সূচনা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১৯১৪-১৮ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতীয় শিল্পায়নের গতি কিছুটা বৃদ্ধি পায়। এই সময় ব্রিটিশ সরকার স্যার টমাস হল্যান্ডের নেতৃত্বে একটি শিল্প কমিশন গঠন করে। এই কমিশন শিল্প ক্ষেত্রে ভারতীয় মূলধন বিনিয়োগ কে উৎসাহ দেয়। ফলে শিল্প ক্ষেত্রে ইউরোপীয় মূলধনের পাশাপাশি ভারতীয় পুঁজিপতিদের যথেষ্ট পরিমাণ মূলধন বিনিয়োগ হয়। ডক্টর রজত রায়ের হতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পরে ভারতীয় শিল্পায়নের সমৃদ্ধি এবং মূলধনের গঠন ছিল অনেকটা সন্তোষজন।
ভারতীয় শিল্পোদ্যোগের বৈশিষ্ট্য
বিভিন্ন ব্রিটিশ শিল্প সংস্থা ভারতের শিল্পের বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। এই সংস্থাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল অ্যান্ড্রু ইউলস , বার্ডস, মার্টিন বার্নস, ডআনলপ, শ ওয়ালেস, ডানকান ব্রাদার্স প্রভৃতি, তবে নানা প্রতিকূল মধ্য বিংশ শতকে প্রথম থেকে ইংরেজি শিল্প ও প্রতীদের সঙ্গে ভারতীয় শিল্প প্রতিরাও সমানতালে শিল্পপতি বিনিয়োগ করতে থাকেন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে পরবর্তী কালে ভারতে যে শিল্পের বিকাশ শুরু হয় তার কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল, যেমন-
১. শিল্পপতি ও শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব
ভারতের শিল্পের বিকাশে এই সময় যথেষ্ট সংখ্যা ভারতীয় শিল্পপতি ও মালিক শ্রেণী যুক্ত হয়। ফলে ভারতীয় সমাজে শিল্প প্রতি শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। পাশাপাশি যাদের শিল্প কারখানায় কাজ করে গড়ে ওঠে শ্রমিক শ্রেণী।
২. প্রযুক্তি শিক্ষার অভাব
২০ শতকের শুরুতে ভারতীয় শিল্প উদ্যোগীরা শিল্প স্থাপন শুরু করলে ভারতীয়দের মধ্যে শিল্প প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান বিষয়ক পর্যাপ্ত জ্ঞান এর অভাব ছিল। ভারতীয় শিল্পপতিদের মাধ্যমে এ বিষয়ে শিক্ষার প্রসারের সরকার বিশেষ চেষ্টা করেননি।
৩. ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে অনগ্রসরতা
ভারতীয় শিল্প উদ্যোগীদের পর্যাপ্ত প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞানের অভাবে ভারতীয় মালিকানা ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে অগ্রগতি যথেষ্ট ব্যাহত হয়। এজন্য তারা রেল ইঞ্জিন, মোটরগাড়ি, জাহাজ, এরোপ্লেন বিদেশ শিল্পের ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি।
৪. পশ্চিম ভারতের কেন্দ্রীয়কতা
শিল্পক্ষেত্রের মূলধন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বোম্বাইয়ের পারসি, গুজরাটি, মাড়ওয়ারী প্রভৃতি বনিকরা যে সাহস দেখাতে পেরেছিল তা পূর্বে ভারতীয় ধনী পুঁজি প্রতিরা দেখাতে পারেনি। ফলে পশ্চিম ভারতের শিল্পের অধিক প্রসার ঘটলেও পূর্ব ভারতে তা ঘটেনি। হলে বোম্বাই সহ পশ্চিম ভারতে দেশীয় শিল্পে অধিক প্রসার ঘটে।
৫. বস্ত্র শিল্পের প্রাধান্য
ভারতীয় শিল্প প্রতিরা যেসব শিল্পে প্রচুর মূলধন বিনিয়োগ করে তার মধ্যে প্রধান ছিল বস্তশিল্প। মূলত পশ্চিম ভারতে শিল্পপ্রসার ঘটে।
৬. পূর্ব ভারতে কম বিনিয়োগ
ভারতীয় পুঁজিপতিদের মূলধন পূর্ব ভারত, বিশেষ করে কলকাতা ও তার সন্নিহিত অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে কম বিনিয়োগ হয়। এখানকার পুঁজিপতিরা জমিতে অর্থ বিনিয়োগকে নিরাপদ মনে করে। এই পূর্বে ভারতে ইউরোপীয় পুঁজি সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছিল পূর্ব ভারতের কলকাতায়।
