সূচনা
ব্রিটিশ সরকার ভারতের বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে এদেশের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ধ্বংসের চেষ্টা চালিয়েছিল। তবে ক্ষেত্রে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার কিছু রীতি, সংস্কার কম দায়ি ছিল না। মধ্য ভারতের হিন্দু বলয়ে দক্ষিণ ভারতের, বিশেষ করে কেরালায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এরূপ সম্প্রদায়িক বিভেদ ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। দলের হিন্দু সম্প্রদায় গান্ধীজি যাদের হরিজন নামে ডাকতেন নানা ধরনের সমাজে বৈষ্ণবের শিকার হয়েছিল। মধ্য ভারতের অনগ্রসর ও অস্পৃশ্য মাহার সম্প্রদায় ও হরিজন এবং দক্ষিণ ভারতে ইঝাবা ও পুলায়া সম্প্রদায়ের কথা বলা যায়, যারা বর্ণ হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতিত হতেন।
মধ্য ভারতীয় দলিত সম্প্রদায়ের প্রতি সামাজিক বৈষম্য
মধ্য ভারতের মধ্যপ্রদেশের মাহার নামে এক অস্পৃশ্য ও অনগ্রসর হরিজন হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস করত। তাদের অধিকাংশই ঝাড়ুদার, জুতো তৈরি প্রভৃতি নিম্ন স্তরের পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিল। কেউ কেউ চাষের কাজ করতো। এই অনগ্রসর শ্রেণীবর্ণ হিন্দুদের দাঁড়া নানান সামাজিক বৈষ্ণবের শিকার হয়েছিল, যেমন-
(১) তারা সমাজে পশুর চেয়েও অধম জীব বলে গণ্য হতো।
(২) তারা সর্বসাধারণের ব্যবহার করা থেকে পালিয়ে জল নিতে পারত না।
(৩) হিন্দু মন্দির প্রবেশে ও তাদের অধিকার ছিল না।
(৪) তাদের জন্য ধোপা ও নাপিত বন্ধ ছিল।
(৫) অধিকাংশ ক্ষেত্রে দলিত হিন্দুদের সন্তান বর্ণ হিন্দুদের আধিপত্য কারী বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেতো না।
(৬) যেসব বিদ্যালয়ের হরিজন শিক্ষার্থীরা ভর্তি সুযোগ পেতো সেখানে তারা বর্ণ হিন্দু শিক্ষার্থীদের পাশে বসতে পারত না।।
(৭) তারা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের কোন সুযোগ পেত না।
আন্দোলনের সূত্রপোত ও প্রসার
মধ্য প্রদেশের মা হারা সম্প্রদায়ের অন্যতম নেতা ছিলেন ডক্টর ভীমারা ও আম্বেদকর ১৮৯১-১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে। তিনি মধ্যপ্রদেশের মাহারা সম্প্রদায় ভুক্ত এক পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সামাজিক বৈষম্যের প্রতিবাদে নিম্ন বর্ণের হরিজনদের নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন।
১. মাহাদ মার্চ
অস্পৃশ্য সম্প্রদায়কে জনসাধারণ জলাশয় থেকে নেওয়ার অধিকার দেয়া হতো না। এর প্রতিবাদে আম্বেদকর ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে বোম্বায়ের কোবালায় চৌদার জলাশয়ে মাহাদ মার্চ এর নেতৃত্ব দান। হিন্দু সম্প্রদায়ের বর্ণ বৈষ্ণবের ভিত্তিতে মনুস্মৃতি গ্রন্থটির কয়েকটি কপি আম্বেদকর নেতৃত্বে প্রকাশ্যে আগুনে পোড়ানো হয়। এভাবে বর্ণ হিন্দুদের প্রাধান্য ও বর্ণভেদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা হয়।
২. মন্দিরে প্রবেশের আন্দোলন
