প্রাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের উপনিবেশিক ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্যোগ সম্পর্কে আলোচনা করো? মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের তাৎপর্য উল্লেখ করো?

প্রাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্যোগ

ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার প্রথম পূর্বে পাঠশালা, টোল, মক্তব, মাদ্রাসা প্রভৃতি ছিল শিক্ষা কেন্দ্রিক প্রাচীন শিক্ষাদানের প্রথা চালু ছিল। পরবর্তীকালে খ্রিস্টান মিশনারী, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও বিভিন্ন প্রগতিশীল ব্যক্তিদের উদ্যোগে ভারতে প্রচুর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ও আধুনিক প্রাশ্চাত্য শিক্ষাদান করা হতো। ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের সর্বপ্রথম উদ্যোগ নেয়।

১. অফিস-আদালতের প্রতিষ্ঠান

ভারতের ব্রিটিশ শাসনের ধারাবাহিক প্রসার ঘটানো সঙ্গে সঙ্গে সরকার দেশে বহু অফিস আদালত স্থাপন করে। এসব অফিসের উচ্চ পথগুলোতে ইংরেজদের জন্য সংরক্ষিত হলেও নিম্ন পদগুলির প্রচুর সংখ্যার ইংরেজি শিক্ষিত কর্মচারীরাও প্রয়োজন হয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ এসব অফিস আদালতের সরকারি চাকরি লাভের আশায় আধুনিক প্রাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের তৎপর হয়ে ওঠে। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে তারা পাশ্চাত্যের সভ্যতা ও সংস্কৃতি অনুরাগী হয়ে ওঠে।

২. চাকরির আগ্রাধিকার

সরকারি চাকরি ছিল উপনিবেশিক আমলের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ভারতীয়দের প্রধান পেশা। প্রীতি সরকার ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা করে যে, চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজি নানা প্রার্থীদের আগ্রাধিকার দেয়া হবে। এই ঘোষণার ফলে চাকরির লাভের আশায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পড়ুয়ারা আরো বেশি করে ইংরেজি প্রাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি ঝুকে পড়ে।

৩. ব্রিটিশ অনুরাগী

ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ কারী মধ্যবিত্ত শ্রেণি শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ইংরেজ সরকারের সহযোগী ও সমর্থককে পরিণত হয়। প্রথম থেকে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের অনেকেই ভারতের ব্রিটিশ শাসনের আশীর্বাদে বলেই মনে করতেন। রাস্তা তো শিক্ষায় শিক্ষিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও ভূদেব মুখোপাধ্যায় ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি আস্তানা প্রকাশ করেন ডিরোজিও -র অনুগামী রাম গোপাল ঘোষ ব্রিটিশ সরকারি চাকরি প্রত্যাখা করলেও ভারতের ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্ব কে তিনি সমর্থন করতেন।

৪. মধ্যবিত্তের উদ্যোগ

প্রাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বেশ কয়েকজন প্রগতিশীল ব্যক্তি ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষায় প্রসারে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন রামমোহন রায়, রাধাকান্ত দেব, রাম কমল সেন, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ। তারা অনেকেই ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। রামমোহন ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার যথেষ্ট ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। তিনি ভারতে আধুনিক বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ সরকারকে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে একটি চিঠি দেন। তার এই চিঠি ভারতে নবজাগরণের ইতিহাসের একটি মূল্যবান দলিল।

মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণে তাৎপর্য

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে তারা দেশের মোট জনসংখ্যা অনুপাতে খুবই সামান্য ছিল। কিন্তু তার শ্রদ্ধেয় ভারতীয় জনজীবন প্রাচরদের শিক্ষা গভীর প্রভাব পড়ে। এই প্রভাব গুলি হল –

১. প্রাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাব

ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ফলে তারা সমাজ জীবনে সর্বাপেক্ষা প্রগতিশীল শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারা পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে পশ্চাতে সভ্যতা, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, জাতীয়তাবাদ, মানবতাবাদ, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রভৃতি মতাদর্শনের সঙ্গে পরিচিত হয়। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত রাই ভারতীয় সমাজে এসব ভাবধারা ছড়িয়ে দেয়।

২. জাতীয় ঐক্য

মধুমিতা শনির মধ্যে পাশ্চাত্য ও ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে জাতীয় স্তরের নেতৃবৃন্দের মধ্যে যোগাযোগ ও ঐক্য স্থাপিত হয়। ইংরেজি ভাষা এই ঐক্যের বন্ধন হিসেবে কাজ করে। প্রাদেশিক নেতৃবৃন্দ এর ফলে ভারতে জাতীয় স্তরের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আগ্রহী ও সচেতন হয়ে ওঠেন। এর ফলে ইন্ডিয়ান লীগ এবং ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এর মতে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে।

৩. প্রগতিশীলতা

মধুমিতা সেনের পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করলে তাদের মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতি, ধর্মীয় প্রকৃতি বিষয় প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা গড়ে ওঠে। এর ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যুক্তিবাদী সামাজিক, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার পঠ ভূমি তৈরি হয়।

৪. জাতীয়তাবাদী সাহিত্য

পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাষ্ট্রের সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সাহিত্য রচনা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক সাহিত্যের অগ্রগতি ঘটে। তাছাড়া জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ভাষায় বহু সাহিত্য রচিত হয়ে থাকে।

৫. নবজাগরণ

মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মাধ্যমে ভারতের রাষ্ট্রপতি শিক্ষা ও ভাবধারা ছড়িয়ে পড়লে ভারতের সামাজিক, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় জীবনে বইগুলো অগ্রগতি পরিপ্রেক্ষিত হয়। এই ঘটনাকে অনেক ঊনিশ শতকের ভারতীয় নবজাগরণ বলে অবহিত করেছেন। বাংলা এই নবজাগরণের সর্বাধিক প্রভাব পড়ে। বাংলার উনিশ শতকের নবজাগরণের কেউ কেউ পঞ্চদশ শতকের ইতালির নবজাগরণের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

৬. জাতীয় আন্দোলন

প্রথম থেকে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভারতের ব্রিটিশ শাসনের সহযোগী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পরবর্তীকালে তারা ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে আসেন। মূলত তাদের নেতৃত্বেই ভারতে জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।

উপসংহার

ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে প্রগতিশীল হিসেবে সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেও তারা ছিল দেশের মোট জনসংখ্যা অতি সামান্য অংশ মাত্র। তা সত্ত্বেও শত সহস্র নক্ষত্রের মধ্যে চাঁদ যেমন মধ্যমণি হিসেবে অবস্থান করে তেমনি উনিশ শতকের মধ্যবর্তী শ্রেণীও ভারতীয় সমাজ জীবনের মধ্যমণি হিসেবে সমাজকে আলোকিত করেছিল। এ. আর. দেশাই এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে আধুনিক ভারতের স্রষ্ঠা বলে।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment