অচলায়তনের বালক সম্প্রদায়ের কী বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘গুরু নাটকে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অচলায়তন বলা হয়েছে। অচলায়তনে শিশুদের নিজস্ব ইচ্ছার কোনাে প্রাধান্য থাকে না। কেবলমাত্র পুথিগত বিদ্যার ওপর ভর করে এদের শিক্ষা দেওয়া হয়। তাতে প্রতিদিন নিয়ম করে তাদের মন্ত্রপাঠ, যাগযজ্ঞ, আচার-অনুষ্ঠান ও ধ্যানে বসতে হত।
আশ্রমের এই কঠিন নিয়ম, অবরুদ্ধতা বালকদের মনে এমন গভীর প্রভাব বিস্তার করে যে তারা সাধারণ কাজ করতেও ভয় পায়। তাই তারা হাসতে জানে না, গাইতে জানে না, নাচতে জানে না, আনন্দে মেতে উঠতেও শেখেনি। পাপের ভয়ে খােলা আকাশের নীচে খেলতে যেতে ভয় পায় যদি পাপ হয়। লােহা পেটানােকে তারা গর্হিত কাজ বলে জানে। মুক্ত আকাশের আলাে বা পাখির ডাক তাদের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।
সেই কারণেই কৌতূহলের বশে বালক সুভদ্র উত্তর দিকের জানালা খুলে দেখলেও আশ্রমের কুসংস্কারের চাপে তার মন ভীত-ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। এই দুশ্চিন্তায় সে সকলকে তার কৃতকর্মের কথা জানায় এবং আচার্য এবং পঞ্চক তাকে নানাভাবে বাঁচাতে চাইলেও সে পাপক্ষালনের জন্য মহাতামস ব্রত পালনে অগ্রসর হয়। আবার গুরুর আগমনে সবকিছু ভেঙে চূর্ণ হয়ে গেলেও আশ্রমের সংস্কার তাদের মনে এমন বদ্ধমূলভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে যে তারা আনন্দকেও মুক্তমনে গ্রহণ করতে ভয় পায়।
“এই তাে আমার গুরুর বেশ” -গুরুর কোন বেশের কথা বলেছে?
রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন নাটকের ক্ষুদ্র সংস্করণের নাম গুরু। আসলে গুরু হল এই গল্পের প্রধান চরিত্র। গুরুর আগমনকে কেন্দ্র করেই অচলায়তন নামক আশ্রমের যত আচার অনুষ্ঠান, মন্ত্রপাঠ। কিন্তু গুরু মুক্ত মনের মানুষ। পৃথিবীর সব সুখ আনন্দ, জ্ঞান বুদ্ধি, মন্ত্রতন্ত্র তাঁর বশীভূত। তাই তিনি অনায়াসে সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষ বা কর্মীদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করেন। তিনি তাদের দাদাঠাকুর। এইসব কর্মীমানুষ দাদাঠাকুরকে খুব সম্মান করে, তার কথামতাে কাজ করে। তারা অবােধ, চিন্তাভাবনা করা তাদের কাজ নয়। তাই তাদের হয়ে দাদাঠাকুর সমস্ত চিন্তার ভার নিয়েছেন। তিনি সাদাপােশাক পরিহিত গুরু বা নেতার স্থান দখল করেছেন। এদিকে অপরাধের প্রাচীর বাড়তে বাড়তে যেদিন আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে সেদিন গুরু তথা শূনকদের দাদাঠাকুর শূনকদের সঙ্গে করে অচলায়তনের প্রাচীর দরজা ভেঙে ধূলিসাৎ করে অচলায়তনিকদের বন্ধনমুক্ত করতে এসেছেন যােদ্ধাবেশে। হাতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যােদ্ধা শূনকদের তিনিই পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছেন। একেই লেখক যােদ্ধবেশ বলেছেন।
“শিলা জলে ভাসে”— কে, কোন্ প্রসঙ্গে কেন এ কথা বলেছেন?
