রাওলাট আইন বিরোধী আন্দোলনের সরকার কিরূপ দমনপীড়ন চালিয়েছিল?

সূচনা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী কার্যকলাপ ও গণ আন্দোলন করার উদ্দেশ্যে সরকার বিচারপতির স্যার সিডনি রাওলাটের সভাপতিত্বে পাঁচ জন সদস্যকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে করে। এই রাওলাট কমিশন বা সিডিশন কমিশন নামে পরিচিত। এই কমিটির সুপারিশ ভিত্তিতে সরকার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ১৩ মার্চ এক তীব্র দমন মূলক আইন পাস করে। এই আই টির আসল নাম ছিল দা অ্যানার্চিক্যাল এন্ড রেভ্যাল্যুশনারি অ্যআক্ট। এটি সাধারণভাবে রাওলাট আইন নামে পরিচিত।

রাওলাট আইন বিরোধী আন্দোলনের দমনপীড়ন

রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে সারাদেশে তীব্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সরকার পুলিশ ও সেনার তীব্র দমন নীতির আশ্রয় নেয়।

১. পুলিশি দমনপীড়ন

দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পাঞ্জাব এবং দিল্লিতে সংঘর্ষ ভয়ানক আকার ধারণ করে। পাঞ্জাব এবং দিল্লিতে এই সংঘর্ষ ভয়ানক আকার ধারণ করে। গান্ধীজী ডাকে ধর্মঘট 6 এপ্রিল যোগ দেওয়ার আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ পুলিশ চালালে ১৮ জন নিহত হয় প্রায় ১০০ জন আহত হয়। কলকাতায় কংগ্রেস এবং খিলাফত পন্থীদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়।

২. গান্ধীজীর গ্রেপ্তার

দিল্লি ও পাঞ্জাবের পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠলে পরিস্থিতি সামাল দিতে গান্ধীজীর 7 এপ্রিল দিল্লির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তিনি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পুলিশ ১০ এপ্রিল দিল্লি নিকটবর্তী পাল।ওয়াল স্টেশন তাকে গ্রেফতার করে বোম্বাই পাঠিয়ে দেয়। এই ঘটনায় বোম্বাই, আমেদাবাদ, বিরামাগাঁও সহ বিভিন্ন স্থানে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। গান্ধীজীর আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একেবারে সামনে সারিতে চলে আসেন। এ সময় থেকে গান্ধীজী নেতৃত্বে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক নতুন যোগ শুরু হয়। ডক্টর রবীন্দ্র কুমার বলেন রাওলাট সত্যাগ্রহের নেতৃত্বে দিয়ে গান্ধীজী প্রমাণ করেন যে, সর্বভারতীয় নেতৃত্ব গ্রহণের যোগ্যতা তারা আছে। অবশ্য রাহুল আর সত্যাগ্রহই হিংসার প্রবেশ করলে গান্ধীজী প্রচন্ড মর্মাহ্ত হয়ে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে এই আন্দোলন প্রত্যাহারা করে নেন।

৩. পাঞ্জাবের পরিস্থিতি

রাওলাট বিরোধী আন্দোলনের পাঞ্জাবের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে। পাঞ্জাবের মুখ্য প্রশাসক লেফটেন্যান্ট গর্ভনর স্যার মাইকেল ও ডায়ার এখানে নির্মম অত্যাচার শুরু করেন। তিনি পাঞ্জাবে ব্যাপক হারে গ্রেফতার ও সভা সমিতির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। রাওলাট আইনের প্রতিবাদ করা এবং হিংসায় মদত দেওয়ার অভিযোগে সরকার ১০ এপ্রিল ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে অমৃতসরের স্থানীয় ২ নেতা সৈফুদ্দিন কিচলু ও ডক্টর সত্য পালকে গ্রেফতার করে এবং বিনা বিচারে তাদের অজ্ঞতা স্থানে অন্তরীণ করে রাখে।

৪. অমৃতসরে গুলি বর্ষণ

পুলিশের নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদে অমৃতসরে শান্তিপূর্ণ মিছিল হলে ব্রিটিশ সরকার পুলিশ মিছিলে অংশগ্রহণকারী জনতার উপর গুলি চালায়। এতে কুড়িজন নিহত এবং প্রায় ১৫০ জন আহত হয়। এরপর ক্ষুব্ধ জনতা সরকারি অফিস, রেল স্টেশন, ইংরেজদের বাসস্থান প্রভৃতির উপর আক্রমণ চালায়।

৫. জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড

কুখ্যাত রাওলাট আইন বিরোধী আন্দোলনের সবচেয়ে নির্মম দমনপীঢড়নের ঘটনাটি ঘটে পাঞ্জাবের অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠে। রাওলা ডাইনির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে প্রায় দশ হাজার নিরস্ত্র মানুষ ১৩ এপ্রিল ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে এই মাঠের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ যোগ দেয়। পাঞ্জাবের সামরিক শাসন মাইকেল ও ডায়ারের নেতৃত্বে সেনা ও পুলিশ এডমিশন বাহিনী সমাবেশ জনতার উপর নির্বিচারের ৫০ টি রাইফেল থেকে অন্তত দশ মিনিট ১৬০০ রাউন্ড গুলি চালালে শিশু, নারীসহ অন্তত দশ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।

৬. সামরিক আইন জারি

জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ এপ্রিলে এক মিটিংয়ে ডায়ার সহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসার যে বিবৃতি দেন প্রকৃতপক্ষে তা ছিল ভারতীয়দের প্রতি হুমকি। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার পর সরকার অমৃতসর সহ পাঞ্জাব পাঁচটি জেলায় সামরিক আইন জারি করে। ভারতীয় আইনজীবীরা হরতালে অংশ নেওয়ার সামরিক আইন এর দ্বারা তাদের নানাভাবে শাস্তি দেওয়া হয়। বিশ্বের আদালত গঠন করে অন্তত একান্ন জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বহু মানুষকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া মার্শাল ল কমিশন ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে গঠন করে প্রকাশ্য রাজপথে বেত্রাঘাত, হাত ও কোমরের শেকল বা দড়ি বেঁধে ঘোরানোর প্রভৃতি অত্যাচারে চলতে থাকে।

উপসংহার

পুলিশ সীমাহীন বর্বর দমনপীড়নের ফলে রাওলাট ও বিরোধী আন্দোলন দুর্বল হতে বাধ্য হয়। তবে এই বর্বর দমন পীড়ন জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ কি নতুন করে সজাগ করে। ব্রিটিশ সরকার জেনারেল ডায়ারকে সমর্থন করলেও পুলিশী দমন পীড়নের প্রতিবাদে সারাদেশ ঘৃণা ও ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সারা বিশ্বে শিহরিত হয়। দেশ-বিদেশ সর্বোচ্চ সরকারের নগ্ন স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ঝড় ওঠে। ঐতিহাসিক দীপাণ চন্দ্র বলেছেন যে, “পাঞ্জাবের ঘটনা দেশের মানুষের কাছে সভ্যতা ও সাম্রাজ্যবাদের মুখোশধারী বিদেশী শাসনের কুৎসিত ও ভয়াবহ রূপটি প্রকাশ করে দেয়।” সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “জালিয়ান‌ওয়ালাবাগের ভয়াবহ ঘটনা সমগ্র ভারতকে এক মহাযুদ্ধের আগুন জেলে দেয়। তা উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম ছড়িয়ে পড়ে সবার হৃদয় ক্রোধের সঞ্চার করে।” জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া নাইট উপাধি ঘৃণাভরে ত্যাগ করেন।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment