। মতভেদের দরুণ তিনি গণনাট্য সংঘ ত্যাগ করে ১৯৫১ খ্রীঃ ‘ক্যালকাটা থিয়েটার্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭০ সালে তিনি আবার ‘কবচ-কুণ্ডল’ নামক নাট্যদল স্থাপন করেন। এ ছাড়াও অপর কাহিনীর নাট্যরূপ দান করে কিংবা আপন নাটক সম্পাদনা করে সেগুলি মঞ্চস্থ করেন। বস্তুতঃ বিজন ভট্টাচার্য বাঙলাদেশে যে নাট্য আন্দোলন সৃষ্টি করেন, তারি ফল-স্বরূপ আজ এত গ্রুপ থিয়েটারের সমৃদ্ধি।
বিজন ভট্টাচার্য রচিত নাটকের সংখ্যা অন্ততঃ ২৫/২৬টি। তার মধ্যে যেমন একাঙ্কিকা আছে, তেমনি রয়েছে পূর্ণাঙ্গ নাটক, আছে গীতিনাট্য এবং রূপক নাট্য। আবার এর মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের গল্পের নাট্যরূপ (‘মাস্টার মশাই’ ও ‘গুপ্তধন’) এবং একাঙ্ক নাটকের সম্প্রসারণে পূর্ণাঙ্গ নাটক (‘কলঙ্ক’>’দেবীগর্জন’)। বিজনের নাটক সম্বন্ধে আরও একটি উল্লেখযােগ্য জ্ঞাতব্য বিষয় এই যে, তার রচিত সমস্ত নাটক কিন্তু গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। কোন কোনটি শুধু সাময়িকপত্রের পৃষ্ঠায়ই আত্মগােপন করে আছে, আবার কোনটির ভাগ্যে তা-ও জোটেনি, সেগুলি শুধু মঞ্চেই অভিনীত হয়েছে। যাহােক, নিম্নে তার রচিত নাটকগুলির নাম ও রচনাকাল উল্লেখ করা হলাে।
১. ‘আগুন’ (একাঙ্ক—১৯৪৩), ২. ‘জবানবন্দী’ (একাঙ্ক—১৯৪৩), ৩. ‘নবান্ন’ (পূর্ণাঙ্গ- ১৯৪৪), ৪. ‘অবরােধ’ (পূর্ণাঙ্গ-১৯৪৬-৪৭), ৫. ‘জীয়নকন্যা’ (গীতিনাট্য-১৯৪৫-৪৭), ৬. ‘মরাচাদ’ (একাঙ্ক-১৯৪৬-৪৮), ৭. ‘কলঙ্ক’ (একাঙ্ক—১৯৫০-৫১), ৮. ‘জননেতা’ (একাঙ্ক- ১৯৫০), ৯. ‘জতুগৃহ’ (পূর্ণাঙ্গ—১৯৫১), ১০. ‘গােত্রান্তর’ (পূর্ণাঙ্গ-১৯৫৬-৫৭), ১১. ‘মরাচাদ’ (পূর্ণাঙ্গ-১৯৬০), ১২. ‘ছায়াপথ’ (পূর্ণাঙ্গ-১৯৬১), ১৩. ‘মাস্টারমশাই’ (পূর্ণাঙ্গ—১৯৬১), ১৪. ‘দেবীগর্জন’ (পূর্ণাঙ্গ-১৯৬৬-৬৯), ১৫. ‘ধর্মগােলা’ (পূর্ণাঙ্গ-১৯৬৭), ১৬. ‘কৃষ্ণপক্ষ’ (পূর্ণাঙ্গ ১৯৬৬), ১৭. ‘সাপ্নিক’ (একাঙ্ক-১৯৬৮), ১৮. ‘গর্ভবতী জননী’ (পূর্ণাঙ্গ-১৯৬৯-৭১), ১৯. ‘স্বর্ণকুম্ভ’ (রূপক নাট্য—১৯৭০), ২০. ‘আজ বসন্ত’ (পূর্ণাঙ্গ-১৯৭০), ২১. ‘লাস ঘুইর্যা যাউক’ (একাঙ্ক—১৯৭০), ২২. ‘সােনার বাংলা’ (পূর্ণাঙ্গ-১৯৭১), ২৩. ‘গুপ্তধন’ (পূর্ণাঙ্গ-১৯৭২), ২৪. ‘চলাে সাগরে’ (পূর্ণাঙ্গ-১৯৭০-৭২), ২৫. ‘চুল্লী’ (একাঙ্ক-১৯৭২-৭৪), ২৬. ‘ইাঁসখালির হাঁস’ (একাঙ্ক-১৯৭৪-৭৭)।
বিজন ভট্টাচার্যের নাটক রচনার পশ্চাতে কোন সাহিত্য-প্রেরণা সদ্যসক্রিয় ছিল, এমন নয়; স্পষ্টতঃই তিনি একটা বিশেষ ভাবাদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যেই সমসাময়িক কালের কিছু সমস্যামূলক কাহিনী অবলম্বন করে নাটক রচনা ও মঞ্চস্থ করে জনগণের সামনে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। এতকাল আমাদের নাটকে শিক্ষিত, ভদ্র, বিত্তবান সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রারই রূপায়ণ ঘটতে দীর্ঘকাল পূর্বের দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ’ বা তৎ-জাতীয় কিছু নাটক ব্যতিক্রম-বূপেই গণ্য হতাে। বিজন ভট্টাচার্যের নাটকে এতকালের অবহেলিত সমাজের বিভিন্ন স্তরের শ্রমজীবী মানুষরাই তাদের জীবনের বিচিত্র সমস্যা ও সঙ্কট নিয়ে পাদপ্রদীপের আলােতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেন এককথায়, এতকালের অবহেলিত শােষিত সাধারণ মানবজীবন—শুধু যে তাদের সব বঞ্চনা ও শােষণ নিয়ে মঞ্চে হাজির হলো তা নয়, তারা নতুন করে বাঁচবার প্রেরণাও লাভ করলাে। তাই নতুন সমাজব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে নাটকের রূপায়ণেও কিছুটা পরিবর্তন আনতে হলাে।
