চরিত্রাঙ্কনে মুকুন্দরাম যে কতখানি দক্ষ শিল্পী তা তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়। অনেক সমালোচক মন্তব্য করেছেন যে, কবিকঙ্কন একালে জন্মগ্রহণ করলে সম্ভবত কবি না হয়ে ঔপন্যাসিক হতেন। উপন্যাসে যে সকল উপাদান ও লক্ষণ কাহিনিধারার কেন্দ্রবিন্দু ব্যক্তি-চরিত্রের বিকাশ তাদের অন্যতম।
যদিও আমাদের আলোচ্য বিষয় কালকেতু ও ফুল্লরা। তা সত্ত্বেও মুকুন্দরামের নিজস্ব সৃষ্টি মুরারি শীল চরিত্রটি আলোচনা করতেই হয়। তিনি চরিত্র সৃষ্টির যে দক্ষ কারিগর তার প্রমাণ মেলে এই চরিত্রের মাধ্যমে। চণ্ডী প্রদত্ত অঙ্গুরীর যথোচিত মূল্য লাভের জন্য কালকেতুর মুরারি শীলের নিকট আগমন। মুরারি শীল অত্যস্ত ধূর্ত। কালকেতু মুরারির কাছে মাংসের দরুণ কিছু ঋণ পেত। তাই কালকেতুর সাড়া পেয়ে তার আত্মগোপন-
খুড়া খুড়া ডাকে কালকেতু।
কোথা হে বণিক রাজ আছে কিছু গুপ্ত কাজ
আমি আইলাম তার হেতু।।”
মুরারি অর্থের গন্ধ পেয়ে তাড়াতাড়ি বাইরে আসে। মুরারিকে দেখে কালকেতু তার আগমনের হেতু জানায়। তখন কণ্ঠে অনুযোগের সুর এনে বলে মুরারি—
বাণ্যা বলে ভাইপো ইবে নাহি দেখিতে
এ তোর কেমন ব্যবহার।
কালকেতু উপযুক্ত মূল্য না পেয়ে অন্যত্র যাওয়ার কথা বলা মাত্র মুরারি বলে—
“ধর্ম কেতু ভায়া সনে কৈলু লেনা দেনা।
তাহা হইতে ভাইপো হইয়্যাছে সেয়ানা।।”
কবির জীবন দৃষ্টি যে কতটা তীক্ষ্ণ, স্বচ্ছ এবং অভিজ্ঞতা লব্ধ তার প্রমাণ এখানে পাওয়া যায়।
কালকেতু-চরিত্র : কবিকঙ্কণ পৌরাণিক আদর্শে অসাধারণ বীররূপে কালকেতুকে অঙ্কন কালকেতুর প্রসঙ্গে বিশ্বকবির একটি মন্তব্য স্মরণীয়—‘বিকৃত বৃহৎ স্থানু মাত্র’। তবে চরিত্রটি একেবারেই অকর্মণ্য তো বলা যায় না।
কালকেতু শাপভ্রষ্ট দেবতা সে ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বর। মর্ত্যে দেবী চণ্ডিকার পূজা প্রচারের জন্য ব্যাধ গৃহে তার জন্ম। ধর্মকেতু তার পিতা ও মাতা নিদয়া। কাহিনিতে কালকেতু নায়ক, পৌরাণিক বীরদের মতো তার বীরত্ব প্রকাশে কবি বলতে চেয়েছেন –কালকেতু বীর ভীমের সমতুল্য। সুঠাম তার দৈহিক গঠন। এ প্রসঙ্গে কবি বলেছেন—
‘কপাট বিশাল বলে নিন্দি ইন্দবর মুখ
আকর্ণ দীঘল বিলোচন।
গতি যিনি গজরাজ কেশরী জিনিয়া মাঝ
মোতি পাঁতি জিনিয়া দশন।
বিধিমত পূর্বে ঠিক করা সঞ্জয়কেতুর কন্যার সাথে বিবাহ সম্পন্ন হল কালকেতুর। স্বামী হিসাবে কালকেতু আদর্শবান। স্ত্রী ফুল্লরাকে সে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। তাই যেদিন শিকার না মেলে কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে সে বলে—
“দুঃখিনী ফুল্লরা মোর আছে পতি আশে।
কেমন করে দণ্ডাইব যেয়্যা তার পাশে।।”
অন্যত্র আরও প্রমাণ মেলে। দেবী সুন্দরী বেশে ফুল্লরার গৃহে অবতীর্ণ হলে সতীন ভয়ে ভীত হয়ে ফুল্লরা কালকেতুর নিকটে কাঁদলে কালকেতু বলে ওঠে—
“শাশুড়ী ননদী নাহি, নাহি তোর সতা।
কার সনে দ্বন্দ্ব করি চক্ষু কইলি রাতা।।”
