সূচনা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতের শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের প্রসার এ দেশে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। শ্রমিকদের অসন্তোষ ও শ্রমিক আন্দোলনের ফলে ভারতের ব্রিটিশ শাসন যথেষ্ট বিব্রত হলে সরকার এই আন্দোলন প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে তীব্র দমন নীতি গ্রহণ করেন।
শ্রমিক আন্দোলনের প্রসার
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতের ধারাবাহিকভাবে শ্রমিক আন্দোলনের প্রসার ঘটে। এই সময় শ্রমিক আন্দোলনের প্রচার সম্পর্কে নিজে আলোচনা করা হলো-
১. প্রথম পর্বের ধর্মঘট
(১) ১৯১৭-১৮-র ধর্মঘট : ভারতের সর্ব প্রথম শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে। ১৯১৭-১৮ খ্রিস্টাব্দে আমেদাবাদের বস্ত্র শিল্পের কাজে নিযুক্ত শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধি দাবিতে ব্যাপক ধর্মঘট শুরু করে। এছাড়া করাচির নর্থ-ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে কারখানা, গেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ে, বোম্বাইয়ের বস্ত্র শিল্প ও ডাক বিভাগ রেগুনের কুলি, কলকাতা পৌরসভা, মাদ্রাজ স্ট্রাম কোম্পানি ও বস্ত্র শিল্প ক্ষেত্রে এবং লক্ষ্ণঔ ও খড়্গপুরের রেল কারখানার শ্রমিকরাও ধর্মঘট করে।
(২) ১৯১৯-২০-র ধর্মঘট : ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলা, বিহার, আসাম, বোম্বাই, মাদ্রাজ প্রভৃতি স্থানের রেল কারখানা, বন্দর, টাকসাল, চা বাগান, পাট শিল্প কেন্দ্র, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প কেন্দ্রের প্রভৃতিতে ধর্মঘট হয়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রায় সব শিল্পের শ্রমিক রায় ধর্মঘটের শামিল হয়। অসহযোগ আন্দোলনের সময় ভারতের প্রায় ৪৫০ টি শ্রমিক ধর্মঘট সংগঠিত হয়।
৩. শ্রমিক সংগঠন
১৯১৮ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে বেশ কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে।
(১) ১৯১৮-১৯-এর সংগঠন : বি. পি. ওয়াদিয়া ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন নামে ভারতের প্রথম ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন। গান্ধীজী আমেদাবাদের বস্ত্র শিল্প শ্রমিকদের নিয়ে ১৯০ কোটি খ্রিস্টাব্দে ‘আমেদাবাদে টেক্সটাইল লেভার অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। জাতীয় কংগ্রেস 1919 খ্রিস্টাব্দে তার বিভিন্ন শাখা সংগঠন গুলির ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে সহায়তা করা নির্দেশ দেয়।
(২) ১৯২০ সংগঠন : ১৯২০ করে খ্রিস্টাব্দে নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস গঠিত হয়। ব্যাপ্তিস্তা, বালগঙ্গাধর তিলক, এন. এম. জোশি, দেওয়ান চমনলাল, বি. পি. নদীয়া প্রমুখ এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। লাল লাঞ্চ পথ রায়ের সভাপতি তে বোম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত এই সংগঠনের প্রথম সম্মেলনে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে বিভিন্ন প্রান্তে ৮০৬ জন প্রতিনিধি যোগদান করেন।
(৩) পরবর্তী সংগঠন : দেওয়ান চমনলাল, ভি. ভি. গিরি প্রমুখের নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেনশন ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে, বামপন্থী উদ্যোগে রেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে, আচার্য নরেন্দ্র দেব জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে কংগ্রেসের অভ্যন্তরের কংগ্রেসের সোশ্যালিস্ট পার্টি ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রভৃতি শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে।
৩. বামপন্থীদের ভূমিকা
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ভারতের শ্রমিক আন্দোলনে বামপন্থী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(১) উদ্দেশ্য : শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, কাগজের সময় হ্রাস, জমিদারি প্রথার বিলোপ, সংবাদপত্রে স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা রক্ষা, শ্রমিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি উদ্দেশ্যে বামপন্থীরা এই আন্দোলনে শামিল হয়।
