সাম্প্রদায়িক বিভেদ বৃদ্ধি
খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় হিন্দু মুসলিম সম্প্রতি শক্তিশালী হয়। অসহযোগ আন্দোলন অংশ নিয়ে কিছু আন্দোলনকারী উত্তরপ্রদেশের চৌরিচৌরায় বেশ কিছু পুলিশকে পুড়িয়ে মারলে পাঁচ ফেব্রুয়ারি, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। এদিকে তুরস্কের খিলাফৎ লুপ্ত হলে ভারতে খিলাফত আন্দোলন থেমে যায়। ফলে হিন্দু মুসলিম সম্প্রতির স্থাপনের চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং পুনরায় উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ বাড়তে শুরু করে, যেমন-
১. মুসলিম নেতৃত্বের দূরত্ব
খিলাফৎ আন্দোলন বন্ধের আবুল কালাম আজাদ ছাড়া সকল খিলাফৎ নেতারাই গান্ধীজিকে ত্যাগ করেন। একটি গান্ধীজীর ঘনিষ্ঠ মুসলিম নেতা মৌলানা মোহাম্মদ আলী ও মৌলোনা সৌকত আলী প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে, তারা প্রথমে মুসলিম, পরে ভারতীয়। মুসলিম নেতারা তানজিম ও তাবলীগ আন্দোলন শুরু করে নিজেদের সংগঠন লোকসংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধিতে মন দেয়।
২. হিন্দু নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িকতা
হিন্দুদের নেতৃত্বাধীন হিন্দু মহাসভা এই সময় মুসলিম লীগের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়মিত বিরোধিতা করতে থাকে। হিন্দু নেতারা শুদ্ধি আন্দোলনের মাধ্যমে নিজের সংগঠন ও সম্প্রদায়ের শক্তি মনোনিবেশী করে। এই সময় হিন্দু মহাসভা ছাড়া আর্য সমাজ, ভারত ধর্ম মন্ডল, পাঞ্জাব হিন্দু সভা প্রভৃতি সংগঠন বলে নতুন করে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
৩. সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় পরস্পরের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। ইন্ধনের ফলে বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধে যায়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মালাবার, পেশোয়ার, কলকাতা, নোয়াখালী, ত্রিপুরা, বিহারসহ বিভিন্ন স্থান এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বহু মানুষের মৃত্যু হয়। শুধু উনিশশো তেইশ খ্রিস্টাব থেকে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ৭২ টি সম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়।
৪. লিগের লাহোর অধিবেশন
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিতে মুসলিম লীগে অধিবেশন ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজীর অসহযোগ নীতির তীব্র বিরোধিতা এবং মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি করা হয়। ভারতের সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার জন্য লিক যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং বাংলা, পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদর্শন আইনসভায় মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠা বজায় রাখার দাবি জানায়। এই সময় থেকে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ঐক্য বিনষ্ট হয় এবং লীগ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে সরে এসে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে রাজনৈতিক দাবী দাওয়া আদায়ের চেষ্টা করে।
৫. সাইমন কমিশন
ভারতের নতুন সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশন গঠন করলে জাতীয় কংগ্রেস ও আংশিক মুসলিম লীগ এই কমিশনের বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু লীগের পাঞ্জাব গোষ্ঠী নামে পরিচিত মোহাম্মদ শফি, ফিরোজ খাঁ নুন, ফজলী হোসেন, মোহাম্মদ ইকবাল প্রমুখ মুসলিম নেতা সাইমন কমিশনকে স্বাগত জানান। ফলে কংগ্রেসের সঙ্গে এই নেতাদের বিভেদ বৃদ্ধি পায়।
৬. নেহেরু রিপোর্ট
মতিলাল নেহেরু নেতৃত্বে গঠিত একটি সর্বদলীয় কমিটি ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে আগস্ট মাসে লক্ষ্ণৌ পেশ করেন। এটি নেহেরু রিপোর্ট নামে পরিচিত। কিন্তু ওই বছর ২২ ডিসেম্বরের কলকাতা সর্বদলীয় অধিবেশন জিন্না লীগের জন্য কিছু বিশেষ সুবিধা দাবী করলে তা নাকচ হয়। ফলে তিনি অনুগামীদের নিয়ে অধিবেশন ত্যাগ করে মোহাম্মদ ইকবাল, আগা খাঁ প্রমুখ প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিত হন। এইভাবে লীগের ঐক্য ফিরে এলে লীগের শক্তি বৃদ্ধি পায়।
