অনেকে ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতাটিকে চিত্রধর্মী বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এ বিষয়ে নিজের ভাষায় আলোচনা করো।

রবীন্দ্রকাব্যে ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতা একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছে। এটি যে কেবল সৌন্দর্য-ভাবনার কবিতা নয়, অজানাকে না পাওয়ার বেদনা সম্পর্কিত কবিতা তা নয়, এটি যে নিছক একটি ধ্বনিপ্রধান ছন্দলালিত্যের কবিতা তা নয়, এটি একটি চিত্রধর্মী কবিতা-ও। নিসর্গ চিত্র অঙ্কনে রবীন্দ্রনাথ যে কত বড়ো যাদুকর আলোচ্য কবিতাটিই তার প্রমাণ। কবির মনোভাবের পরিবর্তনের সঙ্গে সমতা রক্ষা করে এক একটি নিসর্গ চিত্র সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এ নিসর্গ দিকচিহ্নহীন সমুদ্র আর ততোধিক দিকচক্রবালহীন আকাশ—দুইটি বিরাট, সীমানাবিহীন। এই দুই বিরাট চিত্রের মধ্যে কবিমনের ভাবদ্যোতক অনেকগুলি ছোটো-বড়ো চিত্র ফুটে উঠে কবিতাটির ব্যঞ্জনা আর কবির বেদনার্ত হৃদয়ের অনুভূতিকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলেছে।

প্রথম স্তবকে রহস্যময়ী বিদেশিনীর অস্পষ্ট চিত্র। আসন্ন সন্ধ্যায় পশ্চিম গগনের দিকে ‘অঙ্গুরী তুলি’ রহস্যময়ী নায়িকা কবির দৃষ্টি কোন্ দিকে আকর্ষণ করছে কবি তা বুঝতে পারছেন না।

দ্বিতীয় স্তবকে শেষ অপরাহ্বের লাল রঙে তরঙ্গভঙ্গ সমুদ্রের ওপরে প্রতিফলিত হওয়ার ‘তরল অনলে’র চিত্রটি পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। কবির মনে হচ্ছে সেই আগুনে অম্বরতল যেন গলে গলে পড়ছে। এই আগুন যেন কবি-মনের আকাঙ্ক্ষাকে বিবাদের বহ্নিশিখায় পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। ‘মেঘচুম্বিত অস্তগিরির চরণতলে’ কী আছে কবি তা জানেন না। তাই তাঁর মন অনিশ্চিতের সংশয়ে ভারাক্রান্ত।

তৃতীয় স্তবকে বায়ুর দীর্ঘশ্বাস আর জলোচ্ছ্বাসের গর্জন কবির বিষাদকে গভীর করে তুলেছে। তাঁর মনে হচ্ছে বিশ্বব্যাপী এক অসীম রোদন, বায়ুর দীর্ঘশ্বাস আর সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের রূপ কবির মনকে ব্যথিত করেছে, একাত্ম হয়েছে কবির অন্তর্লোকের অপরূপ বিষাদময়তার সঙ্গে। ধীরে ধীরে সূর্য পশ্চিম গগনে ডুবে যাচ্ছে, হিরণ্ময় তরণীর ওপর কবি একটি রহস্যময়ী বিদেশিনীর পাশে নিঃসঙ্গ অবস্থায় আপনারই হৃদয়ের বেদনা আর সংশয় নিয়ে বসে আছেন। মনের সেই বিষাদ আর সংশয় বর্ণনার মধ্যে অপরূপভাবে ফুট উঠেছে। এছাড়া অনেক টুকরো চিত্রও অপূর্ব বর্ণনার মাধ্যমে ভেসে উঠেছে আমাদের চোখের ওপরে। ‘দিনের চিতা’ ‘দিগ্বধূর অশ্রুময় আঁখি’, ‘অস্ত গিরি’, ‘তরণী হিরণ’, এবং সবার ওপরে সেই রহস্যময়ী রমণীর মৃদু উদাসীন হাসি—চিত্রের পর পরিস্ফুট হয়ে সমস্ত কবিতাটিকে করে তুলেছে চিত্রধর্মী। প্রতিটি চিত্রই কবি-মনের ব্যাকুলতা আর সংশয়কে প্রকাশ করেছে।

অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment