সূচনা
ক্রিপস প্রস্তাব জনমানসে তীব্র অসন্তোষের জন্ম নেয় এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রচনা করে। ভারতের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বশেষ বৃহৎ মরিয়া গণ প্রচেষ্টা হল ভারত ছাড়ো আন্দোলন। গান্ধীজীর ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্যে হরিজন পত্রিকায় লেখেন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ২৪ মে – “ভারতকে ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দাও, যদি এটা খুব বেশি বলে মনে হয় তাহলে তাকে নৈরাজ্যের হাতে ছেড়ে চলে যাও”।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন
• পটভূমি
১.ক্রিপস প্রস্তাবের প্রভাব
ক্রিপসের প্রস্তাবে ভারতবাসী অনুভব করে যে -ইংরেজ সরকার কখনো স্বেচ্ছায় তাদেরকে স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেবে না। তাই স্বাধীনতা পেতে হলে সরকারি ইংরেজদের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।
২. ব্রিটিশ দমন নীতি
শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জবা হিসেবে ব্রিটিশ সরকার তার সামরিক বাহিনী দ্বারা ভারতবাসীর ওপর যে অকথ্য নির্যাতন, অত্যাচার চালিয়ে আসছিল তাতে ভারতীয়রা বিক্ষুব্ধ হয়ে মুক্তির পথ খুঁজতে শুরু করেছিল।
৩. দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের প্রয়োজনের তুলনায় খাদ্যের যোগান কম হওয়ায় মূল বৃদ্ধি ঘটে। চালের খুচরো দাম বেড়ে হয় ৩০-৩৫ টাকা পতি মণ, কেরোসিন, কাপড়, ওষুধপত্র প্রভৃতির দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে। এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা ফায়দা তোলার চেষ্টা করে। ব্রিটিশ সরকার এই অপ্রচেষ্টা আটকাতে যেমন উদ্যোগী হয়নি। ফলে ব্রিটিশের ওপর ভারতবাসীর বিশ্বাস সম্পূর্ণ লুপ্ত হয় তারা ব্রিটিশ শাসনের অবসানের লক্ষ্যে সর্বশেষ গণ-আন্দোলনের শামিল হয়।
৪. স্বাধীনতার তীব্র আশঙ্কা
স্বাধীনতার জন্য ভারতবাসী আর বিন্দুমাত্র অপেক্ষা করতে রাজি ছিল না। অসহযোগ, আইন অমান্য আন্দোলন ভারতবাসী স্বাধীনতার আশঙ্কাকে মতো এক সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন গড়ে তুলে ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে। তাই ঐতিহাসিক আমলের ত্রিপাঠি লিখেছেন -“ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গান্ধী যতটা নেতা, ততটাই জনগণের ইচ্ছার দাস।”
৫. শীর্ষ নেতাদের জঙ্গি মনোভাব
ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে দেশের শীর্ষ নেতাদের জঙ্গি মানসিকতা, বিশেষত্ব গান্ধীজীর অমনীয় মনোভাব আরেকটি গণ আন্দোলনের পটভূমি রচনা করেছিল। গান্ধীজী দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ মন্ত্র ঘোষণা করেন। জওহরলাল এ সঙ্গে বলেছেন -“গান্ধীজিকে এটি পূর্বে আর কখনো এতটা ব্রিটিশ বিরোধী হতে দেখা যায়নি।
৬. জাপানি আক্রমণের সম্ভাবনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গনে ব্রিটিশ এর বিরুদ্ধে জাপানের অগ্রগতি ভারতবাসীর মনে যুগপৎ এক আশা ও আশঙ্কায় জন্ম দেয়। তারা আশঙ্কা করে এবার ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় জাপান আক্রমণ করবে। ব্রিটিশ ও সার্থ রক্ষার যুদ্ধে মরবে সাধারণ ভারতবাসী। এ আশঙ্কায় ভারতীয় নেতারা এক ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। মৌলানা আজাদের মতে, যাবানি আক্রমণে সম্ভাবনাই গান্ধীজিকে গণ আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেয়।
• অগ্রগতি বা প্রসার
