বিশ্বায়নের প্রতিক্রিয়া
বিশ্বায়ন বা ‘Globalisation’ সম্পর্কে সারা বিশ্ব জুড়ে বিতর্ক এখনও বিদ্যমান। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি সর্বজনীন নীতি হিসেবে বিশ্বায়ন রাজনীতির চিন্তাবিদদের কাছে সর্বসম্মতভাবে আজও গৃহীত হয়নি। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরেই এক প্রবল প্রতিরোধের উদ্ভব ঘটে। বস্তুত বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে তিন ধরনের প্রতিক্রিয়ার কথা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে-1 রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়া বা বিশ্বায়ন-সংক্রান্ত নীতির প্রবল বিরোধিতা, ② উদারনৈতিক ও নয়া উদারনৈতিক প্রতিক্রিয়া, ③ সমালোচনামূলক প্রতিক্রিয়া।
উদারনৈতিক ও নয়া উদারনৈতিক প্রতিক্রিয়া উদারনৈতিক ও নয়া উদারনৈতিক চিন্তাবিদরা বিশ্বায়ন সংক্রান্ত নীতিকে সমর্থন জানিয়ে এক মুক্ত সমাজের কথা প্রচার করেন। তাঁদের মতে, বিশ্বায়ন হল সীমারেখাহীন মুক্ত সমাজের স্বপ্নের বাস্তবরূপ (Globalisation is the fulfilment of the dream of a free society without boundar- ies.)। বস্তুত উনিশ শতকের যে সকল ইউরোপীয় চিন্তাবিদ অন্ধবিশ্বাস ও প্রচলিত ধারণার বদলে যুক্তির আলো দিয়ে মানবসমাজের প্রকৃতি উন্মোচন করতে গিয়ে Enlightenment বা আলোকপ্রাপ্তির কথা বলেন, বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের উদারনৈতিক চিন্তাবিদরা অনুরূপভাবে বিশ্বায়নেরমাধ্যমে এক মুক্ত দুনিয়ার স্বপ্ন দেখেন।
রক্ষণশীল ও সমালোচনামূলক প্রতিক্রিয়া
বিশ্বায়ন বা Globalisation-এর বিরোধিতা শুরু হয় ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে সিয়াটেলে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ের তৃতীয় সম্মেলনে। পরবর্তীকালে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে কাতারের রাজধানী দোহায় বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার চতুর্থ সম্মেলনে এবং সাম্প্রতিককালে মেক্সিকোর রাজধানী কানকুনে পঞ্চম সম্মেলনে এই বিরোধিতা প্রবল আকার ধারণ করে। সমগ্র বিশ্বের প্রতিবাদী সংগঠনগুলিকে নিয়ে বিশ্ব সামাজিক মঞ্চ (World Social Forum) গঠিত হয়। অতি সম্প্রতি ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে বিশ্ব সামাজিক মঞ্চের সম্মেলনে অংশ নিতে গিয়ে Globalisation and its Dis- contents শীর্ষক গ্রন্থের লেখক নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোশেফ স্টিগলিৎস (Joseph Stiglitz) নয়া উদারনীতিবাদী বিশ্বায়নকে কার্যত ‘দারিদ্র্যের বিশ্বায়ন’ আখ্যা দিয়ে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ‘নয়া উদারনৈতিক বিশ্বায়ন শুধু যে অর্থনৈতিক বিকাশের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে তাই নয়, এই বিশ্বায়ন অনিশ্চয়তাও সৃষ্টি করেছে’ (Neo-liberal Globali- sation has not only failed to produce the economic growth it set out to achieve but also increased insecurity)। স্টিগলিৎস-এর মতে, বিশ্বায়নের নীতি বাজার মৌলবাদের লক্ষ্যে পরিচালিত, এখানে পণ্য ও বাজার হল শেষ কথা। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (IMF), বিশ্বব্যাংক (World Bank), বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (World Trade Organization) দরিদ্রদের জন্য নিরাপত্তা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করার কথা বললেও এই সংস্থাগুলি যে নীতি নিয়ে চলেছে তাতে গরিবরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই এই বিশ্বায়ন হল দারিদ্র্যের বিশ্বায়ন।
বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফল
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব পর্যালোচনা করতে গিয়ে নিম্নলিখিত উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলির কথা তুলে ধরা যেতে পারে-