(২) নেতৃত্ব : মোজাফফর আহমেদ, শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, পি. সি. জোশি, হেমন্ত কুমার সরকার, কবি নজরুল ইসলাম প্রমুখ ছিলেন আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ। বাংলা, বোম্বাই, পাঞ্জাব ও যুক্ত প্রদেশ ১৯২৫-উনাদের খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে শ্রমিক ও কৃষক পার্টি প্রতিষ্ঠা করে তার শ্রমিক আন্দোলনকে তীব্র করে তোলেন।
(৩) শ্রমিকদের সমর্থনে বিভিন্ন বামপন্থী পত্র পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য মুজাফফর আহমেদ সম্পাদিত ‘গণবাণী’, সন্তোষ কুমারি গুপ্তা সম্পাদিত ‘শ্রমিক:, এস. এ. ডাঙ্গে সম্পাদিত ‘সোশ্যালিস্ট’ , সিঙ্গারাভেল্লু চেটিয়ার সম্পাদিত ‘লেবার-কিসান গেজেট’ প্রভৃতি।
৪. বাংলার ধর্মঘট
(১) রেল ধর্মঘট : ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে খড়্গপুরের বেঙ্গল নাগপুর রেলে এবং ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে লিলুয়ার ইস্ট ইন্ডিয়ান এবং সাউথ ইন্ডিয়ান রেলে ধর্মঘট হয়। এ সময় ধর্মঘটটি শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে পাঁচজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। খড়্গপুরে ২৫ হাজার শ্রমিক পুলিশ নির্যাতন উপেক্ষা করে ২৬ দিন ধরে ধর্মঘট চালায়। ধর্মঘট প্রত্যাহারা করার পর ১৭ হাজার শ্রমিককে ছাটাই করা হলে শ্রমিকরা আরো তিন মাস ধরে ধর্মঘট চালায়।
(২) চটকল ধর্মঘট : ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের চেঙ্গাইলে লাডকো জুট মিল বাউরিয়ার ফোর্ট গ্লাটার চটকা কলেজ ছয় মাস ধরে ধর্মঘট চলে। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের শ্রমিকরা ৩৭ দিন ধরে ধর্মঘট চালায়। ধর্মঘট পরিচালনার দায়িত্বে ছিল ডক্টর প্রভাবতি দাশগুপ্তার নেতৃত্বে দিনে বেঙ্গল জুট ওয়াক্স ইউনিয়ন।
৫. বোম্বাইয়ে ধর্মঘট
বোম্বাইয়ের শ্রমিক ছাঁটাই এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানকারদের লক্ষ্য শ্রমিক ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ৬ মাস ধরে ধর্মঘট চালায়। এই সময় বস্ত্র কল শ্রমিকদের জঙ্গি সংগঠন ‘ গিরনি কামগার ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ডাঙ্গে মিরাজকর, জওগলএকর প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
৬. সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন
সাইমন কমিশন ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ৩ ফেব্রুয়ারি বোম্বাই বন্দরে পৌঁছলে শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করে। এবছর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘ওয়ার্কর্স এন্ড পেজ্যান্টাস পার্টি’র সদস্যরা কলকাতায় মিলিত হয়ে একটি সর্বভারতীয় শ্রমিক ও কৃষক দল গঠনের চেষ্টা চালায়।
আন্দোলন দমনের সরকারের পদক্ষে
শ্রমিক আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে ভারতের ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যেমন –
১.হইটলি কমিশন
শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতির মাধ্যমে সরকার তাদের ক্ষোভ প্রশমন এর উদ্যোগ নেয়। এই উদ্দেশ্যে সরকার হুইটলি কমিশন ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে গঠন করে।
২. আইন প্রণয়ন
শ্রমিক আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে বড়লাট লর্ড আরউইন ‘শিল্প বিরোধ বিল’ ও ‘জননিরাপত্তা বিল’ নামে দুটি শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী বিল পাস করে। প্রথমটির দ্বারা শ্রমিক ধর্মঘট বেআইনি ঘোষণা করা হয় এবং দ্বিতীয়টির দ্বারা কমিউনিস্ট এর দমনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
৩. মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা
সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ৩৩ জন শ্রমিক নেতা কে গ্রেফতার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে করে তাদের মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসানো হয়। এই নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মুজাফফর আহমেদ, এস. এ. ডাঙ্গে, পি. সি. জোশি, মিরাজকর, গঙ্গাধর অধিকারী, শিবনাথ ব্যানার্জি, ধরণী গোস্বামী।, বেঞ্জামিন ব্রাডল, ফিলিপ স্প্র্যাট প্রমুখ। অধিকাংশ বন্দিকে দোষী সাব্যস্ত করে দীর্ঘ কারাদণ্ড দেয়া হয়।
৪. নিষেধাজ্ঞা
শ্রমিক আন্দোলনের দুর্বল করার উদ্দেশ্যে সরকার ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট দল ও তার সমস্ত শাখা গুলিকে বেআইনি বলে ঘোষণা করে।