৭. বিভিন্ন ভারতীয় শিল্পপতি
শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে ভারতীয় শিল্পপতিদের নানা বিধ সমস্যা ছিল। তা সত্ত্বেও ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ইংরেজ শিল্পপ্রতিদের সঙ্গে ভারতীয় শিল্প প্রতিরাও সমানতালে শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন-
১. জামশেদ জি টাটা
পারশি শিল্পপতি জামশেদজী টাটা ১৯৩৯-১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ছিলেন ভারতীয় শিল্পপ্রতিদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। ভারতীয়দের মধ্যে তিনি লোহা ও ইস্পাত শিল্প গঠনে সর্বাধিক সাফল্য দেখিয়েছেন।
২. গুজরাটি শিল্পপতি
গুজরাটি শিল্পপতি শিল্প স্থাপনে যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ওয়ালচাঁদ হীরা চাঁদ, পুরুষোত্তম দাস ঠাকুর দাস, আম্বআলাল, সারা ভাই প্রমুখ। ওয়ালচাঁদ হীরাচাঁদ খুনি, বীমা, সিমেন্ট, মোটর গাড়ি নির্মাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে মূলধন বিনিয়োগ করেন।
৩. মারওয়ারি শিল্পপতি
ভারতের শিল্পের প্রতিষ্ঠাতা মারোয়ারী শিল্পপ্রতিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন স্বরূপ চাঁদ, হুকুম চাঁদ, বিড়লা, ডালমিয়া, সিংহানিয়া প্রমুখ। মাড়োয়ারি শিল্পপতিদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হুকুমচাঁদ আফিম ও খাদ্য সর্ষের ব্যবসা যুক্ত ছিলেন। পরে তিনি হুগলি নদীর তীরে একটি পাটকল স্থাপন করে।
৪. বাঙালি শিল্পপতি
বাঙালি শিল্পপতিদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিলেন স্যার ব্রজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুর। ব্রজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় লৌহ ইস্পাত শিল্পে মূলধন বিনিয়োগ করেন।
৫. দেশীয় রাজ্যের শিল্প উদ্যোগ
ব্রিটিশ ভারতে বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য ও শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেয় মহীশূর, বরোদা, কোচিন প্রভৃতি দেশীয় রাজ্য। মহীশুরের দেওয়ান বিশিষ্ট ভারতীয় প্রযুক্তি বিদ এম. বিশ্বশ্বরায় -র উদ্যোগে মহীশূর শিল্পের যথেষ্ট প্রসার ঘটে। পদ্মাবতী লৌহ ইস্পাত কারখানার প্রতিষ্ঠা তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি।
৬. ইংরেজদের সহযোগী ভারতীয় শিল্পপতি
বিশ শতকের ইংরেজ শিল্প পতিদের সহযোগী হিসেবে কয়েকজন ভারতীয় শিল্পবতী দেশের শিল্পের প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে। শ ওয়ালেস কোম্পানি সহযোগী তারা চাঁদ ঘনশ্যাম দাস, ব্যালি ব্রাদার্সের সহযোগী গোয়েঙ্কা, গ্রাহাম ব্রাদার্সের সহযোগী ঝুনঝুনওয়ালা, ইউলসের সহযোগী ভাটিয়া প্রমুখ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম।
উপসংহার
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসন কাঠামোর মধ্যে বসবাস করে ভারতীয় শিল্পপতিরা ও দেশীয় শিল্পের বিকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। মারাঠা পত্রিকায় লেখা হয়েছে যে, “আমাদের পুঁজিপতি ও শিল্প উদ্যোগী হতে হবে, হতে হবে ব্যবসায়ী, মেশিন নির্মাতা ও দোকানদারের জাত।” বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সমালোচনা করে বলেছেন যে, ভারতে এলাকাভিত্তিক চাহিদার ওপর নির্ভর করে শিল্প কারখানা গড়ে ওঠার প্রকৃত অর্থে শিল্পায়ন ঘটেনি।