ভূমিকা
ভারতের ব্রিটিশ শাসনকালে সাম্প্রদায়িক বিভেদ যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। পন্ডিত জহরলাল নেহেরু বলেছেন যে, “কখনো ভুললে চলবে না, ভারতের সাম্প্রদায়িকতা হলো একটি পরবর্তীকালে ঘটনা যা আমাদের চোখের সামনে বিকশিত হয়েছে।” তবে এই বিভেদ উৎস এবং বিকাশ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ ব্রিটিশ সরকারের বিভাজন ও শাসন নীতি কে আবার অনেকে ঔপনিবেশিক অর্থনীতির কুফল কে, আবার কেউ কই হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের পৃথক স্বার্থ চিন্তাকে ভারতের সম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশের জন্য দায়ী করে থাকে।
১. সরকারের উদ্দেশ্য
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তি এ দেশের বিরোধী আন্দোলন দমন করে নিজেদের শাসন নিরাপদ ও দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে বিভাজন ও শাসন নীতি গ্রহণ করে। বিভাজন ও শাসন নীতির মূল কথা ছিল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ বৃদ্ধি করা। স্যার ডব্লিউ. এইচ. গ্রেগরি ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ডফরিনকে লিখেন, “আমি নিশ্চিন্ত যে মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ব্রিটিশ সরকারের কাছে খুবই ফলদায়ক হবে। শিক্ষিত মুসলিমরা হিন্দু ব্রাহ্মণ ও বাবুদের আন্দোলন থেকে দূরে থাকবে। মুসলিমদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।”
২. হিন্দু তোষণ
প্রথমদিকে সরকার ভারতের প্রাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে নিজেদেরকে অনুগত শ্রেণী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে। এই সময় মুসলিম সম্প্রদায় ভারতের ব্রিটিশ শাসন ও প্রশান্ত শিক্ষকের সাদরে গ্রহণ করেনি। এই অবস্থায় সরকার মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের সমর্থন করে। সরকার হিন্দুদের নিয়ে, হিন্দুদের নিয়ে গঠিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে তোর্ষণ করতে থাকে।
৩. সরকারি ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা
বিডি সরকার মুখে বহু ন্যায়নীতির কথা বলে এবং আইনের চোখে সাম্যনীতির কথা ঘোষণা করে। কিন্তু বাস্তবের সরকার ধর্ম ও সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণিকে আর্থিক সহায়তা দান, স্থানীয় ও প্রাদেশিক স্তরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সরকারি চাকরি নিয়োগ ব্যবস্থা করে। এর ফলে মুসলিম, বিভিন্ন অব্রাহ্মণ হিন্দু, ইঙ্গ ভারতীয় সম্প্রদায়ের প্রকৃতি সরকারী অর্থনৈতিক সহায়তা ও সুবিধা লাভ করে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে তাদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
৪. মুসলিম তোষণ
ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বে ভারতের মুসলিমরাই ছিল রাজশক্তি। কিন্তু ভারতের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলে হিন্দু সম্প্রদায়ের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সম্ভাবনার মুসলিম সম্প্রদায় আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। রাস্তা তো শিক্ষায় শিক্ষিত ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্ভূত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী হয়ে ওঠে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রদূত।
এই পরিস্থিতি সরকার হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের উসকে দেয় এবং মুসলিম তোষণ শুরু করে। আলীগড় আন্দোলনের নেতার স্যার সৈয়দ আহমদ ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আলীগড় ‘অ্যাংলো ওররিয়েন্টিল কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করে। এই আলিগড় কলেজে ও আলীগড় আন্দোলনের সঙ্গে চুক্তি আর্চিবোল্ট, থিওডোর বেক, মরিসন প্রমভ ইংরেজি হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মুসলিমদের মনে বিচ্ছিন্নতার মানসিকতা তৈরি করেন।
৫. পশ্চাদপদ শ্রেণীকে তোষণ
লিটি সরকারের প্রতি মুসলিম সম্প্রদায়ের অনুগত সুনিশ্চিত হওয়ার পর সরকার হিন্দু সম্প্রদায়কে উচ্চ বর্ণ ও অনকর্ষণ এই দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের অব্রাম ও অন্যান্য অগ্রসর শ্রেণীর প্রতি তোষণ নীতি গ্রহণ করে। আজমগরের ব্রিটিশ রাজদূত ইউটিস জে. কিটস ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে আদমশুমারি ভিত্তিতে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে অনগ্রসর শ্রেণীর একটি তালিকা করেন এবং শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে তাদের জন্য সংরক্ষণ ও বাড়ি সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
তৎকালীন সেক্রেটারি অফ স্টেট জর্জ ফ্রাঙ্কিস হ্যামিলটন ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে বড়লাট লর্ড কার্জনের লেখেন যে, আমরা যদি হিন্দুদের দুই সম্প্রদায় বিভক্ত করতে পারি তবে আমাদের শক্তি আরো শরীর হবে। সরকারের এই মনোভাবকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেণীর বিরুদ্ধে দাবী দাওয়া আদায়ের বিষয় সরকার অনকর্ষণ শ্রেণী নেতাদের উৎসাহী করতে থাকেন। মহীশূর, মাদ্রাজ, বোম্বাই প্রভৃতি প্রদেশ গুলিতে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ চালু হয়। যুক্ত প্রদেশের প্রতি চারটি আসনের মধ্যে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের জন্য একটি করে আসন সংরক্ষিত হয়।
উপসংহার
হিন্দু মুসলিম বিভাজন ছাড়াও সরকারি হিন্দুদের বিভিন্ন উপ সম্প্রদায়ের বিভক্ত করে। এভাবে সরকার অনগ্রসর সম্প্রদায়কে তাদের অনুগত শ্রেণীতে পরিণত করে জাতীয় আন্দোলন থেকে তাদের দূরে রাখার চেষ্টা চালায়। সরকারের বিভেদ নীতির ফলে অনগ্রসর শ্রেণির জন্য পৃথক নির্বাচন আইনসভা ও চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ প্রভৃতি দাবিতে ১৮২০ দর্শককে ডঃ আম্বেদকর নেতৃত্বে অনগ্রসর শ্রেণীর আন্দোলন গড়ে ওঠে। এভাবে ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সাম্প্রদায়িক বিভেদ চূড়ান্ত সমস্যা সৃষ্টি করে।