“…সে তাে আর তখন তার জীবনের কোনাে উৎপাত বা জ্বালাতন নয়, বরং সমুদ্রের দিকচক্রবালে নিছকই কাল্পনিক একটা ফুটকিই যেন।” -উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটিকে কাল্পনিক একটা ফুটকির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে কেন?
মার্কেজ-এর লেখা ‘বিশাল ডানাওয়ালা এক থুরথুরে বুড়াে’ গল্পে তাকে দেখিয়ে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ আদায় করলেও ডানাওয়ালা বুড়ােটি কিন্তু উপেক্ষিতই ছিল এলিসেন্দাদের বাড়িতে। শহরে একটি মাকড়সা কন্যার আগমন ঘটায়, কৌতূহলী জনতার ভিড় ডানাওয়ালা বুড়াে লােকটিকে ছেড়ে, মাকড়সা-মেয়েটির দিকেই ধাবিত হয়। ফলে, বাড়ির মালিক পেলাইও ও এলিসেন্দাদের দর্শনি বাবদ উপার্জন আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়, আর বুড়াে লােকটিও ক্রমাগত আরও অবহেলার শিকার হতে শুরু করে। অযত্নে, অবহেলায় রােদে বৃষ্টিতে ভেঙে যায় তার থাকার মুরগির খাঁচাটি। দেবদূত আখ্যা পাওয়া বুড়ােটি এরপর ‘পথহারা দিকভােলা মুমূর্যুর মতাে’ এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়।
ডিসেম্বরের গােড়ায় প্রথম রােদুর ভরা দিনগুলি আসতেই সেই জ্বরাক্রান্ত মুমূর্য বৃদ্ধের ডানায় ‘মস্ত কতগুলাে আড়-ধরা পালক গজাতে থাকে। তার ডানা ঝাপটানােটা তখনও অবশ্য ঠিক ওড়ার মতাে হয় না। এভাবেই সে একসময়ে নড়বড় করতে করতে ওপরে ওঠে। এলিসেন্দা লক্ষ করে ডানাওয়ালা বুড়াে ধীরে ধীরে উড়ে যায় বাড়িগুলাের উপর দিয়ে। শেষে তাকে আর দেখা যায় না। ডানাওয়ালা বুড়াে লােকটি তখন উৎপাত-এর গঞ্জনাকে বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যায় ফুটকির মতাে হয়ে।
‘বিশাল ডানাওয়ালা এক থুরথুরে বুড়াে’ গল্পে ডানাওয়ালা বুড়াের আবির্ভাব ও মিলিয়ে যাওয়ার কাহিনি বিবৃত করাে
গাবরিয়েল মার্কেজ-এর লেখা ‘বিশাল ডানাওয়ালা এক থুরথুরে বুড়াে’ গল্পে পেলাইও-এলিসেন্দার বাড়ির উঠোনে এক দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ডানাওয়ালা বুড়াের আবির্ভাব হয়েছিল। পরনে তার ন্যাকড়াকুডুনির পােশাক, টাক-পড়া মাথায় কয়েকটি বিবর্ণ চুল রয়েছে, ফোকলা মুখে দাঁতের সংখ্যা খুবই কম। আর উল্লেখযােগ্যভাবে রয়েছে অতিকায় শিকারি পাখির ডানা-যা নােংরা এবং অর্ধেকটাই পালক-খসা। কাদার মধ্যে মুখ গুঁজে তাকে পড়ে থাকতে. এবং কাতরাতে দেখা গিয়েছিল। একেবারে শেষ অংশে ছাড়া পুরাে গল্প জুড়েই এই দুর্দশা থেকে ডানাওয়ালা বুড়াে বেরােতে পারেনি। অথচ তাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে কৌতূহল, আর এই কৌতূহল রচনা করেছে অলৌকিক আখ্যান। পেলাইও-এলিসেন্দারা তাকে দেখিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জনও করে। কিন্তু মুরগির খাঁচার ভেতরে থেকে ডানাওয়ালা বুড়াে কোনাে কিছুতেই উৎসাহ দেখায়নি। মাকড়সা-মেয়ের আগমনের পরে তার খাঁচার সামনে থেকে ভিড় ক্রমে অদৃশ্য হয়েছে। ফলে বুড়াের প্রতি পেলাইওদের মনােযােগ শুধু কমেইনি, তারা অবাঞ্ছিত মনে করতে শুরু করে সেই ডানাওয়ালা বুড়ােকে। শেষপর্যন্ত এক ডিসেম্বরের গােড়ায় তার ডানায় নতুন পালক গজিয়েছে আর দৃশ্যমান জগতের হুজুগ, স্বার্থপরতা, সংস্কার সবকিছুকে পেছনে ফেলে ডানা মেলে দিগন্তে বিলীন হয়ে গেছে মায়াবাস্তবের বাসিন্দা ডানাওয়ালা বুড়াে।
