ভারতীয় সংবিধানের দর্শন যেভাবে প্রস্তাবনায় প্রতিফলিত হয়েছে তা আলােচনা করাে।

প্রস্তাবনা-ভারতীয় সংবিধানের দর্শনগত দিকের প্রতিফলন

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের সংগ্রামের শেষে ভারতের জাতীয় নেতারা স্বাধীন ভারতের যে নতুন রাজনৈতিক কাঠামাে গঠনের কথা ভেবেছিলেন, তা প্রস্তাবনায় স্থান পেয়েছে। ভি এন শুক্লার মতে, সাধারণভাবে প্রস্তাবনা সেইসব রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রকাশ করে, যেগুলিকে সংবিধান কার্যকর করতে আগ্রহী। গােলকনাথ মামলার রায় (১৯৬৭) দিতে গিয়ে সুপ্রিমকোর্টের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সংবিধানের আদর্শ ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রস্তাবনা সংক্ষেপে প্রকাশ করেছে।

ভারতীয় সংবিধানের রচয়িতারা ইউরোপের উদারনৈতিক রাজনৈতিক আদর্শ এবং পাশ্চাত্য দর্শন দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেজন্য ভারতীয় সংবিধানের দর্শনে পাশ্চাত্য প্রভাব সুস্পষ্ট। এ ছাড়া আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লব এবং রুশ বিপ্লবের নীতি ও আদর্শের দ্বারাও সংবিধানের রচয়িতারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। প্রস্তাবনার মধ্যে এগুলির আদর্শও প্রতিফলিত হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার বিষয়সমূহ এখানে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করা হল—

[1] আমরা ভারতের জনগণ: প্রস্তাবনার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একবারে শুরুতেই আমরা ভারতের জনগণ (We, the people of India) এই কথাগুলি বলা হয়েছে। এর অর্থ, ভারতে চরম সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী জনগণ এবং এই জনগণই সংবিধানের রচয়িতা। ড. আম্বেদকর এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ভারতে সংবিধানের উৎস জনগণ এবং এর কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমিকতা জনগণের হাতে অর্পণ করা হয়েছে। এ কে গােপালন বনাম মাদ্রাজ রাজ্য মামলার রায়দানকালে সুপ্রিমকোর্টের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, প্রস্তাবনা অনুযায়ী ভারতীয় জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।

[2] সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র ভারত: সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র (SOVEREIGN DEMOCRATIC REPUBLIC) বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ‘সার্বভৌম কথাটির তাৎপর্য হল ভারত অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক, উভয় দিক থেকে চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ভারতের ভৌগােলিক সীমারেখায় রাষ্ট্রীয় আইন চুড়ান্ত ও অপ্রতিহত। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ভারত সরকার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণে সক্ষম। কোনাে বিদেশি রাষ্ট্র বা বিদেশি সংস্থার নির্দেশে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত হয় না। ভারতে দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। সংবিধানে নাগরিকদের রাজনৈতিক ও পৌর অধিকারগুলি স্বীকৃত হয়েছে, সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠা এবং শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক উপায়ে সরকার পরিবর্তনের জন্য সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকার ব্যবস্থাকেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রস্তাবনায় ভারতকে সাধারণতান্ত্রিক দেশ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ, ভারতে কোনাে রাজা বা রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব নেই। এখানে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সরকার পরিচালনা করে এবং জনগণই হল সার্বভৌম শক্তির আধার।

[3] সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারত: প্রস্তাবনায় আরও দুটি তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ ১৯৭৬ সালের ৪২তম সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে সংযােজিত হয়েছে। শব্দদুটি হল ‘সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ (Socialist & Secular)। অর্থাৎ, ভারতকে একটি সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তােলার কথা ঘােষিত হয়েছে। সমাজতন্ত্র বলতে উৎপাদনের উপকরণগুলির ওপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা এবং উৎপাদিত সম্পদের সমবণ্টনকে বােঝায়। কিন্তু ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় এই অর্থে সমাজতান্ত্রিক শব্দটি সংযােজিত হয়নি। ভারতে ‘গণতান্ত্রিক সমাজবাদের আদর্শকে গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে ‘মিশ্র অর্থনীতি- র মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রাচীন ভারতের এক মহান আদর্শ। পরমতসহিষ্ণুতার যে সনাতন ঐতিহ্য ভারতে বহু প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত ছিল, তারই পরিবর্তিত রূপ হল ধর্মনিরপেক্ষতা। তাই ধর্ম-সংক্রান্ত ব্যাপারে রাষ্ট্র এখানে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। রাষ্ট্র কোনাে বিশেষ ধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা বা বিরোধিতা, কোনাটাই করে না।

[4] সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংকল্প ঘােষণা করা হয়েছে। প্রস্তাবনার এই আদর্শের প্রতিফলন ঘটেছে মূল সংবিধানের তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ে। তৃতীয় অধ্যায়ে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলিকে স্বীকৃতি দিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংকল্প দৃঢ়ভাবে ঘােষিত হয়েছে। এ ছাড়া সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ে নির্দেশমূলক নীতিগুলির মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়া হয়েছে।

[5] স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের প্রসার: সংবিধানের প্রস্তাবনায় চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতা (Liberty), মর্যাদা ও সুযােগসুবিধার ক্ষেত্রে সাম্য (Equality) এবং ব্যক্তির মর্যাদা এবং জাতির ঐক্য ও সংহতির নিশ্চয়তাসাধনে ভ্রাতৃত্ববােধের (Fraternity) প্রসারের কথা বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ববােধ গণতন্ত্রের মৌল ভিত্তিস্বরূপ৷ প্রস্তাবনায় সামগ্রিকভাবে এসব আদর্শকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

উপসংহার: ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার বিশ্লেষণ থেকে যে রাজনৈতিক ধ্যানধারণার পরিচয় পাওয়া গেল, তাতে পাশ্চাত্য দর্শনের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়। ইউরোপীয় উদারনৈতিক দর্শনের প্রতি সংবিধান-রচয়িতাদের আকর্ষণ প্রস্তাবনায় প্রতিফলিত হয়েছে। তবে সাম্য, ন্যায়, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ভ্রাতৃত্ববােধের ভারতীয় জীবনাদর্শও প্রস্তাবনায় স্থান পেয়েছে। এভাবে পাশ্চাত্য ও ভারতীয় দর্শনের মিলন সংবিধানের প্রস্তাবনার মধ্যে দেখা যায়।

Political Science (H.S-11) all Questions/Answers here

Leave a Comment