[1] উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য: বিশ্বায়নের ফলে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য প্রকট হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক গৃহীত বিশ্বায়নের নীতি উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ উন্নত দেশগুলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এডওয়ার্ড এস হারমানের মতে, বিশ্বে সবচেয়ে ধনী ও দরিদ্র দেশে বসবাসকারী পৃথিবীর ২০ শতাংশ জনগণের আয়ের ফারাক ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ৩০:১ থেকে বেড়ে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে ৮২:১ হয়েছে।
[2] বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের (TRIPS) প্রয়োগ: বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বাণিজ্যিক বিশ্বায়নের নীতিকে কার্যকরী করার জন্য বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের যে চুক্তি বলবৎ করেছে তার। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলি এই অধিকার অনুযায়ী পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক, ব্যাবসায়িক গোপনীয়তার সুরক্ষা প্রভৃতি বিষয়গুলি কতটা নিজেদের এক্তিয়ারে সংরক্ষিত রাখতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া এসব ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতাতেও তারা টিকে থাকতে পারছে না।
[3] কর্পোরেট বিশ্ব বা বহুজাতিক সংস্থার আধিপত্য: বিশ্বায়নের ফলে বাণিজ্য সম্পর্কিত বিনিয়োগ ব্যবস্থা (Trade Related Investment Mea- sures or TRIMS) গৃহীত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থা বা কর্পোরেট বিশ্বের আধিপত্য সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে এই ব্যবস্থা অনুযায়ী এমন কতকগুলি বিধান পালন করতে হয় যার ফলে বহুজাতিক সংস্থাগুলি তাদের কর্তৃত্ব বিস্তারের সুযোগ লাভ করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বহুজাতিক সংস্থাগুলি উন্নত দেশসমূহের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের বৃহত্তম বহুজাতিক সংস্থাগুলির মধ্যে ৬১ শতাংশ মার্কিনি সংস্থা, ৩৩ শতাংশ ইউরোপীয় সংস্থা এবং ২ শতাংশ জাপানি সংস্থা। সীরা বিশ্বজুড়ে এই বৃহত্তম বহুজাতিক সংস্থাগুলি উন্নয়নশীল দেশসমূহের ক্ষুদ্র সংস্থাগুলিকে অধিগ্রহণ বা সংযুক্তির মাধ্যমে দখল করে নিয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছে।
[4] নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনীতি এবং উত্তর-দক্ষিণ সংঘাত: বিশ্বায়নের ফলে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা উন্নত ও ধনী দেশগুলির কুক্ষিগত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনীতি এবং উত্তর-দক্ষিশ সংঘাতের উদ্ভব ঘটেছে। উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল বিশ্বের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে সম্পূর্ণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। এর ফলে ধনী দেশগুলি কর্তৃক গরিব দেশগুলির শোষণ অব্যাহত রয়েছে। উন্নত দেশসমূহের কর্তৃত্বাধীন বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা যেভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর শ্রমখরচ (Labour Cost) সংক্রান্ত বিধান, অভিন্ন শ্রমিক স্বার্থ সম্পর্কিত নীতিগ্রহণ, কৃষিক্ষেত্রে ভরতুকি কমানো প্রভৃতি বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করে চলেছে, তার ফলে উত্তর (উন্নত) বনাম দক্ষিণ (উন্নয়নশীল) সংঘাত দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ যোগেনস বুখ হানসেনের মতে, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা নির্দেশিত উদার অর্থনৈতিক পথে চলতে গিয়ে ধনী বিশ্ব আরও ধনী হচ্ছে অন্যদিকে দরিদ্র বিশ্ব দরিদ্রতর হচ্ছে।
[5] কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের ফলাফল: আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নির্দেশে উন্নয়নশীল দেশসমূহ যে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস (Structural Adjustment)-এ হাত দেয়, তার ফলে ব্যাপকভাবে কর্মী সংকোচন, ছাঁটাই, লে অফ, লক আউট, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিলগ্নিকরণ, জাতীয় ব্যয়ের সংকোচন ইত্যাদি করা হয়। কাঠামোগত এই পুনর্বিন্যাসের ফলে বেকারি, দারিদ্রদ্র্য, আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা প্রভৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সমাজের অনগ্রসর ও দুর্বল শ্রেণির মানুষরা।
