আমলাতন্ত্রের বিকাশ
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে ব্রিটিশ প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এদেশের আধুনিক ধাঁচের আমলাতন্ত্রের বিকাশ। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা বিহার উড়িষ্যা দেওয়ালি লাভের পর প্রথম দিকে ব্রিটেনের থেকে ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসনিক নীতিগুলি নির্ধারণ করা হতো। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে রেগুলেটিং অ্যাক্ট এর মাধ্যমে ভারতের গর্ভনর জেনারেল পদ সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে তার অধীনে ভারতের আমলাতন্ত্রের বিকাশ ঘটে। ভারতের আমলাতন্ত্রের বিকাশ সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-
১. আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠান
ব্রিটিশ ভারতের প্রকৃত আমলা তন্ত্র গড়ে তোলেন লর্ড কর্নওয়ালিস। তিনি ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে বড়লার নিযুক্ত হয়ে এ বিষয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেন, যেমন-
(১) কোম্পানির কর্মচারীদের কাজে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়, যথা- ১. রাজনৈতিক কাজ ও ২. বাণিজ্যিক কাজ।
(২) কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য ও সব ধরনের অবৈধ আয়ের পথ বন্ধ করা হয়।
(৩) কর্মচারীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও দুর্নীতি দমন এর উদ্দেশ্যে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন কর্মপদ্ধতি ও নীতি প্রবর্তন করা হয়। এই কর্মপদ্ধতির কোড কর্নওয়ালিস নামে পরিচিত। এভাবে কর্নওয়ালিস ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের প্রবর্তন করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই সময় যোগ্যতার নির্ণায়ক পরীক্ষার মাধ্যম নয়, মনোনয়নের মাধ্যমে আমলাদের নিয়োগ করা হতো।
২. প্রশিক্ষণ কলেজ
ভারতের ব্রিটিশ আমলাদের কাজের জন্য ভারতীয় ভাষা, রীতিনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ে জ্ঞানের খুবই প্রয়োজন ছিল। এই প্রয়োজনীয়তা মেটানোর উদ্দেশ্যে বড়লাট লর্ড ওয়েলসলির ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। ব্রিটিশ আমলারা কাজে নিযুক্ত হওয়ার আগে এখানে তিন বছরের প্রশিক্ষণ নেওয়ার নিয়ম করা হয়।। পরবর্তীকালে কোম্পানির পরিচালক বর্গের আপত্তিতে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে কলেজটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরিবর্তে ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের কাজে হাইফোর্ডে ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরে হেইলেবেরিতে স্থানান্তরিক হয়। ভারতে আমলা পদে নিযুক্ত হওয়ার জন্য সকল প্রার্থীকে এই কলেজের দু বছরের প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
৩. যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষা
প্রথম দিকে সুপারিশ ও মনোনয়নের মাধ্যমে ভারতীয় আম্লাদের নিয়োগ করা হলে ও পরবর্তীকালে এই পদ্ধতি বাতিল হয়।
(১) ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে নিযুক্ত হওয়ার জন্য ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে চার্টার অ্যাক্টে প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় পাস করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়।
(২) ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার আইন অনুসারে জন্মসূত্রের রানী সাম্রাজ্যের ১৮ থেকে ২৩ বছর বৈশিষ্ট্য সকল প্রজাই এই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বর্ষার অধিকার পায়।
(৩) সেই অনুসারে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে থেকে লন্ডন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস বা আই. সি. এস. পরীক্ষা শুরু হয়। এই পরীক্ষায় ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম পাশ করে আই.সি. এস. হন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
(৪) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে হেইলেবেরি কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সিভিল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অধ্যাপক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন যে, এখানে ক্রমে কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক আমলা তন্ত্রের ইস্পাত কাঠামোটি গড়ে ওঠে।
৪. ভারতীয়দের প্রতি বঞ্চনা
আমলাতন্ত্রের বিভিন্ন পদে ভারতীয়রা প্রবেশ খুব বেশি সুযোগ পায়নি।
(১) কর্নওয়ালিস ভারতীয়দের দুর্নীতি পরায়ন মনে করে সরকারের উচ্চপদ গুলিতে ভারতীয়দের নিয়োগ নিষিদ্ধ করেন।
(২) প্রথম দিকে প্রশাসনের নিম্ন পদে কিছু ভারতীয় নিয়োগের সুযোগ পেলেও ৫০০ পাউন্ড বা তার বেশি বেতনের উচ্চপদ গুলিতে ভারতীয়দের নিয়োগের সুযোগ ছিল না।
(৩) অবশ্য ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে অবাধ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে আমলাদের নিয়োগ শুরু হলে উচ্চপদস্থ গুলিতে কিছু কিছু ভারতীয় প্রবেশের সুযোগ পায়। কিন্তু তা সত্বেও সেসব পদের ভারতীয়দের নিয়োগের বাধা অবাহত ছিল। ভারতীয় সিভিল সার্ভিস এ নিযুক্ত পদাধিকারীদের মধ্যে ১৯১৪ ও ভারতীয় সিভিল সার্ভিস এ নিযুক্ত পদাধিকারীদের মধ্যে ১৯১৪ ও ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে যথাক্রমে ৫ শতাংশ ও ১৬ শতাংশ ছিলেন ভারতীয়।
৫. সিভিল সার্ভিস আন্দোলন
ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতার উনিশ শতকের দ্বিতীয় আগের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার কয়েকটি বিষয়ে বিরোধিতা করে আন্দোলন শুরু করে। (১) লর্ড লিটন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বর্ষার বয়স ২১ থেকে কমিয়ে ১৯ বছর করলে দেশ জুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয়। (২) পরীক্ষা দিতে বয়স ঊর্ধ্বসীমা ২২ বছর করার দাবি জানানো হয়। (৩) ইংল্যান্ডের মতো ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা গ্রনের দাবি জানানো হয়। লর্ড রিপন ১৮৮০-৮৪ ফিস্ট আমাদের ভারতের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা গ্রহণের পক্ষপাতী হলে উচ্চ পদস্থ বহু ইংরেজ কর্মচারীর বিরোধিতা কার্যকর হতে পারেনি। অবশেষে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থার সংস্কার করা হয়।
উপসংহার
ধারাবাহিক বিবর্তনের মাধ্যমে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস বা আমলা দ্বন্দ্ব সমগ্র বিশ্বে একটি সুদক্ষ ও ক্ষমতা সম্পন্ন শ্রেণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ভারতীয় হামলার সততা, দক্ষতা, স্বাধীনচিত্ততা, কঠোর পরিশ্রম প্রভৃতির ক্ষেত্রে একটি ঐতিহ্য নজির সৃষ্টি হয়। ভারতীয় আমরা দ্বন্দ্বকে বৃদ্ধি শাসনের ইস্পাত কাঠামো বলা হত। অবশ্যই আমলাতন্ত্রের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থ রক্ষা করা। ফলে ভারতীয়দের কোন উপকার হয়নি। স্যার ভারতীয় আমরা ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল।