চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ফলাফল
বড়লাট লর্ড কর্নওয়ালিস ভারতে প্রবর্তিত ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। এই বন্দোবস্ত প্রকৃত ফলাফল সম্পর্কে ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক বিদ্যের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল গুলি প্রতি বেশি আলোকপাত করেন। অন্যদিকে কেউ কেউ এর কুফল গুলিকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। এই বন্দোবস্তের সুফল ও কুফল গুলি নিচে আলোচনা করা হলো-
সুফল
ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র দত্ত বলেছেন যে, ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত লর্ড কর্নওয়ালিসের বন্দোবস্ত ছিল ভারতের ব্রিটিশ জাতির গৃহীত পদক্ষেপ গুলির মধ্যে সার্বেপেক্ষা প্রজ্ঞা ও সফল পদক্ষেপ। স্মিথ মনে করেন যে, লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করে এক বিপ্লব ঘটনা। মার্শম্যান এর মতে, এটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল একটি দৃঢ়, সাহসিকতা পূর্ণ বিচক্ষণ পদক্ষেপ। এই বন্দোবস্তের বিভিন্ন সুফল গুলি সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হলো-
১. বাজেট তৈরি সুবিধা
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারের অবস্থা যথেষ্ট উন্নতি হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ে সরকারের নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব প্রাপ্তি সুনিশ্চিত হয়। এর ফলে সরকারের পক্ষে বার্ষিক আয় ব্যয়ের বাজেট তৈরি করতে সুবিধা হয়।
২. উৎখ্যাতের সম্ভাবনা হ্রাস
কৃষকের রাজ্যস্বের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট হওয়ায় কৃষকদের সুবিধা হয়। তারা ইজারাদারদের শোষণ এবং জমি থেকে ঘনঘন উৎখাতে আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্তি পায়।
৩. কৃষির উন্নতি
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমির উপর জমিদারের স্বত্ব বা অধিকার সুনিশ্চিত হওয়ায় তার নিজের এলাকায় জমি ও কৃষি উন্নতিতে যত্নবান হন।
৪. ব্রিটিশদের অনুগত গোষ্ঠী
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সরকারের অস্তিত্বের ওপর জমিদারের অস্তিত্ব নির্ভরশীল ছিল। তাই জমিদারার সরকারের প্রতি অনুগত্য জানিয়ে ভারতের ব্রিটিশ সরকারের স্থায়িত্ব রক্ষার চেষ্টা করে। তাদের সমর্থনে ভারতের শাসনের ভিত্তি আরো সুদৃঢ় হয়।
কুফল
বিভিন্ন ঐতিহাসিক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিভিন্ন সুফল উল্লেখ করলেও কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন যে, এই বন্দোবস্তের অপেক্ষা কুফলই বেশি ছিল। ঐতিহাসিক হোমস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে একটি দুঃখজনক ভুল বলে অবহিত করেছেন। এডওয়ার্ড থর্নটন বলেছেন যে, চরম অজ্ঞতা থেকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সৃষ্টি হয়। এই বন্দোবস্তের বিভিন্ন কুফল বলে নিচে উল্লেখ করা হলো-
১. জমিদারের অবসান
‘সূর্যাস্ত আইন’অনুসারে নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের মধ্যে সরকারি কোষ আকারে রাজস্ব জমা দিতে ব্যর্থ হয়ে বহু পুরনো জমিদার তাদের জমিদারি হারান। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হওয়ার প্রথম কুড়ি বছরের মধ্যে বাংলার প্রায় অর্ধেক প্রাচীন জমিদার তাদের জমিদারি হারান।
২. নতুন জমিদারের উত্থান
পুরনো বহু জমিদার তাদের জমিদারি হারালে শহুরে ধ্বনি বণিকরা এই জমিদারী গুলি কিনে নেয়। এসব ভুঁইফোঁড় নতুন জমিদারের গ্রামের কৃষক ও জমির সঙ্গে কোন সম্পর্ক বা প্রজা কল্যাণের কোন ইচ্ছা ছিল না। তারা শহরে বসে নায়েব গোমস্তাদের দিয়ে জমিদারি চালাতে। প্রজাদের শোষণ করে বেশি অর্থ উপার্জনে ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।
৩. কৃষকের উচ্ছেদ
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষকরা জমি থেকে ঘনঘন উৎখাতের আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত হন বলে কোন কোন পণ্ডিত মনে করলে অনেকেই মনে করেন এই ব্যবস্থাই জমিদারের বেশি রাজস্ব পাওয়ার আশায় চাষীকে জমি থেকে ঘনঘন উৎখাত করতে হয়। কারন এই বন্দোবস্তে জমিতে কৃষকদের কোন স্বত্ব বা অধিকার ছিল না। চাষী রাজস্ব বাকি পড়লে জমিদার সেই চাষে জিনিসপত্র নিলাম করত। এইজন্য প্যার্সিভ্যাল স্পিয়ার বলেছেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা কৃষকরা জমিদারের ভাড়াটে মজুরের পরিণত হয়।