[6] সাংস্কৃতিক সমতার প্রভাব: বিশ্বায়নের ফলে সারা বিশ্বজুড়ে সাংস্কৃতিক সমতা তৈরির চেষ্টা চলেছে। ইনটারনেট-সহ অত্যাধুনিক গণমাধ্যমের সহায়তায় এক পণ্যমুগ্ধ ভোগবাদী সংস্কৃতির নিরন্তর প্রচারের ফলে আঞ্চলিক ও জাতীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ক্ষুষ্ণ হতে বসেছে। বিশ্বায়ন সাংস্কৃতিক ঐতিহাসমূহকে এক ছাঁচে ঢেলে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সমতা চাপিয়ে দিতে চায়। অনেকে একে মার্কিনি ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের বৈচিত্র্যপূর্ণ বহুমুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।
[7] জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সংকট: বিশ্বায়নের প্রভাবে জাতিবছ (Nation State)-এর সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব তার নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ ও নাগরিকবৃন্দে ওপর চূড়ান্তভাবে প্রযোজ্য হয়। বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের এই ভূখণ্ডকেন্দ্রিক সর্বব্যাপী ক্ষমতাকে খর্ব করে রাষ্ট্রকে একটি বাজারকেন্দ্রিক সংগঠনে পরিণত করেছে বলে মনে করা হয়। বস্তুত বিশ্বায়নের পটভূমিকায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলি রাষ্ট্র কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ। করার সুযোগ লাভ করেছে। আধুনিক লেখকদের মতে, বিশ্বায়ন কুমা রাজনৈতিক, সামাজিক, জাতীয় এবং আঞ্চলিক কর্তৃত্বের পরিকাঠামোকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে সার্বভৌমত্বের ধারণার বাছ ঘটেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের লেখক হলটন (R Holton) তাঁর Global isation and the Nation State শীর্ষক গ্রন্থে এই বিষয়ে মন্তব্য করছে। গিয়ে লিখেছেন, “জাতি-রাষ্ট্র (Nation State)-এর যে পৃথিবী তা বদল্লে যাচ্ছে, বিশ্বায়ন এক্ষেত্রে পরিবর্তনের বড়ো উৎস হিসেবে কাজ করছে, বিশ্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জাতি-রাষ্ট্রের ভূমিকা ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং অন্যান্য ধারণাসমূহ বিশ্বায়নের প্রভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে রাষ্ট্রের চরম সার্বভৌমত্বের সাবেকি ধারশাও বদলে যাচ্ছে।” (“….the world that nation states inhabit is changing, that globalisation in a major source of change and that many aspects of globalisation are altering the roles and relationships of nation states to each other and to other organised interests within the global political system. Such changes may involve the erosion of traditional ide als of absolute state sovereignty within particulars boundaries.”)
উপসংহার: একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বায়ন এক অপরিহার্য আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। বাজার অর্থনীতি, উদারীকরণ ও বাণিজ্যিক বিশ্বায়ন থেকে কোনো দেশ বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছে না। অনেকের মতে, অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশসমূহের দুর্বলতার কারণেই বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে এক বৈষম্যমূলক নীতি গৃহীত হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে উন্নত দেশগুলির মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশসমূহকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় বিশ্বায়নকে কাজে লাগানো দরকার। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে মেক্সিকোর কানকুনে উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রতিনিধিরা এই মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। আশা করা যায়, উন্নয়নশীল বিশ্ব অদূর ভবিষ্যতে কর্পোরেট বিশ্বের আধিপত্যকে মুছে ফেলে উন্নত দুনিয়ার বিশ্বায়নকে উন্নয়নশীল দুনিয়ার আঞ্চলিক বিশ্বায়ন (Globalisation)-এ রূপান্তরিত করে এক নতুন বিশ্বায়ন সূচিত করতে পারবে।