কালকেতু মুর্খ হলেও সহজ রূপে সহজ বিষয়গুলি বুঝে নিত। দেবী প্রদত্ত আংটি যখন সে চতুর মুরারি শীলের কাছে গিয়ে সঠিক অর্থ পায় না তখন তর্কে না গিয়ে স্পষ্ট বলেছে—
“খুড়া মূল্য নাহি পাই।
যে জন দিয়াছে ইহা তার ঠাঁই যাই।”
কালকেতুর জীবনের সহজ সরল রূপটি ফুটে উঠেছে দেবীর প্রতি সন্দেহ প্রকাশে—
“পশ্চাদে চণ্ডিকা যান আগে কালু যায়
ফিরি ফিরি কালকেতু পিছু পানে চায়।।
মনে মনে কালকেতু করেন যুকতি।
ধনঘড়া নিয়ে পাছে পালায় পার্বতী।।”
কালকেতুর ভোজন দৃশ্যের কথা স্মরণ করে সমালোচক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন—“ব্যাধবীরের ভোজনের বর্ণনায় ডাইনিং হলে লাঞ্চ প্রত্যাশি বিলাসী ভাদ্রসম্প্রদায় সে আঁকাইয়া উঠিবেন তাহাতে সন্দেহ নাই।” দোষে গুণেই তো মানুষ। দোষেগুণে ব্যঙ্গ বিদ্রুপে রসিকতায় জীবন্ত মানুষরূপে প্রতিফলিত হয়েছে।
ফুল্লরা-চরিত্র : কালকেতুর মতো ফুল্লরার জীবনের জন্ম থেকে প্রতিটি স্তর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ এ চিত্রিত হয়নি। গোলাহাটে মাংস পশারিনী মাতা হীরাবতীর সাথে উপস্থিত ফুল্লরা যুবতী ও বিবাহযোগ্য কন্যা। দেবযোগে তার বিবাহ হয় কালকেতুর সাথে। নববধূ বাড়ীতে এসে শাশুড়ীর হৃদয় জয় করে। সে গৃহকর্মে নিপুণা, শুধু তাই নয়—
“যেদিন যতেক পায় সেদিন তাহাই খায়
দেড়ি অন্ন নাহি থাকে ঘরে।
তিনবান শরাসন বিনা আর নাহি ধন
বন্ধ্যা দিতে পারে না উধারে।।”
নিরন্ন সহায়হীন পরিবারে এর চেয়ে আর কোনগুণই বধূর কাছে প্রত্যাশা করা যায় না।
ফুল্লরার মধ্যে সহনশীলতা ও ভারতীয় আদর্শ নারীর ঐক্যবোধ পরিলক্ষিত হয়। উচ্চবর্ণের সঙ্গে তার জীবন চেতনার বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। চিৎকার করে পসরা হেঁকে যে নারীর পথ চলতে হয় তার সহনশীলতা, নম্রতা, কথাবার্তা অন্যান্য সতী সাধ্বী নারীদের থেকে আলাদা। সাংসারিক জীবনে দুঃখকষ্টকে সে নারী সহ্য করবে কিন্তু সে দুঃখকষ্ট যদি স্বামীর অপদার্থতার জন্য হয় তবে সে তাকে ক্ষমা করে না। তীব্র ভর্ৎসনা করে—
“বিধাতে আমারে দণ্ডী জিয়ন্ত স্বামীতে রান্ডী
কৈল দৈব দুঃখের ভাজন।।”
দেবী চণ্ডিকাকে ফুল্লরা যখন তার ব্যক্তিজীবনের দুঃখ বর্ণনা করে বিতাড়িত করতে পারল না তখন শাস্ত্রীয় বচনের আশ্রয় নেয়—
“স্বামী যে পরম পতি স্বামী বিনে অন্যগতি
কেহ নহে সুখ মোক্ষদাতা।”
সমস্ত কিছু মিটে যাবার পরও দেবীকে বিশ্বাস করতে পারেননি ফুল্লরা। স্বামীকে দেবীপ্রদত্ত আংটিটি নিতে নিষেধ করেছে। এর কিছুদিন পরে ফুল্লরা রাণী হয়। কিন্তু সে তার সারল্য বিসর্জন দেয়নি। এভাবেই ফুল্লরা আমাদের স্নেহ ও ভালবাসার পাত্রী হয়ে উঠেছে। পরিশেষে বলতে হয় মুকুন্দরাম ফুল্লরাকে অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে চিত্রিত করলেও তারমধ্যে দিয়ে স্ত্রীবুদ্ধির প্রতি মধ্যযুগীয় বক্র দৃষ্টি ভঙ্গি প্রকট হয়ে উঠেছে।