৭. অন্যান্য মুসলিম সংগঠন
অসহযোগ আন্দোলনের পরবর্তীকালে বেশ কয়েকটি নতুন মুসলিম সংগঠন গড়ে ওঠে। মোহাম্মদ আলী জিন্না ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম সম্মেলনের যোগ দিলে এই শক্তি বৃদ্ধি পায়। এছাড়া জাতীয়তাবাদের মুসলিম দল ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে, কংগ্রেস মুসলিম দল ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে প্রভৃতি গড়ে ওঠে। এই সময় আলী ভ্রাতৃদ্বয় কানপুরে ‘জমিয়াৎ-ই-উলেমা-ই-হিন্দি নামে একটি তীব্র কংগ্রেস বিরোধী সংগঠন করে তোলে।
৮. জিন্নার ভূমিকা
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে লীগের অধিবেশনের জিন না ভারতের মুসলিমদের স্বার্থে চোদ্দ দফা দাবি পেশ করে। এতে মুসলিমদের মধ্যে পৃথক নির্বাচনের দাবিসহ বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাবি জানানো হয়। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনের লীগের ভরাডুবির পর ওই বছর লীগের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে জিন্না কংগ্রেস শাসনকে হিন্দু শাসনের নামান্তর বলে ঘোষণা করেন এবং হিন্দু আধিপত্যের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তিনি সর্বশ্রেনীর মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় ডাক দেন। এভাবে ভারতের সাম্প্রদায়িকতার পারদ আর ঊর্ধ্বমুখী হয়।
৯. সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামসে ম্যাকডোনাল্ড ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা নীতি ঘোষণা করে মুসলিম, ভারতীয় খ্রিষ্টান, শিখ, হরিজন, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রভৃতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। এর ফলে মুসলিম সম্প্রদায়িক রাজনীতি জয় এবং ভারতের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি জটিলতা বৃদ্ধি পায়।
১০. লাহোর প্রস্তাব
বিখ্যাত উর্দু কবি ও লীগ নেতা মোহাম্মদ ইকবাল ১৯৩০ খ্রিস্টাব থেকে মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তোলেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড, খাকসার বাহিনীসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন গড়ে ওঠে। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে লীগের অধিবেশন বাংলা প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক পৃথক পাকিস্তানের দাবি করে বলেন যে, ভারতে হিন্দু মুসলিম দুটি জাতি আছে দুটি সম্প্রদায় নয়। এজন্য মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক সর্বভৌম রাষ্ট্র প্রয়োজন।
১১. প্রত্যক্ষ সংগ্রাম
প্রধান মিশনে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে প্রস্তাব অনুসারে বড়লাট লর্ড ওয়াভেল কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহেরু কে মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানান। এতে জিন্না ও মুসলিম লীগ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। তারা এই সরকারের জোক না দিয়ে পৃথক পাকিস্তানের দাবিতে সোচ্চার হয়। পৃথক পাকিস্তান আদায় এর উদ্দেশ্যে তারা সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু করে। এতে কলকাতা পাঁচ দিন ধরে ১৬ থেকে ২০ আগস্ট ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ব্যাপক দাঙ্গা, লুন্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড চলে।
উপসংহার
প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ঘটনায় কলকাতা ভয়াবহ হত্যা লীলার পর একে একে নোয়াখালী, ত্রিপুরা ও বিহার প্রভৃতি স্থানে ব্যাপক সম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস প্রথম শাড়ির নেতৃবৃন্দ গান্ধীজিকে বোঝান যে, এই পরিস্থিতিতে থেকে মুক্তি পেতে ভারত বিভাজন ও পৃথক পাকিস্তান সৃষ্টি একমাত্র পথ। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে গান্ধীজি ও এই প্রস্তাব মেনে নিলে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে দেশের দ্বিখন্ডিত হয়।