বাংলা নাটকে বিজন ভট্টাচার্যের অবদান/কৃতিত্ব | বাংলা নাট্য-আন্দোলনে বিজন ভট্টাচার্যের ভূমিকা | বাংলা নাটকে ক্ষীরােদপ্রসাদ বিদ্যাবিনােদের অবদান

বাংলা নাটকে ক্ষীরােদপ্রসাদ বিদ্যাবিনােদের অবদান

বাংলা নাটকের ইতিহাসে ক্ষীরােদপ্রসাদ বিদ্যাবিনােদ একটি উল্লেখযােগ্য নাম। নাটকের সাহিত্যগুণের থেকেও তিনি বেশি করে মন দিয়েছিলেন নাটকের মঞসাফল্যের দিকে। তাঁর নাটকগুলিকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে-

পৌরাণিক নাটক: ক্ষীরােদপ্রসাদ বিদ্যাবিনােদ পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে রচনা করেন ‘সাবিত্রী’, ‘উলূপী’, ‘ভীষ্ম’, ‘মন্দাকিনী’ ও ‘নর নারায়ণ’। আধুনিক মানুষের দ্বিধা-যন্ত্রণার দিকটি ‘ভীষ্ম’ নাটকে ফুটে উঠেছে।

ঐতিহাসিক নাটক: ক্ষীরােদপ্রসাদের বেশিরভাগ ঐতিহাসিক নাটক বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শুরু হওয়ার পরে লেখা বলে সেগুলিতে দেশাত্মবােধ বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। ‘বঙ্গের প্রতাপাদিত্য’, ‘চাঁদবিবি’, ‘পলাশীর প্রায়শ্চিত্ত’, ‘নন্দকুমার’, ‘বাঙ্গালার মসনদ’, ‘আলমগীর’ প্রভৃতি ক্ষীরােদপ্রসাদের উল্লেখযােগ্য ঐতিহাসিক নাটক।

ইতিহাস-আশ্রিত কাল্পনিক নাটক: ক্ষীরােদপ্রসাদ বিদ্যা বিনােদ ইতিহাসের বাতাবরণ তৈরি করে যে কয়েকটি কাল্পনিক নাটক রচনা করেন, সেগুলি হল—’রঘুবীর’, ‘খাঁজাহান’, ‘আহেরিয়া এবং ‘বঙ্গে রাঠোর’।

গীতিনাট্য: গীতিনাট্য রচনার মধ্য দিয়েও নাট্যকার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। ‘বন্ধুবাহন’, ‘আলিবাবা, জুলিয়া’, “সপ্তম প্রতিমা’, ‘আলাদিন’, ‘দৌলতে দুনিয়া’, ‘রুপের ডালি’, ‘বাদশাজাদী’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযােগ্য গীতিনাট্য। ‘আরব্য রজনি’র কাহিনি অবলম্বনে রচিত নৃত্য গীতসংবলিত ‘আলিবাবা’ (১৮৯৭ খ্রি.) নাটকটি ক্ষীরােদপ্রসাদকে খ্যাতির শিখরে নিয়ে গিয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলা নাটকের ইতিহাসে ক্ষীরােদপ্রসাদের জনপ্রিয়তার মূল কারণ তাঁর গীতিনাটকগুলি। রুচির সঙ্গে কোনােরকম আপস না করেও তিনি তাঁর নাটকে মনােরঞ্জনমূলক নানা উপাদান যুক্ত করেছিলেন।

বাংলা নাট্য-আন্দোলনে বিজন ভট্টাচার্যের ভূমিকা বিশ্লেষণ

গণনাট্য আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ নাট্যকার অভিনেতা বিজন ভট্টাচার্য বাংলা নাটক ও রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। বিজন ভট্টাচার্যের নাটকগুলিকে মােটামুটি চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়-

পূর্ণাঙ্গ নাটক: ‘নবান্ন’ (১৯৪৪), ‘জতুগৃহ’ (১৯৫১), ‘গােত্রান্তর’ (১৯৫৬-৫৭), ‘ছায়াপথ’ (১৯৬১), ‘দেবীগর্জন’ (১৯৪৪), ‘ধর্মগােলা’ (১৯৬৭), ‘গর্ভবতী জননী’ (১৯৭১) ইত্যাদি হল তার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ নাটক। ১৯৪২-এর আগস্ট আন্দোলন, বন্যা, মহামারি এবং ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে রচিত নবান্ন নাটকে বিজন ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন যে, মানুষেরই শােষণ ও অত্যাচারে কীভাবে হাজার হাজার মানুষের অপমৃত্যু ঘটে। ‘গােত্রান্তর’ নাটকের বিষয় উদ্বাস্তু জীবনের সমস্যা, ‘ছায়াপথ’-এর বিষয় ফুটপাথের ঝুপড়িবাসীদের জীবন। কৃষক আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত হয়েছে ‘দেবীগর্জন’। বাদা অঞ্চলের আদিবাসী বেদেদের ব্রতকথা নিয়ে রচিত হয়েছে ‘গর্ভবতী জননী’ নাটকটি।

একাঙ্ক নাটক: ‘আগুন’ (১৯৪৩), ‘জবানবন্দি’ (১৯৪৩), ‘জননেতা’ (১৯৫০), ‘লাস ঘুইরা যাউক’ (১৯৭০) প্রভৃতি হল বিজন ভট্টাচার্যের উল্লেখযােগ্য একাঙ্ক নাটক। আগুন ও ‘জবানবন্দি’ নাটকদুটিতে স্থান পেয়েছে বাংলার কৃষকদের দুর্দশার চিত্র।

গীতিনাট্য: ‘জীয়নকন্যা’ (১৯৪৮) বিজন ভট্টাচার্যের একমাত্র গীতিনাট্য। এটি মনসার ভাসান-বিষয়ক একটি গীতিনাট্য।

রূপকনাট্য: ‘স্বর্ণকুম্ভ’ (১৯৭০) হল বিজন ভট্টাচার্যের একমাত্র রূপকনাট্য।

জীবন সম্পর্কে প্রবল আশাবাদ, আদর্শবাদ এবং রাজনৈতিক চেতনার দীপ্ততায় বাংলা নাটককে জনগণের কাছে। নিয়ে যাওয়ার সার্বিক কৃতিত্ব বিজন ভট্টাচার্যের প্রাপ্য।

বিজন ভট্টাচার্য রচিত একটি নাটকের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

‘আগুন’, ‘জবানবন্দি’, ‘গােত্রান্তর’, ‘ছায়াপথ’, ‘মাস্টারমশাই, ‘দেবীগর্জন’, ‘ধর্মগােলা’, ‘গর্ভবতী জননী’ প্রভৃতি বিভিন্ন শিল্পসার্থক নাটকের রচয়িতা বিজন ভট্টাচার্য (১৯১৫- ১৯৭৮ খ্রি.) অমর হয়ে আছেন তাঁর ‘নবান্ন’ (১৯৪৪ খ্রি.) নাটকের জন্য। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রযােজনায় ‘শ্রীরঙ্গম’ রঙ্গমঞ্চে প্রথম অভিনীত হওয়া এই নাটকটি বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে এবং অভিনয় নিপুণতায় বাংলা নাট্যজগতে বিপুল আলােড়ন তুলেছিল। ১৯৪২-এর আগস্ট আন্দোলন, বন্যা, মহামারি এবং ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে রচিত এই নাটকে বিজন ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন যে, মানুষেরই শােষণ ও অত্যাচারে কীভাবে হাজার হাজার মানুষের অপমৃত্যু ঘটে। ‘নবান্ন’ নাটকের মধ্য দিয়েই সমকালীন নাট্য-আন্দোলন দেশব্যাপী গণ-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।

বিশ শতকের চারের দশকের বাংলার গণনাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ বিজন ভট্টাচার্য বাংলা নাটকের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। বাংলা পেশাদারি রঙ্গমঞ্চে যখন শিশির ভাদুড়ি নাট্যজগৎ-কে শাসন করছিলেন, তেমনই এক সময়ে, ১৯৪২-এর আগস্ট আন্দোলন এবং ১৯৪৩-৪৪-এর দেশব্যাপী মন্বন্তরের পটভূমিতে বিজন ভট্টাচার্যের আবির্ভাব। পূর্ব-প্রচলিত নাট্যধারার গতানুগতিক পথে না হেঁটে তিনি বাংলা নাটককে করে তুলেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কঠিন বাস্তব জীবনের অনুসারী।

বাংলা নাটকে বিজন ভট্টাচার্যের কৃতিত্ব

বাংলা নাটকে বিজন ভট্টাচার্যের কৃতিত্ব হল—প্রথমত, তাঁর নাটকে কৃষক, শ্রমিক, বস্তিবাসী, ঝুপড়িবাসী প্রভৃতি শােষিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত শ্রেণির মানুষের সংগ্রামের কথা উঠে এসেছে এবং একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে নাট্যকারের আশাবাদী চেতনা। দ্বিতীয়ত, তাঁর নবান্ন নাটকের মধ্য দিয়েই সূচনা হয় গণনাট্য আন্দোলনের। এই আন্দোলনে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের পতাকার নীচে জড়াে হন বিজন ভট্টাচার্য-সহ শম্ভু মিত্র, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখােপাধ্যায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, শম্ভু ভট্টাচার্য, বলরাজ সাহানি, ভীষ্ম সাহানি, রবিশংকর প্রমুখ প্রতিভাবান শিল্পী-সাহিত্যিক। এই গণনাট্য আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে তাদের ন্যায়সংগত অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করা এবং তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে সহায়তা করা। অনতি-পরবর্তী যুগের নবনাট্য এবং বর্তমান যুগের গ্রুপ থিয়েটারের জন্ম এই গণনাট্য আন্দোলনেরই প্রত্যক্ষ ফল।

সুতরাং, বাংলা নাট্য আন্দোলনের ইতিহাসে নাট্যকার অভিনেতা বিজন ভট্টাচার্যের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তৃতীয়ত, বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসেও বিজন ভট্টাচার্যের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর ‘নবান্ন নাটকের মধ্য দিয়েই বাংলা নাটক পেশাদারী রঙ্গমঞ্চের ধারা থেকে বেরিয়ে এসে এক নতুন নাট্যধারার সূচনা করে। মঞ্চসজ্জা, মনির্দেশ, মঞ উপস্থাপনা এবং অভিনয়রীতিতে বাংলা নাট্যাভিনয়ের ক্ষেত্রে এক আমূল পরিবর্তন ঘটে। সেকারণেই বাংলা নাটক ও রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে বিজন ভট্টাচার্যের অবদান কখনােই অস্বীকার করা যায় না।

বাংলা সব প্রশ্ন উত্তর (একাদশ শ্রেণি)

Leave a Comment