জনৈক সমালােচকের ভাষায়, “বিষয়বস্তুর এই নতুনত্ব সে যুগে সাদরে গৃহীত হলাে আর আঙ্গিকের ক্ষেত্রে বাঙলা নাটকের গতানুগতিক মঞ্চউপস্থাপনা ও প্রয়ােগ পরিকল্পনার একঘেয়েমি দুর হল। মঞ্চ ব্যবস্থা, আলাে, সাজ, রূপসজ্জা, অভিনয় সবকিছুর মধ্যে সাযুজ্য আনা হল, মঞ্চ- ব্যবস্থার সরলীকরণ হল, ব্যক্তি-অভিনয়ের পরিবর্তে দলগত অভিনয়, সবকিছুর মধ্যে নাট্যনির্দেশকের পরিকল্পনা বিষয় ও আঙ্গিককে বেঁধে নিয়ে মূল ভাবপ্রকাশের সহযােগী করে তুলতে সাহায্য করল।”
বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’, ‘দেবীগর্জন’ প্রভৃতি কোন কোন নাটক বিশেষ মঞ্চসাফল্য ও জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও সাধারণভাবে বলা যায় যে, ‘আগুন’ বা ‘জবানবন্দী’ থেকে শুরু করে ‘হাঁসখালির হাঁস’ পর্যন্ত সব নাটকেই মূলত একই ভাবাদর্শ বিভিন্ন কুশীলবের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বত্রই তিনি গণচেতনা সঞ্চারে উদ্যোগী, সর্বত্রই তাঁর নিপীড়িত মানুষের প্রতি সহানুভূতি। নবান্ন নাটকে তিনি মেদিনীপুরের গ্রামাঞ্চলের অধিবাসীদের নিয়েছেন পাত্র- পাত্রীবৃপে, ‘কলঙ্ক’ নাটকে নিয়েছেন বাঁকুড়া জেলার সাঁওতাল-জীবনের কাহিনী, আবার গােত্রান্তর নাটকের চরিত্র হলাে পূর্ববাঙলার ছিন্নমূল উদ্বাস্তুরা। ‘অবরােধ’ নাটকে পাওয়া যাচ্ছে শ্রমিকদের উপর মালিকদের অত্যাচার কাহিনী, আর ‘দেবী-গর্জনে’ রয়েছে গ্রামীণ কৃষকের উপর জোতদারের জবরদস্তি চালানাের ইতিহাস। সর্বত্রই একশ্রেণীর মানুষের পাশব প্রবৃত্তি কীভাবে স্বার্থসিদ্ধির প্রেরণায় অপরকে সর্বস্বান্ত করে পথের ভিখারিতে পরিণত করে, কঠোর দারিদ্র্যের সুযােগ নিয়ে তাদের একেবারেই সর্বহারায় পরিণত করে, সেই বঞ্চনার, অত্যাচারের ইতিহাসই নাট্যকার সংবেদনশীল দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছেন। তবে নাট্যকার হতাশাবাদী নন, সর্বত্রই তিনি প্রতিবাদকে, প্রতিরােধকে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিয়েছেন, যার ফলে গণচেতনায় উদ্বুদ্ধ প্রয়াস যে জয়যুক্ত হবে, তেমন একটা আশার আলাের আভাস পাওয়া যায়। যেমন নবান্ন নাটকে তিনি কেবল অবক্ষয় এবং বিপর্যয়ের ছবিই আঁকেন নি, চতুর্থ অঙ্কের দুটি দৃশ্যে সুখ- স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতীকরূপে নবান্ন উৎসব’টি উপস্থাপিত করেছেন।
নবনাট্য আন্দোলনের নাটকগুলি নানাদিক থেকেই পূর্ববর্তী ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন বলেই প্রতিটি নাটকের গঠন কৌশল, নির্মাণ-রীতি, চরিত্র-পরিকল্পনা প্রভৃতি দিক থেকেই স্বতন্ত্র। শিল্প কৌশলের বিচারে এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য বিশেষ গুণ হয়তাে পাওয়া যাবে না, কারণ সাময়িকতার প্রয়ােজনেই বিশেষ উদ্দেশ্য, বিশেষ ভাবাদর্শ-প্রচারের হাতিয়ার রূপেই এদের সৃষ্টি। বলা বাহুল্য, বিজন ভট্টাচার্যের নাটকগুলি সম্বন্ধেও এই অভিমতই সর্বদা প্রযােজ্য।