সূচনা
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে নির্জোট আন্দোলন কতটা প্রাসঙ্গিক, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। অনেক ধারনায়, ঠান্ডা যুদ্ধের পরিস্থিতিতে নির্জোট আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ছিল, তাই তা অবসানের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রচলিত ফুরিয়েছে। আবার কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হলে বর্তমান বিশ্বের যে সমস্ত সমস্যার উদ্ভব ঘটে চলেছে, সেগুলি সঠিক সমাধানের জন্য আজও জটি রূপে আন্দোলনের প্রয়োজন রয়েছে।
বর্তমানে নির্জট আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা
« জোট নিরপেক্ষতার পক্ষে যুক্তি
১. মানবাধিকার রক্ষা
বর্তমান বিশ্বের তথাকথিত দরিদ্র দেশগুলির মানবাধিকারের লঙ্ঘিত হয়েছে। সূচনা লগ্ন থেকে জাতিপুঞ্জের ভেতরে ও বাইরে একটি সংঘটিত শক্তি হিসেবে নির্জট আন্দোলন মানবাধিকার রক্ষা সচেষ্ট থেকেছে। আজও তাই মিশে নারীদের ও দুর্বল রাষ্ট্র গুলি মানবাধিকার রক্ষার জন্য নির্জন আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
২. শান্তি-প্রতিষ্ঠা
বর্তমান বিশ্ব আণবিক মারোনাস্থের ভয়ের সদা ভীত ও সন্ত্রস্ত বলে বলিয়ান হয়ে তথাকথিত দুর্বল দেশগুলিকে আতঙ্কে মধ্যে রেখেছে। শুধু তাই নয় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আণবিক অস্ত্রের সম্প্রসারণ রোদে চুক্তিতে স্বাক্ষর করানোর জন্য আর্থিক ও সামরিক বিভিন্ন দিক থেকে চাপে রেখেছে। এই মার্কিনী চাপ কে উপেক্ষা করে সমগ্র বিশ্বের প্রকৃত শান্তির বাতাবরণ গড়ে তোলার জন্য আজও নির্জট আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ফুরোয়নি।
৩. আর্থিক বৈষম্য
আধুনিক বিশ্বের রাজনৈতিক বিচারে ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান ঘটলে অর্থনৈতিক দিক থেকে ঠান্ডা লড়াই চরম রূপ ধারণ করেছে। অর্থাৎ সোভিয়েত পতনের মধ্য দিয়ে রুশোর সাম্যবাদ এবং মার্কিন পুঁজিবাদের মধ্যেকার লড়াই হয় তো শেষ হয়েছে কিন্তু উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলির মধ্যে আর্থিক বৈষ্ণম্যের ব্যবধান দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রথম থেকে নির্জট আন্দোলন জাতিপুঞ্জের আর্থিক কর্মসূচিকে সর্বোচ্চভাবে উন্নয়নমুখী করে তোলার কাজে সচেষ্ট থেকেছে। যেহেতু এই আর্থিক বৈষ্ণব ক্রমবর্ধমান তাই তো ওজনের জন্য নির্জট আন্দোলন আজও প্রাসঙ্গিক।
৪. মানব কল্যাণ
নির্জট আন্দোলন বরাবর মানব কল্যাণ মূলক কার্যসূচি গুলি রূপায়ণের উপর জোর দিয়ে এসেছে। নিজট আন্দোলন ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই দরিদ্র উন্নয়নশীল দেশগুলির অর্থনৈতিক সমস্যা, পরিবেশ সংরক্ষণ, মাদকাশক্তি প্রতিরোধ, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটিয়ে সার্বিক মানব কল্যাণের দাবিতে সরব হয়। সার্বিক মানব কল্যাণ আজও অধরা থেকে গেছে। তাই সার্বিক মানব কল্যাণ প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্জন আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা আজও রয়েছে।
« জোট নিরপেক্ষতার বিপক্ষে যুক্তি
১. ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমেরিকা নেতৃত্বে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রযৌষধ ও সৌভিক নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র জোটের গোটা বিশ্বের বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই দ্বিমেরুকরণ রাজনীতি ঠান্ডা লড়াই নামে পরিচিত। কিন্তু 1991 খ্রিস্টাব্দে ২৬ শে ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক অবলুপ্তি ঘটে। ঠান্ডা লড়াই রাজনীতির এক অক্ষে এই অবলুপ্তির পর দাঁতাত শান্তি প্রক্রিয়া রাজনীতি শুরু হয়। এই মতের সমর্থকদের ধারণাই তাই ঠান্ডা যুদ্ধকালে বিশ্বে যে দ্বিমেরু রাজনীতি সৃষ্টি হয়েছিল সেই প্রেক্ষিতে জোয়ার নিরপেক্ষতার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বর্তমানে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান সঙ্গে সঙ্গে দ্বিমেরু কেন্দ্রিক রাজনীতির অবসান ঘটেছে। তাই আজকের দিনে নিজোট আন্দোলন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।
২. মার্কিন একাধিকপত্য
সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির পর বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন একাধিকপত্য প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। দ্বিমেরু কেন্দ্রিক রাজনীতি আজও এক মেরু কেন্দ্রিক মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীন রাজনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে নিজোট সদস্য ভুক্ত দেশগুলি সহ বিশেষ সমস্ত দেশী মহাশক্তির মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ভাষা হারিয়েছে। এছাড়াও ঠান্ডা যুদ্ধ চলাকালীন দ্বিমেরু কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নির্জন সদস্য রাষ্ট্রগুলি সোভিয়েত মার্কিন উভয় শিবিরের কাছ থেকে আর্থিক ও সামরিক দরকষাকষি সুযোগ পেতো। কিন্তু সোভিয়েত পতনের পর এই দরকষাকষি সুযোগ নষ্ট হয়। আর্থিক, সামরিকসহ বিভিন্ন দিক থেকে সুযোগ-সুবিধা লাভের প্রশ্নে মার্কিন সাহায্যে একমাত্র ভরসার স্থলে দাঁড়ায়। তাই এই প্রেক্ষিতে নির্জট আন্দোলন অপ্রাসঙ্গিক বলা চলে।
৩. নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও অন্তর্দ্বন্দ্ব
বর্তমান মিশে নির্জট আন্দোলনের প্রসারে বড় বাধা হলো দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। এক দা জওহরলাল নেহেরু, আব্দুল গামাল নাসের, জোসেফ ব্রোজ টিটো, সুকর্ণ, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, শ্রী রাজীব গান্ধী, শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী, সিরিমাভো বন্দরনায়েক, কিনেথ কাউন্টার প্রমুখ নেতৃবর্গ নির্জট আন্দোলনকে যে স্তরে উন্নতি করেছিলেন তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন পরবর্তী নেতৃবর্গ । এছাড়াও নির্জন আন্দোলন ভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলি বিভিন্ন বিষয়ে একে অপরের সঙ্গে বিরোধ ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এই বিরোধ হলে সমাধানে ও ব্যর্থতা ধরা পড়ে। গ্যাট চুক্তি সম্পর্কেও নিজের দেশ গুলি কোন সহমতে আসতে পারেনি। স্বাভাবিকভাবে নেতৃত্বে ব্যর্থতা এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলির দন্ড ও অনৈক্য ও বর্তমানে পরিস্থিতিতে নির্জট আন্দোলনকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
৪. লক্ষ্য গত কৌশলগত পরিবর্তনের অভাব
যে লক্ষ্য এবং কৌশল নিয়ে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের পথ চলা শুরু হয়েছিল সেই লক্ষ্য এবং কৌশলে আজকের দিনে অচল। আদর্শগত দ্বন্দ্ব রুশ ও সাম্যবাদ ও মার্কিন পুঁজিবাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব, উপনিবেশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম সমূহ প্রকৃতি বিষয়গুলির সমাধান জরুরী ছিল সেগুলি মীমাংসা হয়ে গেছে। এর পরিবর্তে পরিবর্তনশীল বিশ্বের আর্থিক দ্বন্দ্ব, সন্ত্রাসবাদ, সর্বাত্মক নিরস্তীয়করণ প্রভৃতি প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।
এগুলি শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে সমাধানের জন্য যে লক্ষ্যগত এবং কৌশলগত পরিবর্তনের দরকার ছিল তা দেখাতে ব্যস্ত হয়েছে সাম্প্রতিক নির্জট আন্দোলন। তাই চতুর্দশ হাভানা নির্জন সম্মেলন ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে থেকে আফগানিস্তান, কিউবা, ইথিওপিয়া ইত্যাদির দেশ দাবি জানাই যে রুশা মার্কিন সমঝোতার ফলে যেহেতু বিশ্বের বন্ধুত্বমূলক বাতাবরণ গড়ে উঠেছে, তাই স্বতন্ত্র মঞ্চ হিসেবে নির্জট আন্দোলন ও তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে গেছে। যদিও এই দাবি খারিজ করা হয়েছিল এবং এর পরে একাধিক নির্জন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে।
উপসংহার
নির্জট আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্রতত্ত্ববিদদের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও নির্জন আন্দোলনের আদর্শ আজও অটুট। বর্ধমানের সময়কালে একের পর এক নির্জন সম্মেলন এর আয়োজনের প্রাসঙ্গিকতাকে বজায় রেখেছে। মার্কিনী পুঁজিবাদের প্রশ্রয় আজ ২০ শে অর্থনীতির বাজারি অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্র ও দুর্বল দেশ গুলির পাশে দাঁড়িয়ে নিয়েছো আন্দোলন বাজারে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে সফলতা পেলে তবেই তার প্রাসঙ্গিকতা অক্ষুন্ন থাকবে বলা যায়।