সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্য
বিশেষ কয়েকটি উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে কোন একটি দেশ অপর দেশে সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করে। এই উদ্দেশ্য গুলি হল-
১. অর্থনৈতিক সুবিধালাভ
শুভ প্রাচীন কাল থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের লক্ষ্যে নৌ শক্তিতে শক্তিধর দেশগুলি সাম্রাজ্য বিস্তার অগ্রসর হয়। প্রাচীন রোম বাণিজ্যের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের লোককে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল জুড়ে রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়েছিল। পরবর্তীকালে ইংল্যান্ড ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, পর্তুগাল, স্পেন প্রভৃতি নৌ শক্তিতে শক্তিশালী দেশগুলো বাণিজ্যিক লক্ষ্য নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিযান চালায় এবং উপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। আরো পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে শিল্প বিপ্লব ঘড়লে কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী বিক্রিয়ের লক্ষ্যে উপনিবেশের প্রয়োজনীয়তা বাড়ে। এই প্রয়োজনীয়তা লক্ষ্মী ইউরোপের শিল্প উন্নত দেশ গুলি সাম্রাজ্যবাদ কায়েমের লক্ষ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
২. জাতীয়তাবাদের সম্প্রসারণ
সাম্রাজ্যবাদের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো জাতীয়তাবাদের সম্প্রসারণ। একটি দেশ অপর দেশের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার দ্বারা নিজের দেশের মর্যাদা, শক্তি, প্রভাব বৃদ্ধি এবং জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করার চেষ্টা করে। নিজের দেশের পতাকা অন্য দেশে উড়িয়ে, নিজের দেশের ভাষা সংস্কৃতি অন্য দেশের অধিবাসীদের ওপরে চাপিয়ে দিয়ে আত্মতুষ্ট লাভ করে থাকে। এই এই ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদের মনোভাব থেকে অনেক এই ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদের মনোভাব থেকে অনেকে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মনে করে থাকে।
অনেকে সময় কোনো দেশের রাজা-বাদ শাসক নিজেদের সমুদ্র বীর্যের প্রমাণ রাখার জন্য সুবিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। তাই প্রকৃত বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন তার জীবন সংগ্রাম এবং জীবন সংগ্রামের শক্তিশালী জয় লাভ তত্ত্বের দেখিয়েছেন বিশ্বের দুর্বল জাতির ওপর শক্তিশালী জাতি রাষ্ট্রের প্রভুত্ব স্থাপন প্রকৃতির সাধারণ নিয়ম। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের শিকার করে নিয়ে Hone Kohn তার ‘Nationalism and Imperialism in the Hither East’, গ্রন্থে লিখেছেন জাতীয়তাবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
৩. জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি
বিশ্ব রাজনীতিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা বা দেশবাসীর নানা চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি জাতীয় শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করে। নিজে নিজে উপনিবেশিক সাম্রাজ্য থেকে কাঁচামাল ও সম্পদ যোগান করে একটি ক্ষুদ্র দেশ কিভাবে বিশেষ একটি অন্যতম রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে পারে ব্রিটেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপনিবেশ গড়ে তুলে সুবিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়ে ওঠাব বৃটেন এবং ফ্রান্স world power হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। পরবর্তী এই পদ অনুসরণ করে জার্মানি ও বিশ্ব রাজনীতিতে স্বতন্ত্র স্থান লাভের লোককে জাতীয় শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা চালায়। তাই অধ্যাপক হল হ্যারল্ড, ল্যাস্কি লিখেছেন -“ক্ষমতা সম্প্রসারিত হওয়ার ফলেই জাতীয়তাবাদের রূপান্তর ঘটে সাম্রাজ্যবাদে।”