হরিজন ও অন্যান্য নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা হিন্দু মন্দিরের প্রবেশের অধিকার পেতো না। এর প্রতিবাদে আম্বেদকর ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে আন্দোলন শুরু করেন। আম্বেদকর বলেন, “ইউরোপীয় ক্লাব গুলিতে একদা লেখা থাকতো যে, ভারতীয় কুকুর প্রবেশের নিষেধ। এখন হিন্দু মন্দিরে অস্পৃশ্যদের প্রবেশ নিষেধ করে কি একই ধরনের অবজ্ঞা করা হচ্ছে না?” তার ডাকে নিম্ন বর্ণের মহারা সম্প্রদায়ের অগণিত মানুষ আন্দোলনে সামিল হয়। তারা মন্দিরে জলাশয় থেকে জল পান করলে মন্দিরের পুরোহিত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।। মন্দিরে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের প্রবেশ অধিকার দাবিতে 1930 খ্রিস্টাব্দের জোরদার আন্দোলন আরম্ভ হয়। এতে নেতৃত্ব দেন ডক্টর ভীমারা ও আম্বেদকর।
৩. কলারাম মন্দিরের আন্দোলন
মন্দিরে প্রবেশের দাবিতে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে থেকে ডঃ আম্বেদকর নেতৃত্বে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। তা নেতৃত্ব ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে নাসিকের কালার মন্দিরে নিম্নবর্নের হিন্দুদের প্রবেশাধিকার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। নিম্ন বর্ণের অন্তত ১৫ হাজার হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক এই মন্দিরের সিরাম চন্দ্রের বিগ্রহে পুজো দেওয়ার দাবি জানায়।
৪. সত্যাগ্রহ আন্দোলন
ডক্টর আম্বেদকর হিন্দু মন্দিরের দলিত হিন্দুদের প্রবেশ অধিকার দাবিতে মাসিকে এক সম্মেলনে ২ মার্চ 1930 খ্রিস্টাব্দে সত্যাগ্রহ আন্দোলন আরম্ভ করার কথা ঘোষণা করেন। মন্দিরের প্রবেশাধিকার দাবিতে তারা নেতৃত্বে নাসিকে আন্দোলনকারীদের দীর্ঘ একমাইল লম্বা মিছিল নয়, যার সেই সময় নিরিখে নাসিকের সবচেয়ে দীর্ঘ মিছিল ছিল। মিছিলে গিয়ে মন্দিরের সামনে গিয়ে দেখে যে মন্দিরের সমস্ত ফটো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে তারা প্রধান ফটোকের সামনে অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন।
৫. আক্রমণ
আম্বেদকর নেতৃত্বে কলারাম মন্দিরের সামনে প্রায় এক মাস ধরে দলিত হিন্দুদের সত্যাগ্রহ চলে। ৯ এপ্রিল আন্দোলনকারীরা মন্দিরের রথ স্পর্শ করলে উগ্রবর্ণ হিন্দুরা সত্যাগ্রহের ওপর তীব্র আক্রমণ শুরু করে। আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপক সংখ্যায় ইট ও পাথর ছড়া হয়। ফলে সারা শহরে দলিত বর্ণ হিন্দুদের মধ্যে সংঘর্ষণ শুরু হয়ে যায়। গোলমাল এর ফলে মন্দিরটির অন্তত এক বছর বন্ধ থাকে। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই উত্তেজনা চলে।
৬. আইন প্রণয়ন
মন্দিরের প্রবেশ অধিকার দাবির বন্ধু হওয়ার আন্দোলনের খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলনকারী শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের সহানু দুটি লাভ করে। নাসিকে আন্দোলন চলার সময় বোম্বাইয়ের প্রাদেশিক কংগ্রেস সরকার মন্দিরের প্রবেশ সংক্রান্ত বিল পাস করে। ফলের দলিত ও অস্পৃশ্যরা হিন্দু মন্দিরের প্রবেশ আংশিক অধিকার পায়। কিছুদিন পর মাদ্রাজ, মধ্যপ্রদেশে অন্যান্য আইনসভার ও এবিষয়ে আইন পাস করে।
উপসংহার
সামাজিক বৈষ্ণবের প্রতিবাদে দলিত হিন্দু সম্প্রদায়ের উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু করে, তা দলিতদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলে। ডক্টর আম্বেদকর হয়ে ওঠেন ভারতের দলিত ও অস্পৃশ্য হিন্দুদের অবিসংবাদী নেতা। তা নেতৃত্বে আন্দোলনের দ্বারা দলিতরা ভবিষ্যতের আরো বহু রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার লাভ করে।