সূচনা
ঐতিহাসিকদের ধারণায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক আগেই ঠান্ডা লড়াই রাজনীতির জন্ম হয়েছিল। অনেকের মধ্যে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে কমিউনিস্টদের ক্ষমতায় আসার মধ্যে ঠান্ডা লড়াইয়ের বীজ লুকিয়ে ছিল। অনেকে আরও পিছিয়ে গিয়ে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি ও ইতালির একত্রিত করনের ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে শক্তি সাম্যের সূচনা ঘটেছিল তার মধ্যে ঠান্ডা লড়াইয়ের বীজ নিহিত ছিল বলে মনে করেন। তবে সাধারণ ধারণা হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোজভেল্ট এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল উভয়ের মিলিত প্রচেষ্টায় আটলান্টিক চার্টার এর স্বাক্ষরিত ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট হওয়ার পর বিস্তার ঠান্ডা লড়াইয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়।।
ঠান্ডা লড়াইয়ের ক্রমবিকাশ
১. আটলান্টিক সনদ পরিবর্তিত অধ্যায়
আটলান্টিক সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার পরে মার্কিন ও ব্রিটিশ মিত্রতা রুশ নেতৃবর্গ রুষ্ট হয়। রুশ নেতা স্টালিন কে বাদ দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল আটলান্টিক সনদের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বিশ্ব ব্যবস্থাকে গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করেন। আবার সেই ঘটনার আগে থেকে স্টালিন পশ্চিমের নেতৃ বর্গকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। তাই সনদ ঘোষণা কালে স্টালিনকে গুরুত্ব না দেওয়ায় স্টালিনের মনে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। আসলে স্টালিনের মনে ধারণা ছিল যে পশ্চিমী শক্তিবর্গ কখনো সোভিয়েত সাম্যবাদকে ভালো চোখে দেখেনি। তার ধারণা পশ্চিমী শক্তি জোট সাম্যবাদের ধ্বংস সাধনের জন্য সব সময় সচেষ্ট। আটলান্টিক সনদের ঘোষণা ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ১৪ আগস্ট কেন্দ্র করে সোভিয়েত ও পশ্চিমী রাষ্ট্র জোটের পারস্পরিক দূরত্ব বাড়ে যা পরবর্তীকালে ঠান্ডা প্রশস্ত করে।
২. ইরান নিয়ে মতপার্থক্য
পারস্যের তৈল সম্পদ যাতে অক্ষ শক্তি হস্তগত করতে না পারে সেই লোকের সোভিয়ে ৮ রাশিয়া ব্রিটেন পারস্যের সেনা পাঠায় ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে। আজারবাইজান সহ উত্তর দিকে প্রদেশ গুলি সোভিয়েত বাহিনী এবং দক্ষিণ দিকের প্রদেশ গুলি ব্রিটিশ বাহিনী সহ উত্তর দিকে প্রদেশ গুলি সোভিয়েত বাহিনী এবং দক্ষিণ দিকের প্রদেশ গুলি ব্রিটিশ বাহিনী নিয়ন্ত্রণাধীন হয়। পরে মার্কিন বাহিনী ও পারস্য উপসাগর থেকে সোভিয়ে ইউনিয়ন পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের দায়িত্ব নেয়।
কিছুদিন মধ্যেই গ্রেড ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পারস্যের মধ্যে এক ত্রি পাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির বলে দক্ষিণাঞ্চলে ব্রিটিশ এবং উত্তরাঞ্চলে সোভিয়েতের বাহিনী নিয়ন্ত্রণ শিকার করে নেয়া হয়। এছাড়া স্থির হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে দুই দেশ পারস্য থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করে নেবে। পরে পারস্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে রুশ ও হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে পারস্য রাষ্ট্রসঙ্ঘে অভিযোগ জানালে দুই পারস্য ও রাশিয়া দেশের মধ্যে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মধ্যস্থতা এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এপ্রিল মাসে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে।
