সূচনা : একজন ইতিহাসবিদ যে সমস্ত নিয়ম নিতে আদর্শ ও পদ্ধতি মেনে তার ইতিহাস রচনা করে থাকেন, তাহলে ইতিহাস তত্ত্ব। আধুনিক ইতিহাস তত্ত্ব বলতে আমরা অষ্টাদশ শতক থেকে শুরু করে ২০ শতকের শেষ দশক সময়কাল পর্যন্ত ইতিহাস চর্চাকে বুঝে থাকি। সবাই এখনও সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস বিষয়ে বস্তু বৈচিত্র্য ও ব্যাপকতা, বিশ্লেষণের ধারায়, নিত্য নতুন তথ্যের সমারোহা এবং যুক্তিবাদী বিজ্ঞান ধর্মী অনেক ত্রুটিমুক্ত, সুগঠিত ও আধুনিক রুপে পেয়েছে। এই দীর্ঘ প্রায় ৩০০ বছরের ইতিহাস চর্চা বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের আলোকে সমুজ্জল হয়ে উঠেছে। ইতিহাসের বিষয়বস্তু আজ আগে তুলনায় অনেক ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী। ঐতিহাসিক পদ্ধতি আজ আর একমুখী নয় তা হলো বহুমুখী।
আধুনিক ইতিহাস তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য সমূহ
১. জাতীয়তাবাদ
বিশ্বের প্রতিটি দেশে ঐতিহাসিকদের লেখায় জাতীয়তাবাদের ছাপ স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। বিভিন্ন দেশের ইতিহাস গুলিতে নিজ নিজ দেশের ঐতিহ্য ও শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। আমেরিকায় স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লব, রুশো বিপ্লব বিভিন্ন ইউরোপীয় রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটায়। এই জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্বুদ্ধ হয়ে ইতিহাসবিদ গোবিনর জোসেফ আর্য জাতির, চার্লস কিংসলি টিইটনিক জাতির, মরিসবার গল জাতির, আর. কিপলিং স্যাক্রন জাতীয় শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেন। ভারতীয় ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র দত্ত তিন খন্ডে লেখেন ‘প্রাচীন ভারতের সভ্যতার ইতিহাস’ , যা হলো ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নির্দেশন।
২. যুক্তিবাদ
আধুনিক ইতিহাস তত্ত্বের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো যুক্তিবাদ। আধুনিকতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের স্থলে আসে যুক্তিবাদ মানুষের অন্তরে সমালোচনা মূলক ও প্রকৃতিবাদী দর্শনের জন্ম হয়। মানুষ বুঝতে শেখে কোন কিছু বিশ্বাস করার আগে তাকে যুক্তিবাদের কুষ্ঠি পাথরে যাচাই করে নেওয়া উচিত। মানুষের এই যুক্তি নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গিকে কাজে লাগিয়ে ঐতিহাসিকগঞ্জ যুক্তিভিত্তিক ইতিহাস রচনায় প্রয়াসী হন। চর্চায় ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাকে এড়িয়ে গিয়ে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকে পাস কাটিয়ে চর্চায় ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাকে এড়িয়ে গিয়ে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকে পাস কাটিয়ে ঐতিহাসিক তাদের ইতিহাসের বিষয় হিসেবে মানবীয় কর্মকাণ্ডের বৃহত্তম পরিষদ বেছে নেন। যুক্তিবাদী ঐতিহাসিকগণ স্থান-কাল-চরিত্র নির্বিশেষে যুক্তিবাদের আলোকে তথ্যসূত্র গুলি বিচার করে সেগুলি ইতিহাসের প্রয়োগ করে থাকেন। ঐতিহাসিক ঘটনার পিছনে সক্রিয় প্রাকৃতিক কারণ উদঘাটন যুক্তিবাদী ইতিহাস চর্চার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
৩. প্রগতির ধারণা
