ভূমিকা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে এক দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ। হো-চি-মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনাম বাসী ১৯৪৫-৭৫ খ্রিস্টাব্দে যে সংগ্রাম চালিয়েছিল, তাই ইতিহাসে ভিয়েতনাম যুদ্ধ নামে পরিচিত। তৃতীয় বিশ্বের উপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রামকে গৌরবান্বিত করেছিল এই ভিয়েতনাম যুদ্ধ। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভিয়েতনামিরা প্রথমে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ ও পরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে ধ্বংস করে স্বাধীনতা অর্জন করে।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ
« পটভূমি
যে সমস্ত ঘটনা ভিয়েতনাম যুদ্ধের পটভূমি রচনায় সাহায্য করেছিল, সেগুলি হল –
১. দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার উপনিবেশিক বিরোধিতা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়, শ্যাম, ব্রহ্মদের সহ বিভিন্ন দেশের উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল যার অংশীদার হয়েছিল হো-চি-মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনাম ও।
২. রুশো-জাপান যুদ্ধের ফলাফল
রুশো জাপান যুদ্ধের ফলাফল জাপানের অনুকূলে যাওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবাসীর মতো ভিয়েতনাম বাসীর মন থেকেও শ্বেতাঙ্গ ভীতি দূর হয়।। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ভিয়েতনামিও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন ঠেকানো সম্ভব।
৩. চীনের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব
১৯১১ খ্রিস্টাব্দে চীনে প্রজাতন্ত্রের বিপ্লব এবং সান-ইয়াৎ-সেনের জাতীয়তাবাদী ভাবধারার উদ্বুদ্ধ হয়ে ভিয়েতনাম বাসীরা ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তৈরি হয়।
৪. আমেরিকার হস্তক্ষেপ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশেষে যেভাবে ভিয়েতনামের অভ্যন্তরীণ সমস্যার হস্তক্ষেপ করে তাতে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামা বাসীদের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে যায়, পরিমাণেও যুদ্ধ বাঁধে।
« ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রথম পর্ব ১৯৪৫-৫৪ খ্রিস্টাব্দ
১. ফরাসি নীতি
ফ্রান্স প্রথম দক্ষিণ ইন্দ্রচীনে আধিপত্য কায়েম করেছিল। কিন্তু ফ্রান্স শুধুমাত্র তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে রাজি ছিল না। সে চেয়েছিল গোটা ইন্দ্রচীনের ফরাসি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে। অপরদিকে হো-চি-মিন চেয়েছিলেন ভিয়েতনামের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধের সূচনা ঘটে।
২. ভিয়েতমিন ফ্রান্স চুক্তি
ভিয়েতনাম সংঘর্ষে প্রথম দিকে ভিয়েতমিন ও ফ্রান্সের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ১ মার্চ জাতীয় ফ্রান্স ভিয়েতনাম কে ইন্দ্রচীন ফেডারেশন ও ফরাসি ইউনিয়নের অংশ রূপে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর মাসের ফ্রান্স হাইফং অঞ্চল বোমা নিক্ষেপ করে ৬ হাজার নিরীহ অসামরিক ভিয়েতনামিক কে হত্যা করলে সংঘর্ষ শুরু হয়।
৩. ইন্দ্রচীনে স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর থেকে টানা তিন বছর সংঘর্ষের পর বাও-দাইয়ের নেতৃত্বে ইন্দ্রচিনী এক স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও নবগঠিত সরকারকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে। এদিকে উভয় ভিয়েতনামে হো-চি-মিনের সরকারকে চীন ও রাশিয়া সমর্থন জানায়।
৪. নেভারের প্ল্যান-দিয়েন-বিয়েন-ফু ঘটনা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সকে ১০০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য করে। তবুও ফরাসি বাহিনী ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে শেষ দিক থেকে একের পর এক রণক্ষেত্র হারাতে থাকে। ১৯৫৪ খ্রিস্টাবের প্রথম দিকে হ্যানয় ও হাইফং এর মত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ও ফ্রান্সের হাতছাড়া হয়। এই অবস্থায় ফরাসি সেনাপতি নেভার ভিয়েত হিন্দের সম্পূর্ণ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে এক নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যা নেভারে প্ল্যান নামে পরিচিত।
এই পরিকল্পনা অনুসারে ফ্রান্স উত্তর ভিয়েতনামের টংকিং এর দিয়েন-বিয়েন-ফু নামে একটি স্থানে অস্ত্রশস্ত্র সমেত একটি দুর্ভেদ্য ঘাঁটি নির্মাণ করে। কিন্তু যেভাবেই হোক দিয়েন-বিয়েন-ফু ফরাসি খাঁটি নির্মাণের খবর ভিয়েতমিন দের কাছে পৌঁছে যায়। এর প্রেক্ষিতে যথাযথ প্রস্তুতির পর সেনাপতি জেনারেল নগুয়েন গিয়াপের সময়োচিত আক্রমণ ভি এডমিন সেনারা প্রায় ১৫০০০ অবরুদ্ধ থাকার পর ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে ফরাসি রাজ জেনারেল নলেন গিয়াপের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হন।
« জেনেভা সম্মেলন ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ
দিয়েন-বিয়েন-ফুর যদি চূড়ান্ত পরাজয়ের পর ফরাসি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে তার পরদিনই ৮ মে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে জেনে ভাই ইন্দ্রচীন সমস্যার সমাধান কল্পে একটি সম্মেলন বসে। জেনেভা সম্মেলনে কুড়ি জুলাই যুদ্ধ বিরোধী চুক্তি সম্পাদিত হয়। নির্ধারিত হয় –
(১) ১৭ ডিগ্রি অক্ষরেখা বরাবর ভিয়েতনাম কে দুই ভাগে ভাগ করা হবে।
(২) ওই অক্ষরেখায় উত্তর অঞ্চলের ভিয়েতমীনদের এবং দক্ষিণ অঞ্চলে ফরাসি নিয়ন্ত্রণাধীন ন-দিন-দিয়েম শাসন প্রতিষ্ঠা হবে।
(৩) উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের কোথাও কোন বিদেশী সেনা থাকবে না।
(৪) ভিয়েতনামের ওই বিভাজন হবে সম্পূর্ণ অস্থায়ী।
(৫) শান্তিপূর্ণ উপায়ে দুই ভিয়েতনামের মিলনের জন্য রাষ্ট্র সংঘ গঠিত একটি তদারকী কমিশনের নেতৃত্বে নির্বাচন আহ্বান করা হবে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে।
« ভিয়েতনাম যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব ১৯৫৬- ৭৫ খ্রিষ্টাব্দ
১. জেনেভা সম্মেলনের ব্যর্থতা
জেনেভা সম্মেলনে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের দ্বারা ভিয়েতনাম সমস্যা সমাধান হয়নি। জেনেভা সম্মেলন ভিয়েতনাম যুদ্ধের একটি অধ্যায়নের সমাপ্তি ঘটালে আরো একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। ফলে সমস্যা অবাহত থাকায় ভিয়েতনামের শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
২. যুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণ
দিনের পর দিন ইন্দ্রচীনরে হো-চি-মিনের প্রভাব বাড়তে থাকলে আমেরিকা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। ইন্দ্রোচিনের হো-চি-মিনের প্রভাব প্রতিপত্তিকে আটকানোর জন্য ফরাসি নিয়ন্ত্রণাধীন ন-দিন-দিয়েম কে দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি পদে বসানো হয়। এছাড়াও ম্যামিলা চুক্তি ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ ও স্বাক্ষরকারী দেশগুলিকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব গঠিত হয় সিয়াটো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি।
৩. ভিয়েত কংদের সঙ্গে সংঘর্ষ
উত্তর ভিয়েতনামে মার্কিন অপচেষ্টাকে রুখে দিয়ে হো-চি-মিন বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি রুপায়ন এর মধ্যে দিয়ে নিজের সরকারের জনপ্রিয়তা অক্ষুন্ন রাখেন। অপরদিকে দক্ষিণ ভিয়েতনামের দিয়েম সরকার নির্বাচনে বিরোধিতা করলে সমগ্র ইন্দ্রচীন জুড়ে প্রবল বিক্ষোভ দেখা দেয়। দক্ষিণ ভিয়েতনামে নবগঠিত জাতি মুক্তি ফ্রন্টের যোদ্ধা ভিয়েত কংদের সঙ্গে দিয়েম সরকারের সংঘর্ষ বাদে।
৪. স্বৈরাচারী দিয়েম সরকারের পতন
১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে নাগাদ ভিয়েত কংগদের বিরুদ্ধে মার্কিন ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম বাহিনী একজোট হয়ে আক্রমণ করে। ভিয়েতনামে মার্কিনী হস্তক্ষেপ এর বিরুদ্ধে গোটা বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। একদিকে গণঅভ্যুত্থানে দিয়েম সরকারের পতন ঘটে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর মাসে।
৫. স্বাধীন ভিয়েতনামের আত্মপ্রকাশ
১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে ২৩ জানুয়ারি উত্তর ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে আমেরিকার সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভিয়েতনাম থেকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাস নাগাদ দক্ষিণ ভিয়েতনামের জেনারেল ভ্যান-মিন সায়্যান ভিয়েত কংদের কাঁচা তো সমর্পণ করলে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম ঐক্যবদ্ধ হয়। আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন ঐক্যবদ্ধ সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম প্রজাতন্ত্রে।
« ভিয়েতনাম যুদ্ধের গুরুত্ব
১. আমেরিকার মর্যাদা হানিতে
ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে আমেরিকা কে শেষ পর্যন্ত লজ্জা, আপমান ও কলঙ্কের প্রত্যাবর্তন করতে হয়েছিল। এটা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমেরিকার মর্যাদা হানি ঘটে।
২. গেরিলা লড়াইয়ের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে
ভিয়েতনামাবাসীর গেরিলা পদ্ধতিতে মরণপণ লড়াইয়ে বিশ্ব এক শ্রেষ্ঠ শক্তির প্রথাগত যুদ্ধ পদ্ধতিকে তছনছ করে দিয়ে এই যুদ্ধের গুরুত্ব কে অনেক বাড়িয়ে দেয়।
৩. মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির দৈন্যতা প্রকাশে
এই যুদ্ধে আমেরিকার হস্তক্ষেপের বিশ্ব বাঁশি যেমন অনুমোদন করেনি তেমনি মার্কিন জনমত এ ব্যাপারে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির দৈন্যদশা প্রকট হয়।
৪. জন সমর্থনের অপরিহার্যতা প্রমাণ
জনগণের সাহায্যে ও সমর্থন ছাড়া কোন যুদ্ধে যে সাফল্য লাভ অসম্ভব তাই যুদ্ধে আরও একবার প্রমাণিত হয়।
উপসংহার
ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামকে এক দীর্ঘ অধ্যায়। মর্গ্যানথাউ তাই ভিয়েতনাম যুদ্ধকে মার্কিন শক্তি নিতে অপপ্রয়োগ বলে অবহিত করেছেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব জেনারেল উ-থান্টের মতে -“ভিয়েতনামের যুদ্ধে কমিউনিস্ট আগ্রাসনে যুদ্ধ নয় এটি বিদেশি, বিশেষত আমেরিকানদের বিরুদ্ধে এটি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ”।