স্থির হয় ২৫ বছরের জন্য উত্তর পারস্যের তৈল সম্পদের ওপর রুশ অধিকার স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে নবগঠিত পারস্যের পার্লামেন্ট এই চুক্তি বাতিল করে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সাহায্যের বিনিময় তার সঙ্গে পারস্য নতুন করে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এই চুক্তির ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারস্যকে সামরিক ও অসামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলে মধ্যপ্রাচীর তেল সম্পদ নিয়ে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই রাজনীতি সূচনা হয়।
৩. দ্বিতীয় রণাঙ্গনের প্রশ্নের মতভেদ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন দ্বিতীয় রাণাঙ্গন খোলা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের অবিশ্বাস জন্মায়। এই ব্যাপারে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের দুমুখো নীতি রাশিয়ার অবিশ্বাস কে আরো ঘনীভূত করে। দিদি অরণীর প্রশ্নের রাশিয়া উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে সার্চিল ঘোষণা ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে করেন, “১৯৪২ এর আগস্ট কিংবা সেপ্টেম্বরে ব্রিটেন মহাদেশীয় ভূখণ্ড ইউরোপের কোন স্থানে অবতরণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।” কিন্তু ঘোষণা কিছুদিন পরে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে ব্রিটেনে ইউরোপে দ্বিতীয় রণাঙ্গনের পরিকল্পনা ত্যাগ করে। পরিবর্তে ব্রিটেন প্রথমে উত্তর আফ্রিকা এবং পরে ইতালি অভিযানে সিদ্ধান্ত নেয়।
রুজভেল্ট এই পরিকল্পনার পরিবর্তনের কথা স্টালিনকে জানানোর ভার দেন চার্চিলের ওপর। রুজভেল্টের এই আচরনে স্টালিন ক্ষুদ্ধ হন। স্টালিনের ক্ষোভ প্রশমের লোককে চার্চিল প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন যে, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় রণাঙ্গনে খেলা হবে। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে কায়রো ও তেহরান বৈঠকে চার্চিল, রুজভেল্ট ও স্টালিন দ্বিতীয় রণাঙ্গন খেলা সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কোথাও দ্বিতীয় রণাঙ্গন খেলা হবে তা নিয়ে মত বিরোধ শুরু হয়। এভাবে দ্বিতীয় রণাঙ্গন প্রশ্নটি দীর্ঘিত হয় যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ায়।
৪. গ্রীস সমস্যা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন হিটলারের নেতৃত্বে জার্মান সেনাবাহিনী গ্রিস দখল করেছিল। কিন্তু ব্রিটিশ বাহিনী গ্রীস কে জার্মান মুক্ত করে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে। সোভিয়েতি ইউনিয়ন ও গ্রেড ব্রিটেনের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে গ্রীস কে মুক্তাঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ নির্বাচনে গ্রীসে বামপন্থীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই মোকাবিলা লোক এ গ্রেট ব্রিটেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাহায্য চায়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান গ্রিসে সামরিক অর্থনৈতিক সাহায্য পাঠান। ফলে রাশিয়া এবং পশ্চিমে শক্তি বর্গের মধ্যে অবিশ্বাস ও পারস্পরিক বিদ্বেষ বেড়ে যায়।
৫. তুরস্ক বিরোধ
দিদি বিশ্বজিতের শেষ হওয়ার পরে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের সেশারদের রাশিয়া তুরস্কের পূর্ব দিকে অবস্থিত প্রদেশের ওপর তার দাবি জানায়। কৃষ্ণ সাগরের কাছাকাছি সমস্ত দেশের কাছে দার্দানালিকা প্রণালী উন্মুক্ত রাখার কথা বলা হয়। এছাড়া কৃষ্ণ ঠাকুরের কাছাকাছি অবস্থিত নয় এমন দেশের ক্ষেত্রে বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া দার্দানালিকা প্রণালীতে যুদ্ধ জাহাজ যাওয়ার এর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির জন্য তুরস্করের ওপর সৌভিক রাশিয়া চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু তুরস্পা সেই চাপ কে আগ্রহ করে আমেরিকার কাছে সাহায্য চাই। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান তুরস্করে বিশেষ অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যে পাঠালে ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়।
৬. পটসডাম সম্মেলনের সিদ্ধান্ত
ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত ইয়াল্টা সম্মেলন ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসের স্থির হয় জার্মানি আত্মসমর্পণ করার পর সোভিয়েতের রাশিয়া আমেরিকার সঙ্গে মিলিত হয়ে জাপানের বিরুদ্ধে লড়াই চালাবে। কিন্তু পটসডাম ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ১৭ জুলাই থেকে ২ আগস্ট সম্মেলন চলাকালী সোভিয়েতে রাষ্ট্রপ্রধান জানাতে পারে যে আমেরিকা হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জাপানকে আত্মসমর্পণ করাতে সফল হয়েছে। জাপানের উপর অনাবিক বোমা নিক্ষেপের পরিকল্পনার গোপনীয়তায় রাশিয়া ক্ষুব্ধ হয়। তাছাড়া পটসডাম সম্মেলনে জার্মানির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ নিয়ে সোভিয়েত ও মার্কিন মতবিরোধ প্রকট হয়ে ওঠে। পারস্পরিক মত বিরোধের মধ্যে দিয়েই সম্মেলনের শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বলা হয়, পটসডাম সম্মেলন থেকে ঠান্ডা লড়াই প্রকাশে আসে।
৭. সোভিয়েত বিরোধী নীতি সমূহ
(১) চার্চিলের ফালটন বক্তৃতায় : ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্জিং আমেরিকার মিশরীর প্রদেশের অন্তর্গত ফালটনের ওয়েস্টমিনস্টার কলেজে এক ভাষণে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে পাঁচ মার্চ বলেন উত্তর বালটিক সাগরের উপকূলে তীরবর্তী ট্রিয়েস্ট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল রাশিয়ার লৌহ যবনিকার আড়ালে ঢাকা। ফালটন বক্তৃতায় চার্চিল রুশো আগ্রাসন থেকে ইউরোপীয় সভ্যতা কে রক্ষা করার দায়িত্ব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অর্পণ করেন।
(২) কেন্নান বেস্টনী তত্ত্ব : রাশিয়ার কর্মরত সরকারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত জর্জ এফ. কেন্নান, মা. এক্স ছদ্মনামের এমেরিকার ফরেন অ্যাফেয়ার্স নামে পত্রিকায় এক প্রবন্ধে সবিয়ে আক্রমণ নাটক নীতি প্রতিরোধ করার জন্য এবং সোভিয়ে প্রভাব কে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য বেস্টনী তত্ত্ব ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ৪ জুলাই প্রকাশ করেন যা মার্কিন প্রশাসন মেনে নেয়।
৮. ট্রুম্যান নীতি ও মার্শাল পরিকল্পনা
(১) আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান মারকিং কংগ্রেস এক বক্তৃতা ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১২ মার্চ তুরস্ক ও গ্রিকসহ বিশ্বের যে কোন দেশকে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দেন যা ট্রুম্যান নীতি নামে পরিচিত। ঠান্ডা লড়াইয়ের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় এই নীতি ঘোষণার মাধ্যমে।
(২) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাঁচ জন আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এক বক্তৃতায় আমেরিকার বিদেশ মার্শাল যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউরোপে আর্থিক পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে এক পরিকল্পনা পেয়ে করেন, যা মার্শাল পরিকল্পনা নামে পরিচিত। ইউরোপে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনা নিয়ে ট্রুম্যান নীতির পরিপূরক হিসেবে উপস্থাপিত হয় এই মার্শাল পরিকল্পনা। ফলে আরো ঘনীভূত হয়ে ওঠে ঠান্ডা লড়াই।