‘বিশাল ডানাওয়ালা এক থুরথুরে বুড়ো’ গল্পে পাদরি গােনসাগার চরিত্রটি আলােচনা করাে
মার্কেজের ‘বিশাল ডানাওয়ালা এক থুরথুরে বুড়াে গল্পে অদ্ভুত দর্শন ডানাওয়ালা থুরথুরে বুড়ােকে দেখে পুরােহিত হিসেবে গােনসাগা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, থুরথুরে বুড়াে আসলে কোনাে দেবদূত নয়, সে হল এক জোচ্চোর ফেরেব্বাজ’। এই সিদ্ধান্তের কারণ হল, সে যখন বুড়ােটির উদ্দেশে লাতিন ভাষায় সুপ্রভাত সম্ভাষণ জানিয়েছিল, তার উত্তরে বুড়াে যা বলেছিল, তা তার পছন্দ হয়নি—“এ ঈশ্বরের ভাষাই বােঝে না, কিংবা জানেও না কী করে ঈশ্বরের উজির-নাজিরদের সম্ভাষণ করতে হয়। একদিকে ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব, আর অন্যদিকে ব্যক্তিগত অহংবোেধ ডানাওয়ালা বুড়াে সম্পর্কে গােনসাগার ভাবনাচিন্তাকে প্রভাবিত করেছে। ‘তাকে বড্ড বেশি মানুষ-মানুষ দেখানােয় গােনসাগা কোনাে অলৌকিক মহিমাই খুঁজে পায়নি সেই ডানাওয়ালা বুড়াের’ মধ্যে। এরপরেও ব্যবস্থার দাস পাদরি গােনসাগা নিজে কোনাে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না—তাকে অপেক্ষা করতে হয় বিশপ, আর্চবিশপ হয়ে যাজকতন্ত্রের উচ্চতম পর্যায় সর্বোচ্চ মােহান্তর থেকে নির্দেশের জন্য। নিজের ধর্মীয় প্রতিপত্তি বজায় রাখার জন্যই সে বৃদ্ধকে রােমান ক্যাথােলিকদের উৎসব পণ্ডকারী এক শয়তান লােকরূপে আখ্যা দেয় এবং সেই বুড়াে লােকটির থেকে ছলাকলাহীন সাদাসিধে লােকদের সাবধান থাকতে নির্দেশ দেয়। আসলে পাদরি গােনসাগা ছিল স্ব-আরােপিত ধর্মীয় শৃঙ্খলের দাস।
‘বিশাল ডানাওয়ালা এক থুরথুরে বুড়াে’ গল্পে জাদু বাস্তবতা (magic realism)-র যে ব্যবহার লক্ষ করা যায় তা নিজের ভাষায় আলােচনা করাে
গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ-এর লেখা গল্পটি আপাত অবাস্তব এবং অসম্ভবের মধ্যেও অসামান্য ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। জাদুবাস্তবতার বিস্তারে। ডানাওয়ালা বুড়াে যেমন জাদু বাস্তবতাকে ধরে রেখেছে, মাকড়সায় রূপান্তরিত হওয়া মেয়েটিও এই জাদুবাস্তবতারই ফসল। কিন্তু গল্পের উপযােগী আবহ ও পরিবেশ সৃজনে এবং ঘটনা পরম্পরার মধ্যেও লেখক জাদু বাস্তবতার প্রচ্ছন্ন বিস্তার ঘটিয়েছেন। গল্পের শুরুতেই অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে বিষন্ন জগৎ, নবজাত শিশুর জ্বর—সব মিলিয়ে প্রকৃতি আর মানব অনুভূতির জাদুকরি বিস্তারে অপরিচিত আর অতিপ্রাকৃত মিলেমিশে একাকার হয়েছে। ডানাওয়ালা বুড়াে দেবদূত আখ্যা পেয়েছে, আর তাকে কেন্দ্র করে কল্পনার নানামুখী বিস্তার ঘটেছে। তার সংস্পর্শে বা সংসর্গেই নাকি একজন অন্ধ আতুরের তিনটি নতুন দাঁত গজিয়েছিল, একজন পঙ্গু ব্যক্তি প্রায় একটা লটারি জিতে যাচ্ছিল, কিংবা একটি কুষ্ঠরােগীর ঘা থেকে গজিয়ে উঠেছিল সূর্যমুখী ফুল। বাস্তবের সঙ্গে অলৌকিকতার দ্বন্দ্বও এখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ডিসেম্বর মাসের প্রথম রােদুর পাওয়ার পর থেকেই তার ডানায় পালক গজিয়েছে এবং শেষ অবধি ডানা মেলে আকাশে উড়ে গিয়েছে সে। মানবসমাজের নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যকে তথা যাজকতন্ত্রের ধর্মীয় গোঁড়ামিকে উন্মুক্ত করতে ডানাওয়ালা বুড়ােকে আশ্রয় করেই জাদু-বাস্তবতাকে প্রায় অস্ত্রের মতাে ব্যবহার করেছেন লেখক মার্কেজ।