ভূমিকা
পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো- দা-গামা ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ৮ জুন চারটি জাহাজ নিয়ে সামরিক অভিযান শুরু করে। তিনি ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ১ মার্চ মোজাম্বিকে পৌঁছান। এরপর তিনি মালয়, ভারতের মালবার অঞ্চল প্রকৃতির স্থানে অবতরণ করেন। এইসব অঞ্চলের মসলা ইউরোপের বণিকরা ইউরোপের অত্যন্ত ২০০ থেকে ২৫০গুন বেশি দামে বিক্রি করতো। এরূপ লাভজনক ব্যবসা আকৃষ্ট হয়ে পর্তুগিজ, ডাচ বা ওলন্দাজ, ইংরেজ, ফরাসি, দিনেময় প্রভৃতি ইউরোপীয় উপনিবেশিক জাতিগুলি এশিয়ার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। ভারতসহ দূর প্রাচ্যের চীন এবং জাপানি ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের শিকার হয়। প্রথমে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে প্রবেশ করলেও পরে ধীরে ধীরে তারা এই সমস্ত দেশে নিজ নিজ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
ভারত ও দূরপ্রাচ্যের সাম্রাজ্যবাদ বিস্তার
ভারত
পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দের জলপথে ভারতের পশ্চিম উপকূল কালিকট বন্দরে এসে পৌঁছান। ভাস্কো-দা-গামা ভারতে আসার ফলে ইউরোপীয়রা ভারতে আসার জলপথের কথা জানতে পারে। ভৌগলিক আবিষ্কারের সুবাদে বাণিজ্যিক লক্ষ্য নিয়ে বণিক গোষ্ঠীগুলি ভারতে প্রবেশ করতে শুরু করে। পরে একে একে ওলন্দাজ, ব্রিটিশ, ফরাসি, পর্তুগিজ প্রভৃতি ইউরোপীয় বণিক গোষ্ঠীগুলি নিজে নিজেও বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যান্য বণিক কোম্পানিগুলিকে সরিয়ে দিয়ে ভারতে নিজেদের একাধিক পত্য প্রতিষ্ঠা করে।
মোগল সাম্রাজে দুর্বলতা ও অবক্ষয়ের সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া স্বপ্ন দেখে। পলাশীর যুদ্ধে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ জয়লাভের মাধ্যমে তাদের সে স্বপ্নপূরণ হয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ দমনের পর ভারতের শাসনভার চলে যায় কোম্পানির হাতে থেকে ইংল্যান্ডের রানীর হাতে। ইংল্যান্ডের রানী তার মনোনীত প্রতিনিধি অর্থাৎ ভাইসরয়ের মাধ্যমে ভারত শাসন করতে শুরু করে। ফলে ভারত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীনস্থ হয়।
দূরপ্রাচ্য
১. প্রথমিক পর্যায়
(১) চিনে : চিনির বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ইউরোপীয় বণিক জাতিগুলিকে প্রলুব্ধ করে। ষোড়শ শতকে পর্তুগিজ বণিক সম্প্রদায় চীন সরকারের নির্দেশকে অমান্য করে ম্যাকাও বন্দরে প্রবেশ করে এবং সেখানে পর্তুকি যাদিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী সময়ে একে একে স্পেনীয়, ওলন্দাজ, ইংরেজ ও ফরাসি বণিকগণ চীনের ম্যাকাও এবং ক্যান্টন বন্ধরে বাণিজ্যিক অধিকার লাভ করে। বিদেশে গণিতের অনুপ্রবেশ রোধে ব্যর্থ হয়েছেন সরকার তাদের ওপর নানা ধরনের বিধি নিষেধ আরোপ করে। প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ বা প্রথম অহিফেন যুদ্ধে ১৮৩৯-৪২ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের কাছে মানসু শাসকরা হেরে যান এবং অপমানজনক নানা কিং সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হন।
এই সন্ধির শর্তানুজা ইংরেজরা হংকং লাভ করে এবং চীনের ক্যান্টন সহ ৫ টি বন্ধ ইউরোপীয় বাণিজ্যের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এই পাঁচটি বন্দরে ইংরেজরা অতি রাষ্ট্রিক অধিকার লাভ করে। এরপর থেকে আমেরিকা, ফ্রান্স, সুইডেন এবং নরওয়ে ইত্যাদি দেশ চীনের সঙ্গে বাণিজ্যে আগ্রহ দেখা এবং বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। দ্বিতীয় ইঙ্গ চীন যুদ্ধ বা দ্বিতীয় যুদ্ধ ১৮৫৬-৬০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ও ফরাসি জ্যোতির কাছে জিন পরাজিত হয় এবং তিয়েনসিন এর সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এই সন্ধি দ্বারা চীনের এগারটি বন্ধ বিদেশীদের বাণিজ্যের জন্য খুলে দেওয়া হয়। পাশাপাশি চিনির খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার এবং বিদেশী দূতাবাস নির্মাণ প্রভৃতি অধিকার দেওয়া হয়। এভাবে চীন সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে প্রস্তুত হয়।
(২) জাপানে : উদীয়মান সূর্যের দেশ নামে পরিচিত জাপান ও দীর্ঘদিন নিজেকে বাইরে জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জাপানের এই বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটে। জাপানের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যের আকর্ষণে মার্কিন সেনাপতি কমোডর ম্যআথউ পেরি সাত টি যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে জাপানি প্রবেশ করে না ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে। মারকিং চাতুরির গাছে হার মেনে জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কানা গাওয়ার সন্ধি স্বাক্ষর করে। পরে একে একে ইংল্যান্ড, রাশিয়া, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশ জাপানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। পরবর্তী সময়ে জাপানের জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। জাপান পূর্বে স্বাক্ষরিত যাবতীয় বৈষ্ণব মূল চুক্তি বাতিল করে দেয়।