৪. জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা
জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা সাম্রাজ্যবাদের আরেকটি মূল উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রীয় সীমার বৃদ্ধি এবং সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দাঁড়া লাস্টে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করে। যদি অনেকের ধারণা জাতীয় নিরাপত্তা অজুহাত দেখিয়ে আসলে সাম্রাজ্যবাদকে সুদৃঢ় করার চেষ্টা চালানো হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ফ্রান্স রাইন নদী পর্যন্ত সমগ্র ভূখণ্ডের উপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দাবি জানাই। আবার এই একই অজুহাতে জাপানের দূরপ্রাচ্যে নিজের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা অজুহাত দেখিয়ে লাতিন আমেরিকার অভন্তরীয় ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করেছেন। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের নিরাপত্তা ব্যবসা কে শক্তিশালী করে তোলার অজুহাত দেখিয়ে দিয়াগো, গর্সিয়া বহু অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে। দেশে নিরাপত্তার কথা প্রচার করে রাশিয়া লাটাভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া এবং ফিনল্যান্ডের কিছু অঞ্চল দখল করে নেয়। নিরাপত্তার কথা তুলে ধরে জিব্রাল্টার, মালটা, সারপ্রাস, এডেন ইত্যাদি অঞ্চল নিজের দখল করে নেয়।
৫. জনসংখ্যার সংকুলাম
ধারণার শিল্প বিপ্লবের পরবর্তীকালে ইউরোপের বিপুল জনসংখ্যার চাপ সমালোচনা লক্ষ্যে জনবহুল রাষ্ট্রগুলি অনেক সময় সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটাতে সচেষ্ট হয়। 19 শতকের ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশেই কম বেশি জনসংখ্যা বিস্তার ঘটে। এই বর্ধিত জনসংখ্যায় পূর্ণবাসন ও সংকলনের লক্ষ্য এবং কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে এশিয়া, আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়া বেশ কিছু অঞ্চলে ইউরোপীয় উপনিবেশ গড়ে ওঠে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে জার্মান রাষ্ট্রনায়ক অ্যাডফল হিটলার পূর্ব ইউরোপে জার্মান রাষ্ট্র শক্তির সম্প্রসারণ লক্ষ্যের সচেষ্ট হন। তিনি বলেছেন জার্মান জাতির জন্য ‘পা রাখবার জায়গার’ প্রয়োজন।
জার্মানি ছাড়াও জাপান, ইতালি সাব বেশ কয়েকটি দেশ এই একই অজুহা দেখে নিজে নিজে সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় দখল করা অঞ্চলগুলি বা উপনিবেশ গুলিতে সেই অনুপাতে ইউরোপীয়বাসী স্থায়িত্ব ভাবে বসবাস করেনি। প্রথমে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইতালি সাম্রাজ্যের অধীনে আফ্রিকাতে বসবাসকারী ইতালি বাঁশির সংখ্যা ছিল মাত্র ৪০ হাজার। এই ভিতরে বলা যায় উদ্ভিদ ও লোকসংখ্যার পূর্ণবাসন অজুহাত ছাড়া আর কিছু নয়।
৬. ধর্ম অসভ্যতার আদর্শ প্রচার
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধর্ম ও সভ্যতার আদর্শ প্রচারে আকাঙ্ক্ষা ও সাম্রাজ্যবাদের একটি মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। সু প্রাচী নদীর থেকেই পর্তুগাল, স্পেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশের খ্রিস্টান মিশন নাগরিকগণ এশিয়া, আফ্রিকা এবং আমেরিকার বিভিন্ন দেশে গিয়ে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার করেন। স্পেন ও পর্তুগালের হাজার হাজার জেসুইট এবং অন্যান্য খ্রিস্টান পুরোহিতগণ খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে লাতিন আমেরিকা বহু অজানা দেশে পাড়ি দেয়। সপ্তদশ শতকের উত্তর আমেরিকাতে মূলত প্রোটেস্টান্ট ধর্মীয় নেতাদের প্রচেষ্টার জন্যই ব্রিটিশ উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। শুধুমাত্র ধর্মযাজকরাই নন, রাজনৈতিক নেত্রী বর্গ ধর্ম ও সভ্যতা প্রচারককে হাতিয়ার করে সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণ করেন।