৪. জমির উন্নতি ব্যাহত
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা জমির মালিকানা না পাওয়াই চারশিরা জমির উন্নতির জন্য বিষের চেষ্টা করত। জমিদারাও জমির উন্নতি, কৃষি প্রসার, সেচের প্রসার, পতিত জমি উদ্ধার প্রভৃতির জন্য অর্থ ব্যয় না করে জমির আয় তারা নিজেদের বিলাসভ্যসনে ব্যয় করতো। এর ফলে রোমিও কৃষির উন্নতির দারুন ভাবে ব্যাহত হয়।
৫. সরকারের লোকসান
জমিদাররা চাচিদের কাছ থেকে নির্ধারিত রাজস্বের চেয়ে অনেক বেশি রাজস্ব আদায় করলেও এই বাড়তি রাজস্বের অংশ সরকার পেতেন না। সরকারি রাজস্ব নির্ধারণ সুনির্দিষ্ট হলে ভবিষ্যতে রাজস্ব থেকে সরকারের আয় বৃদ্ধি সম্ভাবনা বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষি পণ্যের বৃদ্ধি, পতিত জমি উদ্ধার প্রভৃতি থেকে জমিদারের আয় বহুগুণ বাড়লেও এই বাড়তি আয়ের কোনো অংশ সরকার পেতেন না।
৬. কৃষকের দুরবস্থা
কৃষকের ওপর বিপুল পরিমাণ রাজস্বের বোঝা তা আদায় করতে গিয়ে তাদের ওপর তীব্র শোষণ ও অত্যাচার চালানো হয়। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে জমিদাররা সরকারকে ৩৫ লক্ষ পাউন্ড রাজসস্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ওই বছর জমিদাররা কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব বাবদ আদায় করেন এক কোটি ৩৫ লক্ষ পাউন্ড। উনবিংশ শতকের প্রথম থেকেই রামমোহন রায়, লালবিহারী দে, হরিচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রমেশ চন্দ্র দত্ত প্রম ুখ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে রায়তের দুর্দশার কথা সবার সামনে তুলে ধরেন।
৭. শিল্প বাণিজ্যের ক্ষতি
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে দ্রুত বেশি অর্থ উপার্জনের আশায় বহু মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে জমিদারি দিকে ঝুকে পড়ে। কুটির শিল্পীর কাজে ও লোকের আগ্রহ কমে যায়। মেজোড়া মানুষ কৃষি নির্ভর হয়ে পড়ে। ফলে শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলায় কৃষকদের দুরবস্থার জন্য রমেশ চন্দ্র দত্ত তার বাংলার কৃষক গ্রন্থে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকেই দায়ী করেছেন।
৮. মধ্যস্বত্বভোগীর উত্থান
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সরকার ও জমিদারের মাঝখানে পত্তনিদার, দর-পত্তনিদার, দরদর-পত্তনিদার প্রভৃতি বিভিন্ন মধ্য মধ্যস্বত্বভোগীর সীমাহীন আর্থিক শোষণ চালিয়ে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। মোটকথা কৃষকের চূড়ান্ত সর্বনাশ করার জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চেয়ে আর কোনো ভালো ব্যবস্থা ছিলনা। ব্যআডএন পাওয়েল বলেছেন যে, কর্ণওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনেক প্রত্যাশা কে ধ্বংস করে এমন কিছু প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল যা চিন্তার বাইরে ছিল।
উপসংহার
ডক্টর নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহের মতে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা জমিদারের খালি চেকে সই করে দেয়া হয়। জমিদারের ইচ্ছা মতো তাদের টাকার অঙ্ক বসাতে পারেন। ডক্টর তার চাঁদ মনে সংগঠন ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু ডক্টর রত্নলেখা রায় মনে করেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা বাংলার গ্রাম সমাজে নতুন কোন পরিবর্তন আসেনি। শুধু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার গোলযোগ গুলি দূর করা হয়েছিল মাত্র। ভারতের চিরাচরিত গ্রামীণ সংগঠন ধ্বংস হয়ে, সম্প্রতি সংক্রান্ত বিবাদ এর সম্পর্কে পরিবর্তন ঘটে, নতুন সামাজিক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে এবং গ্রামাঞ্চলে সামাজিক বিপ্লব ঘটে। গ্রাম সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর ঐতিহ্যগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটে যায়। জমিদারের অত্যাচারের প্রজাদের অবস্থা সঙ্গিন হয়ে উঠলে সরকার প্রজাদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৮৫৯ ও ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রজাস্বত্ব আইন পাস করে।