রামমোহন রায়ের পরবর্তীকালে ব্রাহ্ম আন্দোলন
রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে পর তার প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ সমাজের আন্দোলন কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। অবশ্য পরবর্তীকালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তারপর কেশব চন্দ্র সেন ব্রাহ্মণ সমাজের আন্দোলনকে নতুন করে সক্রিয় করে তোলেন। রামমোহন রায়ের পরবর্তীকালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮১৭-১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ওকে সবচন্দ্র সেন ১৮৩৮-১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে আমলে ব্রাহ্মণ সমাজের আন্দোলনের অগ্রগতি সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-
১. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়
রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর তার অন্যতম সুহৃদ দ্বারকা নাথ ঠাকুর এর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মণ সমাজে যোগদান করলে ব্রাহ্ম আন্দোলন আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তিনি সক্রিয় উদ্যোগ নিয়ে ব্রাহ্মণ সমাজ আদর্শ বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দেন। তিনি বিভিন্ন রীতিনীতি ও নিয়মকানুন চালু করে ব্রাহ্ম আন্দোলনকে একটি সুসংগঠিত ধর্মী রূপদান করেন। তিনি ব্রাহ্মণ ধর্ম প্রচার এর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার উদ্যোগে ব্রাহ্ম সমাজ শিক্ষা বিস্তার ও বিধবা বিবাহ প্রচলনের উদ্যোগ নেয়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মসমাজ বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও অন্যান্য সামাজিক কুসংস্কার নিবারণের উদ্দেশ্যে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে।
২. কেশবচন্দ্র সেনের সময়
কেশব চন্দ্র সেন ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতাজীবন ব্রাহ্মণ সমাজে যোগদান করলে ব্রাহ্ম আন্দোলন তীব্র গতি সঞ্চালন করেন। কেশব চন্দ্রের ভাবাদর্শ, শিক্ষা বিস্তার, নারী মুক্তি, সমাজ সংস্কার ও সমাজসেবার আদর্শ, ধর্মোন্মাদনা এবং ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ বহু শিক্ষিত যুবক ব্রাহ্মণ সমাজ যোগ দেয়। ব্রাহ্ম আন্দোলন কেশব চন্দ্রের সফল নেতৃত্ব দানের জন্য দেবেন্দ্র ঠাকুর তার ব্রাহ্মনন্দ উপাধি দেন ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে এবং ব্রাহ্মণ সমাজের সম্পাদক ও আশ্চর্য পদে নিয়োগ করেন।
(১) বাংলায় কেশব চন্দ্রের কর্মসূচি : কেশব চন্দ্র সমাজ ও ধর্ম সংস্কারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি হলো – (i) সমাজ সংস্কার : তিনি বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে এবং নারী শিক্ষা, নারী স্বাধীনতা, অসবর্ণ বিবাহ, বিধবা বিবাহ, শ্রমিক কল্যাণ প্রভৃতি সমর্থনের দেশে এক আন্দোলন গড়ে তোলেন। (ii) সংগঠিত উদ্যোগ : কেশব চন্দ্রের উদ্যোগে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে ওঠে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ব্রাহ্মবন্ধু সভা ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ, সঙ্গত সভা ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে, ক্যালকাটা কলেজ ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রভৃতি। নারী কল্যাণের উদ্দেশ্যে তিনি বামাবোধীন পত্রিকা ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। কেশব চন্দ্রের অন্যতম কীর্তি হলো ইন্ডিয়ান মিরর ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে পত্রিকায় প্রকাশ।
(২) বাংলার বাইরে কেশব চন্দ্রের কর্মসূচি : কেশব চন্দ্র বাংলার বাইরে বোম্বাই, মাদ্রাজ, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের অঞ্চলে ব্রাহ্মণ ধর্ম ও সংস্কার আন্দোলনের প্রসার। সারা দেশের ব্রাহ্মণ সমাজের সদস্য সংখ্যা ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে ছিল মাত্র ৫০০ জন। তা টা ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে বেড়ে দাঁড়ায় দু হাজার। ঐতিহাসিক ডক্টর রমেশ চন্দ্র মজুমদার এর মতে কেশব চন্দ্র সংস্কার আন্দোলনই হলো প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন।