ইউরোপের কিছু সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাবিদ মনে করেন এশিয়া ও আফ্রিকা অনুন্নত, অন্ধকারচ্ছন্ন মানুষের প্রতি ইউরোপীয় কিছু দায়বদ্ধতা আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় স্পেনকে পরাজিত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপিনস অধিকার করে নিল ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ম্যাককিনলে খ্রিস্ট ধর্ম ও মানবতার স্বার্থে তাদের সমর্থন জানান। এ প্রসঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বলেন ফিলিপিনসের জনগণের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার চালিয়ে তাদেরকে শিক্ষিত ও সুস্বাদ্য করে তোলার আদেশ দিয়েছেন ভগবান।” বেলজিয়ামের তৃতীয় লিওপোল্ড আফ্রিকার কঙ্গোতে বেলজিয়ামের সাম্রাজ্য গড়ে তোলার আগে বলেছেন যে, অন্ধকারে আচ্ছন্ন কঙ্গো বাসিকে সভ্যতার আলোয় নিয়ে আসার উদ্দেশ্যই তিনি কঙ্গোয় নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তুলবেন।
সাম্রাজ্যবাদ বিকাশে বিভিন্ন স্তর
সাম্রাজ্যবাদ বিকাশের বিভিন্ন স্তর নিয়ে ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের ধারণা হলো সাম্রাজ্যবাদ মূলত তিনটি স্তরে বিকশিত হয়। প্রাথমিকভাবে এই তিনটি স্তর হল-
১. প্রথম স্তর
এই স্তরের সূচনা ঘটে কেষ্টফারের কলম্বাস এর ভৌগোলিক অভিযানের সূচনা কাল থেকে। আর এই স্তরে সমাপ্তি ঘটে ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে সপ্ত বর্ষব্যাপী যুদ্ধে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পঞ্চদশ শতকের শেষার্ধে থেকে ষোড়শ শতকের মধ্যে কলম্বাস, আমেরিগো ভেসপুচি, সেবাটিয়ান ক্যাবেট, পেড্রো আলভারেজ কেব্রাল ১৪৬৭-১৫২০ খ্রিস্টাব্দে প্রমুখের অভিযান গুলির ফলেই নতুন বিশ্বের ইউরোপীয়দের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময়কালের মধ্যে উপনিবেশ হিসেবে পশ্চিম গোলার্ধের বহু অঞ্চল বিদেশি শাসন এবং শোষণের অঙ্গীভূত হয়। প্রকৃত অর্থেই সময়কালে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য সংস্থাগুলি সাম্রাজ্যবাদের বীজ বপন করে।
২. দ্বিতীয় স্তর
ভৌগলিক আবিষ্কারের পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিক শোষণের যুগ শুরু হয়। এই স্তরে সময়কাল আনুমানিক ১৭৬৩-১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। শিল্প বিপ্লব অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ প্রসার, ধর্ম ও সংস্কৃতি বিকাশ প্রভৃতি সুবাদে বাণিজ্যে উন্নত ইউরোপীয় দেশগুলি সাম্রাজ্যবাদের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এই সময়কালে এসে এবং আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শাসনের আওতায় আসে।
৩. তৃতীয় স্তর
এই স্তরে সময়কাল আনুমানিক ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আবাসন কাল পর্যন্ত। এই সময়কালে এসিয়া, আফ্রিকার পরিবর্তন উপনিবেশিক সাম্রাজ্য বজায় রাখার পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শক্তি গুলি মধ্যপ্রাচ্য ও সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করে। এই সময়ে উপনিবেশ গুলি কাঁচামাল সরবাহের উৎস এবং উৎপাদিত শিল্প পণ্য বিক্রয়ের কেন্দ্রে পরিণত হয়। এইসব মহাদেশ ইউরোপীয়দের তীব্র বঞ্চনার ও বঞ্চনার শিকার হয়। শোষিত ও বঞ্চিত এসব দেশের সম্পদের ওপর নির্ভর করে আধুনিক ইউরোপের উন্নত দেশগুলি সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। বিশ শতকের প্রথমার্ধে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক ভুভাগ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গুলির অধীনে চলে যায়।