মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা কি? এই পরিকল্পনার মাধ্যমে কিভাবে ভারত বিভাগ করা হয়?

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা

ভূমিকা

স্বাধীনতা লাভের জন্য ভারতবর্ষের তীব্র সংগ্রাম ব্রিটিশদের বাধ্য করে স্বাধীনতা দানের প্রশ্নে মীমাংসা করতে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অবসান ঘটতে ব্রিটিশ সরকার দেশ বা অনিবার্য বলে মেনে নেয়। এই সময় ভারতের নানা প্রান্তে সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বলছে। মাউন্টব্যাটেনের একান্ত সচিব জর্জ এবেল তাকে জানান যে ভারত বর্ষ গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছে। জিন্নার পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবি এবং তাতে জ‌ওহরলাল ও প্যাটেলের সম্মতি থাকায় মাউন্টব্যাটনের উপদেষ্টা ইসমে ভারত ভাগে পরিকল্পনা ব্রিটিশ পার্লামেন্ট পাঠায় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ৬ মে। পার্লামেন্টের প্রস্তাবিত ভারতীয় স্বাধীনতা আইন রূপে পাশ হয় যদিও রাজকীয় সম্মতি লাভ করে 1947 খ্রিস্টাব্দে ২৮ জুলাই যা মাউন্টব্যাটনে পরিকল্পনা চূড়ান্ত পরিমাণ ছিল বেশভাগ।

১. পটভূমি

(১) মাউন্টব্যাটেনের আগমন : ভারত ক্ষমতা হস্তান্তর কাজ দ্রুত সম্পাদনের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট লর্ড ওয়াভেলের জায়গায় মাউন্টব্যাটনকে ভাইসযরয় নিয়োগ করে ভারতে পাঠায় ২২ শে মার্চ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে।

(২) মাউন্টব্যাটেনের লক্ষ্য : মাউন্টব্যাটনের লক্ষ্য ছিল অখণ্ড ভারত তাই ২৮ মার্চ থেকে ছয় মে র মধ্যে তিনি ভারতীয় নেত্রী মন্ডলী ও রাজন্যগর্ভের সঙ্গে ১৩৩টি বৈঠক করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই নতুন বড় লাট বুঝি নেন যে ভারত বিভাগ ছাড়া ভারতীয় সমস্যার কোন সমাধান নেই। একাজে বিলম্ব হলে পাঞ্জাব, বাংলা সহ, বহু স্থানে হিংসা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়বে আশঙ্কা করে পরামর্শের জন্য মে মাসে তিনি ইংল্যান্ড জান। ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদন নিয়ে ফিরে এসে তিনজন তিনি ভারতে বিভাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। তিনি জানেন সম্ভবত ১৫ ই আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পন্ন করা হবে। মাউন্টব্যাটনের এই পরিকল্পনা ও ঘোষণা মাউন্টব্যাটনের প্রস্তাব বা মাউন্টব্যাটন রোয়েদাদ নামে খ্যাত।

২. বিভিন্ন প্রস্তাব

মাউন্টব্যাটনের প্রস্তাবে বলা হয় –

(১) ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে ভারত পাকিস্তান নামে দুটি ডোমিনিয়নের সৃষ্টি করা হবে। ডওমইনইয়ন দুটি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভাবে নিজে নিজে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয় সমূহ পরিচালনা করবে।

(২) মুসলমান প্রধান প্রদেশ- সিন্ধু, ব্রিটিশ অধিকৃত বালুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব বাংলা নিয়ে পাকিস্তান গড়া হবে।

(৩) পাঞ্জাব ও বাংলাকে বিভক্ত করে কোন অঞ্চলকে কোন ডোমিনিয়ন সঙ্গে যুক্ত করা হবে তা নির্ধারণের জন্য একটি সীমানা নির্ধারণ কমিশন ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই গঠিত হবে।

(৪) আসামের শ্রীহট জেলা কোন ডোমিনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হবে তা গণভোটে স্থির হবে।

(৫) দেশীয় রাজ্যগুলি নিজে নিজেও রাজ্যের সর্বভঙ্গ ক্ষমতা লাভ করবে এবং ইচ্ছা করলে তারা যে কোন ডোমিনিয়নেথ যোগ দিতে পারবে।

(৬) যতদিন না সংবিধান রচিত হচ্ছে ততদিন ব্রিটিশ সরকার নিযুক্ত একজন গর্ভনর জেনারেলের ওই ডোমিনিয়নে থাকবেন।

(৭) প্রতি ডোমিনিয়নে নির্বাচিত গণপরিষদ বিজয় এলাকার সংবিধান রচনা করবে।

(৮) স্বাধীনতা লাভের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কোন আইন ওই দুই ডোমিনিয়নে বলবৎ থাকবে না। প্রতি ডোমিনিয়নে নির্বাচিত আইনসভা নিজের জন্য আইন রচনা করবে।

উপসংহার

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের সম্পূর্ণ রূপে বিপর্যস্ত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যে সূর্যাস্ত ঘটেছিল বহু রক্তঝরা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ১৯০ বছর পরে পুনরায় সেই স্বাধীনতার সূর্যোদয় ঘটে। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ ভারত দ্বিখন্ডিত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। ডক্টর অমলেশ ত্রিপাঠি তাই বলেছেন -“ভারতবর্ষের স্বাধীনতা মিথ্যা না হলেও তা জন্ম সূত্রে প্রতিবন্ধী”।

মাউন্টব্যাটনের পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারত বিভাজন পদ্ধতি

