বিদেশে নিযুক্ত ভারতীয় ও চীনা চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের অবস্থা
অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে ভারতের ব্রিটেনের একছত্র ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। এ সময় চেনো ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি গুলি, বিশেষ করে ব্রিটেনের আধা ঔপনিবেশ পরিণত হয়। আধি পত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির ভারত ও চীনের বহু শ্রমিকের আফ্রিকা অন্যান্য স্থানের উপনিবেশ গুলির বিভিন্ন কাজে প্রেরণ করে। শ্রমিকরা বিদেশে ৫ থেকে ৮ বছর মেয়াদে কাজের জন্য চুক্তির স্বাক্ষর করতো। বিদেশে কর্মরত চুক্তিবদ্ধ ভারতীয় ও চীনা শ্রমিকদের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। বিদেশে এই শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে নিজে আলোচনা করা হলো-
১. চুক্তি ভঙ্গ
ভারত ও চীনের শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর আগে বিভিন্ন আকর্ষণীয় শর্তে, যেমন- বহু শ্রমিককে ভালো বেতন, আরামদায়ক কাজের নিয়োগ, মাত্র তিন বছরের জন্য কাজে নিয়োগ প্রভৃতির দ্বারা আকৃষ্ট করে তাদের সঙ্গে এজেন্ট মা মালিকপক্ষ চুক্তি স্বাক্ষর করতো। কিন্তু পরবর্তীকালে সেসব চুক্তির অধিকাংশ শর্ত এই মালিকপক্ষ পালন বা রক্ষা করত। চুক্তি লঙ্ঘন করে তারা শ্রমিকদের নানাভাবে বঞ্চিত করতে এবং তাদের ওপর সীমাহীন শোষণ ও নির্যাতন চালাত।
২. অবহেলা
শ্রমিক সংগ্রহের এজেন্ট ও শ্রমিকদের প্রভুরা ভারত ও চীন চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের নানাভাবে অবহেলা করতো। প্রভু ওরা কখনো কখনো শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন ও অত্যাচার চালাতো। তাদের অতিরিক্ত সময় কাজে বাধ্য করা হতো এবং বিভিন্ন বিপদ সংকুল ও পারিশ্রম সাধ্য কাজে নিয়োগ করা হতো। ইংরেজরা যতটা তাগিদ নিয়ে শ্রমিকদের বিদেশে পাঠাতো, ততটা তাগিদ নিয়ে তাদের ফিরিয়ে আনা হত না। ফলে ফেরার সময় সমুদ্রের পথে বহু শ্রমিক চূড়ান্ত দুর্দশা।
৩. অমর্যাদা
চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক বিদেশে নানা অমর্যাদা শিকার হত। সরকারি নথিপত্রে ভারত থেকে পাঠানো শ্রমিকদের সাধারণভাবে কুলি বলে চিহ্নিত করা হতো। এর দ্বারা শ্রমিকদের প্রতি বিদেশীদের অমর্যতা পূর্ণ ব্যবহার প্রকাশ পেত। কেননা কুলি বলতে বোঝায় যারা জন্ম বৃত্তান্তের ত্রুটি রয়েছে। ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটলেও যুক্তিবাদ ও শ্রমিক সৃষ্টির মাধ্যমে ইউরোপের উপনিবেশিক শক্তি গুলি ঘুরপথে আবার ক্রীতদাস প্রথাকে ফিরিয়ে আনে।
৪. অভাব-অনটন
বিদেশে ভারত ও চীনের শ্রমিকরা খুবই সামান্য মজুরিতে কাজ করতো। প্রচুর পরিশ্রম করলেও তাদের পর্যাপ্ত খাবার ও প্রয়োজনীয় পোশাক জুটতো না। তারা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হত। দুর্বিসহ জীবন থেকে মুক্তির জন্য বহু শ্রমিক পালিয়ে দেশে ফেরার চেষ্টা করত। কিন্তু ধরা পড়ে বহু শ্রমিক জেলে আবদ্ধ হত।
৫. পারিবারিক জীবনের ভাঙ্গন
শ্রমিকরা নির্দিষ্ট মেয়াদ পূরণ হওয়ার পর দেশে ফেরার আশা নিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি দিত। কিন্তু মেয়াদ পূরণের পর অনেকেই আর দেশে ফিরতে পারত না। অনেক বিদেশেই মারা যেত। এর ফলে বহু শ্রমিকের পারিবারিক জীবন ভেঙে যেত এবং তার পরিবারের সদস্যরা সীমাহীন দুঃখ দুর্দশা শিকার হতো।
৬. মৃত্যু
সমুদ্রপথে বিদেশে যাত্রা গান এবং বিদেশে নতুন স্থানে নতুন প্রতিকূল আবহাওয়ার প্রচুর শ্রমিকের মৃত্যু হতো। নতুন দেশে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাসের ফলে শ্রমিকরা নানা রোগের শিকার হত। তারা সঠিক চিকিৎসা ও পেতো না। ফালিন ডায়রিয়ার মত রোগে প্রচুর শ্রমিকের মৃত্যু হতো।
উপসংহার
শ্রমিকের দুরবস্থা ও মৃত্যুর ঘটনা প্রতিরোধ করে তাদের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সরকার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে এ বিষয়ে একটি আইন (Act No. XIX of 1856) পাশ করে। এই আইনে বলা হয় যে, চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের নিরাপত্তার উপযুক্ত ব্যবস্থা না করে তাদের বিদেশে পাঠানো যাবেনা। এছাড়া মেয়াদ শেষে দেশে ফিরে আসার স্বপ্ন নিয়ে শ্রমিকরা বিদেশে পাড়ি দিলেও পরবর্তীকালে কোন না কোন শ্রমিক স্বেচ্ছায় চিরকালের মতো বিদেশেই থেকে যায়। ট্রিনিদাদে মতো কোনো কোনো সরকার তাদের দেশে ভারতীয় শ্রমিকদের বসবাসের সুযোগ করে দেয়। ফলে ওইসব উপনিবেশ ভারতের ছোট ছোট বস্তি গড়ে ওঠে।