(৩) মতবিরোধ ও কেশবচন্দ্রকে বহিষ্কার : বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে শীঘ্রইক কেশব চন্দ্রের নেতৃত্বাধীন তরুণ ব্রাহ্মণীদের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের বিরোধ বাধে। (i) দেবেন্দ্রনাথের আদর্শ : একেশ্বরবাদী হলেও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে ব্রাহ্মধর্ম প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্ম। এইজন্য তিনি মূর্তি পূজা ছাড়া জাতিভেদসহ অন্যান্য প্রথা গুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে এবং সমাজ সংস্কারে ধর্মীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে রাজি ছিলেন না। (ii) কেশব চন্দ্রের আদর্শ : অপরদিকে কেশব চন্দ্র সেন ও তার অনুগামীদের কাছে ব্রহ্ম ধর্ম হলো সমন্বয়ী ও সর্বজনীন। কেবলমাত্র পৌত্তলিকতাই নয় তারা একসঙ্গে জাতিভেদ ও অন্যান্য সামাজিক কুপ্রথার বিরোধী ছিলেন। তাদের কাছে ব্রাহ্ম ধর্ম নিছক ধর্মীয় আন্দোলন নয়, সমাজ সংস্কার তার অঙ্গীভূত। (iii) বিভাজন : অসবর্ণবিবাহ, বিধবা বিবাহ, সংস্কৃত ভাষা পরিবর্তে বাংলা ভাষায় মন্ত্র পাঠ, ব্রাহ্ম আচার্যদের উপগতি ধারণ প্রভৃতি বিষয়ে তরুণ ব্রাহ্মরা দেবেন্দ্রনাথের রক্ষণশীলতার প্রতিবাদ করলে দেবেন্দ্রনাথ কেশব চন্দ্র ও তার অনুগামী ব্রাহ্মসমাজ থেকে বহিষ্কার করেন ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে। কেশব চন্দ্রের নেতৃত্বাধীন বহিষ্কৃত ব্রাহ্মরা ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করে। দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্মসমাজ আদি ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিত।
৩. ভারতবাসী ব্রাহ্ম সমাজের উদ্যোগ
কেশবচন্দ্র ও তার অনুগামীরা ভারতবাসী ব্রাহ্মসমাজ গঠন করে ব্রাহ্ম আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে।
(১) সংস্কার কর্মসূচি : ভারতবর্ষে ব্রাহ্মসমাজ বাল্যবিবাহ, পর্দা প্রথা, মদ্যপান প্রভৃতির বিরুদ্ধে এবং বিধবা বিবাহ, স্ত্রী শিক্ষা, অসবর্ন বিবাহ, সুবল সাহিত্য প্রচার, নৈশ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি পক্ষে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। পতিতা পল্লী থেকে মেয়েদের উদ্ধার, সুভল সমাচার পত্রিকার মাধ্যমে ব্রাহ্ম আদর্শ প্রচার প্রভৃতি বিষয়ক তারা উদ্যোগ নেয়।
(২) তরুণ সদস্যবৃন্দ : কেশব চন্দ্রের আন্দোলনে যেসব তরুণ সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী, রামকুমার বিদ্যা রত্ন, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
৪. ভারতবর্ষের ব্রাহ্মসমাজের বিভাজন
কেশবচন্দ্র কিছু কাজকর্ম কে কেন্দ্র করে কিছুদিনের মধ্যেই ভারতবর্ষে ব্রহ্মসমাজের ভাঙ্গন দেখা দেয়।
(১) সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ : শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও দুর্গা মোহনদাস প্রমুখ তরুণ ব্রাহ্ম কেশবচন্দ্রের খ্রিষ্টপতি, গুরুবাদের প্রতি আসক্তি, নিজে নাবালিকা কন্যার বিবাহ দান প্রভৃতি ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করেন। তারা শেষ পর্যন্ত কেশব চন্দ্রের সঙ্গে ত্যাগ করে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা ১৫ মেয়ে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে করেন।
(২) নববিধান ব্রাহ্মসমাজ : পৃথক সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর এসব চন্দ্র-১৮৮ খ্রিস্টাব্দে সর্বধর্মসমন্বয়ে আদর্শে তার নববিধান ঘোষণা করেন। তখন থেকে তার নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্মসমাজ নববিধান ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিত হয়। এই সমাজে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ক্রমে দুর্বল হতে থাকে। সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের প্রভাবের পর ও অব্যাহত থাকে।
উপসংহার
রাজা রামমোহনের পরবর্তী কালে ও ভারতের সমাজ ধর্ম সংস্কারের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজের যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। এই গুরুত্ব গুলি হল – ১. বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, মদ্যপান, পর্দা প্রথা, প্রভৃতি বিরোধিতা করে ব্রাহ্মসমাজ নারী স্বাধীনতা, নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, বিধবা বিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ, শিক্ষার প্রসার, হরিজন উন্নয়ন প্রভৃতির স্বপক্ষে কাজ চালিয়ে যায়। ২. ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের ফলে সরকার ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে তিন আইন পাস করে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করে এবং বিধবা ও বিবাহ অসবর্ণ বিবাহকে আইনসিদ্ধি করে। ৩. দরিদ্র ও শ্মারমজীবী মানুষের দুর্দশা মচোনের জন্য ব্রাহ্মসমাজ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ৪. ব্যক্তি স্বাধীনতা, জাতীয় ঐক্য প্রভৃতি আদর্শ প্রচার করে ব্রাহ্মসমাজ গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটায়।