১. শীর্ষ নেতৃবর্গের সঙ্গে আলোচনার সূত্রে

ভাইসরয় মাউন্টব্যাটনে প্রায় দেড় মাসের মধ্যে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ২৪ মার্চ থেকে ৬ মে র মধ্যে গান্ধীজী, জ‌ওহরলাল, বল্লভ ভাই প্যাটেল, জিন্না ও দেশীয় রাজাদের সঙ্গে প্রায় ১৩৩ বার বৈঠক বসেন। ভারতের বিভাজন আটকানোর বিভিন্ন উদ্যোগ সত্ত্বেও জিন্নাত আর পাকিস্তান দাবিতে অনড় থাকে। জিন্নার সঙ্গে কথা বলে বড়লাটের ধারণা হয় যে, তিনি মানসিক বিকারগ্রস্ত। কিন্তু বড়লাটের সদর্থক ইচ্ছার অভাবে ও জিন্নার একগুইমির জন্য সকল আলোচনা এই ভেস্তে যায়। মাউন্টব্যাটনের উপলব্ধি করে যে কেবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশন নির্ধারিত ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে এক বিকল্প পরিকল্পনা রচনা করা দরকার।

২. বলকান পরিকল্পনা রচনার মাধ্যমে

বিকল্প পরিকল্পনা হিসেবে মাউন্টব্যাটনে বলকান পরিকল্পনা অনুসরণ করেন। এই পরিকল্পনায় পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের প্রস্তাব রাখা হয় এবং বলা যে সকল প্রদেশ সংবিধানিক সভায় যোগ দেবে তাদেরও ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু নেহেরু ও জিন্না এই পরিকল্পনাকে গ্রহণ না করায় বলকান পরিকল্পনা তার কার্যকারিতা হারায়। ভারতে বিভাজনের সমস্যা আরো জটিল হয়ে ওঠে।

৩. প্ল্যান পার্টি শাসনে রূপায়ণের দ্বারা

মাউন্টব্যাটনে হতোদ্যম না হয়ে দেশভাগ ও ক্ষমতার হস্তান্তর ওপর আরো বেশি করে জোর দেন। তিনি ভারত বিভাজন লক্ষ্যে ল্যান্ড পার্টির শাসন নামক এক পরিকল্পনা পেশ করেন। নেহেরু ও ভি. পি. মেননের সাহজও নিয়ে তিনি এই পরিকল্পনা রচনা করেন এই পরিকল্পনায় বলা হয়- ভারত ও পাকিস্তান দুই পক্ষের ডোমিনিয়ন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।

৪. ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাশের মাধ্যমে

মাউন্টব্যাটনের প্রস্তাব মিনি ব্রিটিশ সরকার ভারতের স্বাধীনতা বিল রচনা করে। বৃটেনের আইন সভায় পাস হওয়ায় ষোলো জুলাই পর সম্রাট ষষ্ঠ জর্জ বিলটিতে সম্মতি জ্ঞাপন করে ১৮ই জুলাই। বিল্ডিং আইনে পরিণত হলে বড়লাট মাউন্টব্যাটনে তা কার্যকর করে ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন ডোমিনিয়নের প্রতিষ্ঠা ঘটান।

৫. কংগ্রেস ও লীগের সাহায্য নিয়ে

গান্ধীজি ও মৌলোনা আজাদ দেশভাগের ঘোর বিরোধী হলেও নেহেরু ও ও প্যাটেলের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস কার্যকরী সমিতির শেষ পর্যন্ত ভারত বিভাজনে সায় দিয়েছিল। কংগ্রেসের পাশাপাশি মুসলিম লীগ ও মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব মেনে নিলে ভারতের বিভাজন সম্ভব হয়। আসলে পাঞ্জাব ও বাংলায় হাজার হাজার মুসলিম যেভাবে আলাদা রাষ্ট্রের দাবীতে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল তাকে বৈধতা দিয়েছিলেন মাউন্ট ব্যাটন। উইনস্টন চার্চিলের প্রলোচনায় প্ররোচিত হয়ে জিন্না নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিতে অনর থাকায় মাউন্টব্যাটনের পক্ষে ভারত বিভাজন করা সহজ হয়।

৬. প্রতিক্রিয়া

প্রথম দিকে গান্ধীজি, মৌলোনা আজাদ, আব্দুল গফ্ফার খান প্রমুখ কংগ্রেস নেতা মাউন্টব্যাটনে পরিকল্পনা ও দেশভাগের তীব্র বিরোধী ছিলেন। গান্ধীজী বলেন,”কেবলমাত্র আমার মৃতদেহের ওপর দিয়ে ভারত বিভাগ হতে পারে।” কিন্তু গৃহযুদ্ধের পর পৃথক পাকিস্তান ভার্সেস সৃষ্টি হলেও কয়েদে আজাম জিন্না সম্পন্ন খুশি হতে পারেননি।। সমগ্র বাংলা এবং পাঞ্জাবকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তা বাস্তবায়িত হয়নি।

মন্তব্য

ভারত বিভাজন তথা ভারত ও পাকিস্তান এই দুটি আলাদা রাষ্ট্রের সৃষ্টির জন্য মাউন্টব্যাটনে তার দায় এড়াতে পারে না। আসলে গৃহযুদ্ধ বন্ধ করার অজুহাতে মাউন্টব্যাটন প্রসঙ্গে মৌলোনা আবুল কালাম আজাদ তার ‌’India Wins Freedom’ নামক আত্মজীবনীতে লিখেছেন -মাউন্টব্যাটনে প্রথম পাকিস্তান গঠনের অনুকূলে মদ দেন এবং শাসন পরিষদে কংগ্রেস সদস্যদের মেনে এই মতলবের বীজ বপন করেন।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment