বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন কাব্য আবিষ্কারের পর সাহিত্য জগতে এক প্রবল চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। এটি রাধাকৃষ্ণ লীলা বিষয়ক পুরাতন ধরনের আখ্যান কাব্য।
শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্যটির আবিষ্কার ও প্রকাশ :
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন আবিষ্কার করেন সমুদ্রের নাবিক পণ্ডিত বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্ববল্লভ মহাশয়। ১৩১৬ বঙ্গাব্দে (ইং–১৯০৯) বন-বিষ্ণুপুরের কাছে কাঁকিল্যা গ্রামের জনৈক দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ে বাড়িতে এক গোয়াল ঘরে সঞ্চিত অনেক পুরাতন পুঁথির মধ্যে থেকে এটি আবিষ্কার করেছেন।
১৩২২ বঙ্গাব্দে পরিষদ পত্রিকায় বসন্তরঞ্জন ও লিপিতত্ত্ব বিশারদ প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় দুজনে মিলিত হয়ে প্রাপ্ত পুঁথিটির লিপি বিচার করে এটিকে অতিশয় পুরাতন বাংলা আখ্যান কাব্য বলে নির্ধারিত করলেন। এর কয়েকমাস পরেই ১৩২৩ বঙ্গাব্দে (ইং–১৯১৬) বসন্তরঞ্জনের সুযোগ্য সম্পাদনায় এই বৃহৎ পুঁথিটি ‘শ্রীকৃষ্ণকীৰ্ত্তন’ নামে প্রকাশিত হল।
শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্যটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব :
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্য সম্পর্কে ভাষাতাত্ত্বিকেরা মন্তব্য করেছেন যে এতদিনে মধ্যযুগের বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন মিলল। বাস্তবধর্মী সমালোচকেরা রাধাকৃষ্ণের উদ্দাম-কাম-ক্রীড়ার মধ্যে বাঙালি সমাজের যথার্থ পরিচয় পেয়ে এটিকে মাটির কাছাকাছি কাব্য বলে মন্তব্য করেছেন। এর ঐতিহাসিক গুরুত্বকে নানাভাবে ব্যক্ত করা যেতে পারে।
(ক) বাংলা সাহিত্যে প্রভাব: বাংলা সাহিত্যে এই কাব্যের প্রভাব সীমাহীন। বিশেষ করে বৈষ্ণবপদাবলীর ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম। দুটি সাহিত্যের মধ্যে একটি মিল রয়েছে। সেটি হল, উভয় সাহিত্যই রাধাকৃষ্ণ বিষয়কে নিয়ে। তবে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে যেখানে রাধাকৃষ্ণ চরিত্রর পরিণতি লাভ করেছে সেখানে বৈষ্ণবপদাবলীর রাধাকৃষ্ণের কাহিনি শুরু। কৃষ্ণ বিরহে রাধার অবস্থা ‘রাধা বিরহে’ আছে-
“যোগিনী রূপ ধরি লইবো দেশাত্তর।”
বৈষ্ণুবপদাবলীর রাধার অবস্থা এইরূপ।
“সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘ-পানে
না চলে নয়ান তারা।
বিরতি আহারে রাঙ্গাবাস পরে
যেমত যোগিনী পারা।।”
এছাড়াও ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি চৈতন্যদেব কর্তৃক আস্বাদিত হয়েছিল বলে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
(খ) আখ্যান কাব্য হিসাবে গুরুত্ব: ‘শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তন মূলত আখ্যান কাব্য। কিন্তু নানা স্থানে নাট্য ও গীতিকাব্যের লক্ষণ সুস্পষ্ট। কবি প্রায়ই যবনিকার অন্তরালে রয়ে গেছেন কিন্তু সংগতি রক্ষা করেছেন পাত্রপাত্রীর সংলাপের মধ্যে দিয়ে। তাই সবদিক দিয়ে বিচার করে এটিকে গীতি ও সংলাপ মূলক আখ্যান কাব্য বলা যেতে পারে।
(গ) ছন্দ ও আলঙ্কারিক গুরুত্ব: শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ছন্দের বৈচিত্রও বিশেষ লক্ষণীয়।
এখানে দিগক্ষরা—
“একদিনে মনের উল্লাসে।
সখী মনে রস পরিহাসে।।”
একাবলী—
“আয়ি লা দেবের সুমতি গুণি
কংসের আগেক নারদমুনি।।”
ত্রিপদী, পয়ার প্রভৃতি ছন্দের মাধুর্য লক্ষণীয়। তাঁর অলংকারাদি বিশেষ উপভোগ্য। যেমন—কৃষ্ণ কর্তৃক রাধার রূপ বর্ণনা—“লবলী দল কোমল”, “জুডু আ দেখি আঁ যেহ্ন রুচিক অম্বল।”
(ঘ) সমাজ ও ধর্মর্গত গুরুত্ব: এই কাব্য থেকে তৎকালীন সামাজ, রাজনীতি, মানুষের আচার আচরণ প্রভৃতির সঙ্গে মানুষের ধার্মিকতার বিশদ পরিচয় পাওয়া যায়।
সর্বোপরি বলতে হয় বড়ু চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যখানি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হলেও এর অশ্লীলতা সম্পর্কে কোনও কোনও সমালোচক তিক্ত মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এর জন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না। কারণ তিনি যে সময়ে এটি রচনা করেছেন সে সময়ের পরিবেশ কিছুটা স্থূল রুচির পরিচয় বহন করে। কিন্তু এই সামান্য ত্রুটিটুকু বাদ দিলে সাহিত্যের ইতিহাসে এটি অনবদ্য।