সমাজ সংস্কারের বীরসালিঙ্গম কোন নবজাগরণের যিনি শ্রেষ্ঠ পথিকৃৎ ছিলেন তিনি হলেন কান্দুকরি বীরসালিঙ্গম পানতুল ১৮৪৮-১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে। বীরসালিঙ্গম অন্ধের রাজা মুন্দ্রির এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেনি। বীরসালিঙ্গম প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও পন্ডিত দপ্তর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণ বলেছেন যে, “শ্রী বীরসালিঙ্গম পানতুল ছিলেন দক্ষিণ ভারতের প্রথম দিকে পথিকৃৎদের মধ্যে অন্যতম একজন যিনি আমাদের সমাজে চূড়ান্ত পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন” । বীরসালিঙ্গমের অন্যতম লক্ষ্য ছিল মানুষের সামাজিক উন্নতি ঘটানো। এই উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই কর্মসূচি গুলি হল –
১. সমাজ সংস্কার
বীরসালিঙ্গম সংস্কারের কর্মসূচি প্রধান লক্ষ্য ছিল মানুষের নৈতিক উন্নতি ঘটিয়ে সামাজিক উন্নতির পথ প্রস্তুত করা। এই উদ্দেশ্যে যিনি জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, পৌত্তলিকতা, বাল্যবিবাহ, নিম্ন বর্ণের ওপর উচ্চ বর্ণের শোষণ পিরন প্রকৃতির তীব্র নিন্দা করেন। যিনি সরকারি কর্মচারী ও বিচারকদের দুর্নীতি ও অন্যায় কাজকর্ম সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরে জনগণকে সচেতন করেন।
২. নারী কল্যাণ
বীরসালিঙ্গম উপলব্ধি করেছেন যে নারী সার্বিক উন্নতি ছাড়া সমাজে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। তিনি নারী কল্যাণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
(১) বাল্যবিবাহ বিরোধিতা : দক্ষিণ ভারতের ব্যাপকভাবে প্রচলিত বাল্যবিবাহ ও কন্যা-শুল্কম বিবাহের জন্য কন্যা ক্রয় এর বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদে সোচ্চার হন। তিনি উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করেন যে, বাল্যবিবাহ শাস্ত্রসম্মত নয়। ‘ব্রাহ্মবিবাহন’ নাটকের তিনি বাল্যবিবাহ ও কন্যা-শুল্কম-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্য তিনি ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ‘রাজামুন্দ্রি সমাজ সংস্কার সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন।
(২) বহুবিবাহের বিরোধিতা : তিনি পুরুষের বহুবিবাহের প্রতিবাদ করেন।’সতরাজাচার্য পূর্বদেশ যাত্রালু’ নামক ব্যাঙ্গাত্মক নাটকের মাধ্যমে তিনি পুরুষদের বহু বিবাহের বিরোধী তীব্র বিদ্রুপ করেন।
(৩) বিধবা বিবাহে উদ্যোগ : তিনি বিধবা বিবাহে উগ্র সমর্থক ছিলেন। এজন্য মহাদেব গোবিন্দ রানাডে তাকে দক্ষিণ ভারতের বিদ্যাসাগর বলে অবহিত করেছেন। তিনি ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে বিধবা বিবাহ সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। তার উদ্যোগে রাজা মুন্দ্রিতে ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে 11 ডিসেম্বর ভারতের প্রথম বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। তিনি মহীশূর ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে এবং ব্যাঙ্গালোরে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে একটি করে বিধবাশ্রম ও প্রতিষ্ঠা করেন।
৩. জনশিক্ষার প্রসার
বীরসালিঙ্গম নারী শিক্ষার একজন উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। তিনি তার বিভিন্ন বিদ্রুপাত্মক রচনা ও নাটকের নারী শিক্ষা বিরোধীদের তীব্র বিদ্রুপ করেন। জন শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে দেওয়ালেশ্বর ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে ও রাজামুন্দ্রিতে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে একটি করে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি রাজামুন্দ্রিতে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে হিতকারিনী সম্পত্তি রাজমুন্দ্রিতে বিদ্যালয় ও রাজমুন্দ্রি বিধবা শ্রম কে দান করেন। এছাড়াও তার উদ্যোগের বয়স্ক মহিলা, হরিজন ও শ্রমিকদের জন্য নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তার গতিষ্ঠীত বিদ্যালয় গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাল ভারতীয় সমিতি, ন্যাশনাল হাই স্কুল, বন্দেমাতরম হাই স্কুল প্রভৃতি। নিম্নবর্গের মহিলাদের বৃত্তি শিক্ষা দান করে তিনি তার বিদ্যালয় গুলিতে যেসব মহিলাদের নিয়োগ করেন।
৪. সাহিত্য রচনা ও সাংবাদিকতা
বীরসালিঙ্গম ছিলেন তেলেগু সাহিত্য ও সাংবাদিকতার জনক। তিনি প্রথমে তেলেগু ভাষার উপন্যাস, নাটক, প্রকৃতি বিজ্ঞান ও ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি মনে করতেন যে, দর্শন, নীতি শাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, ইতিহাস, জ্যোতি বিদ্যা, শারীরির বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে সহজ বোধ তেলেগু ভাষায় গ্রন্থ রচিত হওয়া উচিত। তিনি ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে ‘বিবেকবর্ধিনী’ নামে একটি তেলেগু পত্রিকা প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে তার উদ্যোগে ‘চিন্তামণি’, ‘সতীহিতবোধিনী’, ‘সত্যবাদী’, প্রভৃতি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। এগুলির মাধ্যমে তিনি একদিকে যেমন তেলেগু সাহিত্যে বিকাশ ঘটান, তেমনি অপরদিকে সমাজ সংস্কার আদর্শ প্রচার করেন।
উপসংহার
আধুনিক অন্ধের রূপায়ণে বীরসালিঙ্গম অসামান্য অবদান ছিল। এইজন্য তিনি ‘আধুনিক গন্ধের জনক’, ‘আধুনিক গন্ধের অগ্রদূত’, ‘অন্ধ নবজাগরণের জনক’, প্রভৃতি অভিধায় ভূষিত হন। মহাদেব গোবিন্দ রানাডে তাকে দক্ষিণ ভারতের বিদ্যাসাগর বলে অবহিত করেছেন। বীরসালিঙ্গম ছিলেন আধুনিক গন্ধের রূপকার ভি. আর. নায়াল তার ‘বীরসালিঙ্গম’ গ্রন্থে বলেছেন যে, “তিনি মানবিকতার পথে পরিচালিত করেছিলেন” ।