ইউরোপীয় দেশগুলো সাম্রাজ্যবাদী ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জাপা নিজেই সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। চীনের অধীনস্থ করিয়া দখল করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়, ফলে চীন জাপান যুদ্ধ বাদে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে। পরাজিত হয়ে চীন জাপানের সঙ্গে শিমনোশেকির ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এই সন্ধি বলে জাপান চীনের কাছ থেকে মাঞ্চুরিয়া দেশের লিয়া ও-টুং উপদ্বীপ, ফরমোজা ও পেসকাডোরেস দ্বীপপুঞ্জ লাভ করে। পাশাপাশি জাপানি বনেগা চিনে বাণিজ্যিক অধিকার এবং শিল্প পতিরা চীনে শিল্প কারখানা গড়ে তোলার অধিকার লাভ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ এই সন্ধির দ্বারা করিয়া একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি হলেও জাপান শীঘ্রই তা দখল করে নেয়।
২. পরবর্তী পর্যায়ে
(১) চীনে রাশিয়ার অনুপ্রবেশ : দূরপ্রাচ্যে জাপানের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে রাশিয়া ঈর্ষা পর্বণ হয়ে ওঠে। জাপানের অগ্রগতি রোধ করে রাশিয়া মাঞ্চুরিয়ান লিয়াও-টুং উপদ্বীপের দখল নেই। শুধু তাই নয় রাশিয়ায় চীনের উত্তর সীমান্তবর্তী মোঙ্গোলিয়ার আম্মুর উপত্যকা দখল করে এবং সেখানে ভ্লাডিভোস্টক বন্দর স্থাপন করে। এই বন্দরকে রেলপথে দিয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এছাড়াও লিয়াও-টুং উপদ্বীপের অর্থাৎ বন্দরকে ট্রান্স সাইবেরির রেলপথের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়।
(২) চীনের খন্ডকরণ : জাপান চীনের রুসো সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা শুরু করে। ফলে চীনকে ঘিরে রুশো জাপান বিরোধ বাঁধে। ব্রিটেন এবং অন্যান্য বিরোধী শক্তি গুলি অচিনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। জার্মানি কিয়াওচাও বন্দর দখল করে শান্টুং প্রদেশে ও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। ইংল্যান্ড ইয়াংসি উপত্যকা নিজেদের অতিরিক্ত প্রতিষ্ঠা করে। ফ্রান্স ইন্দ্র চীনের আনান থেকে চীনের অভ্যন্তর ভাগ পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ অধিকার পায়। তরমুজকে যেমন অনেকগুলি ফালি করে খাওয়া হয়, ইউরোপীয় শক্তিগুলি ঠিক তেমনি চীনকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে এবং নিজে নিজে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।
(৩) মুক্তদ্বার নীতি : বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ বলে চীনে টুকরো টুকরো করে চিনির বিভিন্ন অংশ দখল নিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে যে আগামী দিনে হয়তো চীন মার্কিন বাণিজ্যের আর কোন সুযোগ থাকবে না। তাই মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব জন হে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে তার বিখ্যাত মুক্ত দ্বারা নীতি (Open Door Policy) চীনের প্রয়োগ করার কথা ঘোষণা করেন। জন হে এই প্রস্তাব সংবলিত পত্র জিন দখল কারী রাষ্ট্রগুলির রাজধানী শহরের অর্থাৎ লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, সেন্ট পিটার্সবার্গ, রোমো টোকিও তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই প্রস্তাবে বলা হয় – (i) চীন সমস্ত দেশের কাছে সমান তাই চীনের সমস্ত বৈদেশিক রাষ্ট্র সমান বাণিজ্যিক অধিকার ভোগ করবে।
(ii) সমস্ত দেশের প্রতি একটি নির্দিষ্ট হারে ও তো বাণিজ্য শুক্ল ধার্য হবে। (iii) শুকনো আদায়ের দায়িত্ব থাকবে চীন সরকারের হাতে। (iv) চীনে রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও স্বাধীনতা মানতে হবে। বলা বাহুল্য রাশিয়ার ছাড়া চীনে বাণিজ্যে লিপ্ত অন্যান্য দেশগুলি এই মুক্ত দ্বারা নীতি গ্রহণ করে। পন্ডিত জহরলাল নেহেরু এই নীতিকে অদৃশ্য সাম্রাজ্যবাদ বলে অবহিত করেছেন। (v) রুশো জাপান যুদ্ধ : চীনে সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার সঙ্গে জাপানের যুদ্ধ বাদে। চীন বক্সার বিদ্রোহ ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ শুরু হলে মাঞ্চুরি আর রেলপথ রক্ষার অজুহাতে রুশ সেনাদল চীনে প্রবেশ করে এবং চীন সরকার সেই বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই সময় রাশিয়া সমস্ত মাঞ্চুরিয়ার অঞ্চল দখল করে নেয়।
ইতিপূর্ব জাপান ও মাঞ্চুরি আর অঞ্চলটি দখল করতে চেয়েছিল, তাই জাপান রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ১৯০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা করে। এই যুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হয় এবং জাপানের সঙ্গে পোর্টস মাউথের সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এই সন্ধির ফলে জাপান পুনরায় মাঞ্চুরি আর লিয়াও-টুং উপদ্বীপ লাভ করে। পরবর্তীকালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপান চীন জার্মান উপনিবেশ, শান্টুং দখল করে চীনে জার্মান উপনিবেশ, শান্টুং দখল করে চীনের ওপর ২১ দফা দাবি পেশ করে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে। এই দাবিগুলি চীন মেনে নেওয়ায় জাপান চীনে অতিরিক্ত বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা ভোগ করার সুযোগ পায়।