প্রথমে এই আন্দোলন বোম্বাই, আমেদাবাদ, কলকাতা, পুনা, নাগপুর, কানপুরসহ বিভিন্ন শহরের শুরু হয়। জাতীয় নেতাদের গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ গতিতে আন্দোলন ভারতে সর্বোচ্চ ছড়িয়ে পড়ে। দেশ জুড়ে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল, বিক্ষোভ, মিছিল এবং বিক্ষিপ্ত গণ-অভ্যুণ্থান শুরু হয়। নেতৃত্বের অভাবে জনসাধারণ নিজেরাই আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। ইংরেজ তুমি ভারত ছাড়ো ভবনে আকাশে বাতাসে আলোড়িত হতে থাকে। ঐতিহাসিক ডক্টর বিপানচন্দ্র লিখেছেন, “জনগণের পুঞ্জিভূত খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে এক প্রবল আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। নেতৃত্বহীন এবং সংগঠনহীন জনতা যেভাবে খুশি সেই ভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শনে মেতে উঠেছিল।”
১. বাংলায়
বাংলায় আগস্ট আন্দোলন মূল কেন্দ্র ছিল কলকাতা, ঢাকা, মেদিনীপুর, হুগলিসহ বিভিন্ন জায়গা। মেদিনীপুর জেলায় তমলুক ও কাঁথি মহকুমা এই আন্দোলন সবচেয়ে তীব্র রূপ ধারণ করেছিল। মাতঙ্গিনী হাজরার নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এই জাতীয় সরকার ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ১৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ৮ আগস্ট পর্যন্ত টিকে ছিল। এছাড়াও দিনাজপুর, বীরভূম, ফরিদপুর, বরিশাল, হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান প্রভৃতি জেলাতেও আন্দোলন গণচরিত লাভ করে। মেদিনীপুরের আন্দোলনের ব্যাপকতা প্রসঙ্গে ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় একে ব্রিটিশ সরকারের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া স্বতঃস্ফূর্ত চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখযোগ্য করেছেন।
২. বিহারে
বিহারের মুঙ্গের, ভাগলপুর, মুজাফফরপুর, পূর্ণিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এই আন্দোলনের তীব্র রূপ ধারণ করেছিল। ওইসব জায়গায় আন্দোলনকারীর জাতীয় পতাকা তোলেন। উত্তর ভাগলপুরে এক জাতীয় সরকার গড়ে তোলা হয়। বিহারের দশটি জেলায় অন্তত ৮০ শতাংশ থানা বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়। জয় প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে এবং সিয়ারাম ও পরশুরাম নামক দুই পরিপ্লকিক দলের প্রভাবে আন্দোলন চরমে পৌঁছায়।
৩. যুক্ত প্রদেশে
যুক্ত প্রদেশের বালিয়া, আজামগড়, সুলতানপুর, যৌনপুর, গোরক্ষপুর প্রভৃতি জেলায় গান্ধীজীর করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে জনগণকে স্বাধীনতা লাভে ব্যাকুল করে। বালিয়া জেলায় চিতু পান্ডের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গড়ে ওঠে।
৪. ওড়িশায়
ওড়িশার বালেশ্বর, তালচের, কোরাপুট, কটকে বিক্ষিপ্তভাবে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের পুরো ভাগে ছিল ছাত্ররা। কোরাপুটে লক্ষ্মণ নায়কের নেতৃত্ব উপজাতি কৃষকরা সক্রিয় হয়। তালচেরে ‘চাব্বি মল্লা রাজ’ কায়েম হয়।
৫. অন্যান্য অঞ্চলে
মধ্যপ্রদেশের নাগপুর, অমরাবতী, বান্দ্রা, বেতুল ছিল এই আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র। মদন লাল বাগরি, নাগপুর ‘হিন্দুস্থান রেড আর্মি’ গঠন করেন। আসামের গোয়ালপাড়া, তেজপুর, বরপোতা অঞ্চলে, কেরলের কালিকটে, মাদ্রাজের মাদুরায় এ আন্দোলনের রেশ ছড়িয়ে পড়ে।
মূল্যায়ন
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গান্ধীজি ও জাতীয় শীর্ষ নেতৃবৃন্দ যে কোন মূল্যে স্বাধীনতা অর্জন করতে চেয়েছিলেন। এমনকি ব্রিটিশদের কবল থেকে মুক্ত হতে ভারতবাসী যদি নিজের হাতে অস্ত্র তুলে নেয় তাতেও গান্ধিজী আপত্তি ছিল না। তাই দেখা যায় অসহযোগ আন্দোলনের চৌরিচড়ার মতো একটি ঘটনায় গান্ধীজী আন্দোলন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেও আগস্ট আন্দোলনের আরো অনেক বেশি হিংসাত্মাক ঘটনা ঘটলেও তিনি আন্দোলনের রাস টেনে ধরেননি।