এই উক্তিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘গুরু’ নাটকে মহাপঞ্চক নামক চরিত্রটি ব্যঙ্গার্থে প্রয়ােগ করেছেন। কঠিন পদার্থ শিলার ভর তার দ্বারা অপসারিত জলের তুলনায় অনেক বেশি বলে শিলা জলে ভাসে না, ডুবে যায়। তাই কথাটি অবাস্তব। অচলায়তনের অন্যতম সদস্য বিশ্বম্ভর যখন মহাপককে জানায়। যে শত্রুপক্ষের সৈন্য বা যৌন করা অচলায়তনের প্রাচীর ফুটো করে দিয়েছে, তখনই এমন কথা মহাপঞ্চক বলেছেন বিস্ময়ের সঙ্গে। পাথর দিয়ে গড়া শক্ত বিশাল মন্ত্রপূত অচলায়তনের প্রাচীর কীভাবে ওই স্নেচ্ছরা ভেঙে ফেলে সেই কথাই মহাপঞ্চকের বােধগম্য হয় না। কিন্তু অচলায়তনের অপরাধ বাড়তে বাড়তে চরম সীমায় পৌঁছেছে, তাই স্বয়ং গুরুর নেতৃত্বে আত্মশক্তিতে বলীয়ান যূনকরা অচলায়তনের প্রাচীর ভেঙেছে।
শিলা জলে না ভাসলেও হনুমানের ‘রাম নাম লেখা শিলায় ভর করে রাম-লক্ষ্মণ সমেত বিশাল বানরসেনা লঙ্কায় পৌঁছেছিল। অর্থাৎ বিশ্বাস ও আত্মশক্তি মানুষকে যে-কোনাে অসাধ্য সাধন করতে সাহায্য করে। এখানেও সেই আত্মশক্তি, গুরুর প্রতি বিশ্বাসই যূনকদের শক্তিরূপে ক্রিয়াশীল।
“ভুল করেছিলুম জেনেও সে ভুল ভাঙতে পারিনি।” কে কাকে কোন্ ভুলের কথা বলেছে? ভুল ভাঙেনি কেন?
আলােচ্য উক্তিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গুরু গ্রন্থে অচলায়তনের আচার্য অদীনপুণ্য বলেছেন তাদের গুরু তথা শূনকদের দাদাঠাকুরকে।
আচার্য হলেন অচলায়তন নামক আশ্রমটির প্রধান কর্ণধার। তাঁর নির্দেশেই আশ্রমের সকল সদস্য নিয়ম পালন করে, শিক্ষা দেয় সমাজের উচ্চশ্রেণির সন্তানদের। আশ্রম প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তিনি পুথিগত পাণ্ডিত্য ও নিয়মনীতিকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন যে, প্রকৃত মানবতাই তার কাছে উহ্য হয়ে গিয়েছিল। প্রকৃতির নিয়ম যে মানুষের সকল সংস্কারের ঊর্ধ্বে, সেকথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। তাই তাে অষ্টাঙ্গশুদ্ধি ব্রত করার সময় উপবাসের তৃতীয় রাতে বালক কুশলশীল তৃয়ার্ত অবস্থায় প্রাণত্যাগ করলেও আচার্য তখন তার মুখে এক ফোঁটাও জল দেননি এবং বলেছিলেন, “তুচ্ছ মনুষ্যের প্রাণ আজ আছে কাল নেই। কিন্তু সনাতন ধর্মবিধি তাে চিরকালের।” গুরু আচার্যকে মুক্ত মনে শিক্ষার পথ দেখিয়ে নেতার স্থানে বসিয়ে গেলে তিনি পুথি নিয়ে জীবনকে আবদ্ধ করে তােলেন। কিন্তু গুরুর আগমনবার্তা পেয়ে তিনি সুভদ্রকে দিয়ে মহাতামস ব্রত করানােয় বাধা দিয়েছিলেন। যদিও তিনি শেষরক্ষা করতে পারেননি কারণ তাঁর রক্ষা-করে-চলা নিয়মের প্রভাব ক্ষুদ্র বালক মনেও ক্রিয়াশীল হয়ে গিয়েছিল। সুভদ্র নিজেই ব্রতপালনে। অগ্রসর হয় এবং সুভদ্রকে বাঁচাতে চাওয়ার অপরাধে আচার্যকে পদচ্যুত করে দর্ভকপল্লিতে পাঠানাে হয়।