আধুনিক ইতিহাস চর্চায় যুক্তি রয়েছে প্রগতির ধারণা। আধুনিক ইতিহাসে নতুন ব্যাখা হলো মানুষ ক্রমশ পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলেছে। ইতিহাসে প্রগতির ধারা নিরবিচ্ছিন্ন নয়, তাতে উত্থান যেমন আছে, পতনও তেমন আছে। ইতিহাসের প্রগতির আসল অর্থ হলো মানুষের ক্ষমতা ও সম্ভাবনার বিপুল বিস্তার। উনিশ শতকের ইংল্যান্ডের ধনসম্পদ ও প্রভাব প্রতিপত্তি বুদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের প্রগতির ধারণা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক গিবসন ধারায় ব্যাখ্যায় বলেন প্রতিটি যুগেই মানুষের সম্পদ, শক্তি, জ্ঞান বুদ্ধি পাচ্ছে। ইতিহাসের প্রগতির ধারনায় অতীত, বর্তমানে ভবিষ্যৎ একই শৃংখলে আবদ্ধ। ইতিহাসের ঘটনা ও মূল্যবোধ উভয় প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে প্রগতির উদ্ভব ঘটে।
৪. দৃষ্টিবাত
রোমান্টিক ভাব ধরার প্রতিক্রিয়া হিসেবে উদ্ভব ঘটে বৃষ্টি বাদে ইতিহাস দর্শনের। রোমান্টিক পর্ব ইতিহাসের যে সমস্ত ব্যাখ্যা দেয়া হয়, সেগুলি যথেষ্ট তথ্য নির্ভর ছিল না। দৃষ্টিবাদী দর্শনের প্রবক্তা আগস্ট কোঁৎ সমাজের বিশ্লেষণে বৈজ্ঞানিক নিয়ম রীতি প্রয়োগের কথা বলেন। দৃষ্টি বাদী পদ্ধতি মেনে ঐতিহাসিককে দুটি কাজ করতে হয়, যথা ঐতিহাসিক তথ্য আবিষ্কার ও ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রের দ্বারা ঘটনার ব্যাখ্যা দেন। দৃষ্টিবাদী দর্শন দ্বারা ঐতিহাসিক ছোট ছোট বিষয় কেন্দ্রিক সমালোচনা মূলক ইতিহাস রচনা করে থাকেন।
৫. অবয়ববাদ ও উত্তর অবয়ববাদ
বিশ্ব সভ্যতার জন্ম লগ্ন থেকে সাহিত্য, শিল্প সংস্কৃতি, ধর্মনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ভাবনা-চিন্তাগুলোই ধীরে ধীরে অবয়বের রূপ নিয়েছে। অবয়ববাদ হলো আসলে প্রথাগত ও আচরণগত ঐতিহ্যের উপর নির্ভরশীল মানব ইতিহাস। ঐতিহাসিক ধারনায় অবয়বের পরিবর্তন ঘটলে বিষয়বস্তুর ও পরিবর্তন ঘটে। অবয়ব পারিস সমর্থকরা মনে করেন ইতিহাসের সত্যকে সম্পূর্ণরূপে পাওয়া যায় না, কোন সত্য সদা অধরা থাকে। বিশ্ব জননীতা, ঐক্য, মুক্তি প্রভৃতির ভিত্তিতে উত্তর অব্যয়
৬. আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতা
আধুনিকতা শব্দ নিয়ে আসলে আপেক্ষিক, কেননা প্রতিটি প্রজন্মের কাছে নিজের যুক্তি আধুনিক বলে মনে হয়। রেনেসাঁস যুগের মানুষেরা নিজেও যুক্তি আধুনিক আখ্যা দিয়েছিলেন আবার আজকের যুগকে আমরা আধুনিক যুগ আখ্যা দিই। প্রকৃত অর্থ সব দেশে, সব যুগের আধুনিকতার চরিত্র ও মানবদণ্ড আলাদা আলাদা হয়। এই বিচারে ঐতিহাসিক কে তার আধুনিকতার স্বরূপ বর্ণনা করতে হয়। আধুনিকতার বিচারে ঐতিহাসিক যাকে সত্য বলে ধরে নেন উত্তর আধুনিকতাই তা আংশিক সত্য বা অতি কথা হিসেবে বিবেচিত হয়।
৭. আপেক্ষিকতাবাদ
ইতিহাসের তথ্যসূত্র গুলি কখনোই চিরসত্য নয়, নতুন যুগে, নতুন দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে তথ্যসূত্রের শত্রুতা আপেক্ষিক বলে প্রমাণিত হয়। আপেক্ষিকতাবাদে দুটি বৈশিষ্ট্য, প্রথমটি হলো-ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অনুসন্ধান ; দ্বিতীয় টি হল- বর্তমানে প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী ইতিহাসের রচনা। এই মতবাদ অনুযায়ী ইতিহাসের বিষয়বস্তুর গুরুত্ব, সময়ের গুরুত্ব, ঘটনার পরিণতির গুরুত্ব সবই আপেক্ষিক।
৮. বিজ্ঞানধর্মিতা ও নৈতিকতাবাদ
সাম্প্রতিক ইতিহাস চর্চায় বিজ্ঞানসম্মতভাবে তথ্যসূত্র সংগ্রহ করে ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানের যেরকম পরীক্ষা, অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের দ্বারা সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করা হয়, ইতিহাসেও একই রকম ভাবে বিষয়বস্তুর উদঘাটন সত্যতার কাছাকাছি পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়। ইতিহাসের সঙ্গে নৈতিকতার ও সম্বন্ধ রয়েছে। ইতিহাসে নৈতিক মূল্যবোধের কষ্ঠি পাথরের ঐতিহাসিক চরিত্র ও ঘটনাবলীর বিচার করা হয়।