শ্রমিক আন্দোলনের কারণ
উপনিবেশিক শাসনকালে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত ব্রিটিশরা ভারতের শিল্পের প্রসার কোন উদ্যোগ না নিয়ে নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থে তাদের দেশের ক্ষুদ্র কুটির শিল্পকে প্রায় ধ্বংস করেছিল। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে পরবর্তীকালে ভারতের কিছু আধুনিক শিল্পের বিকাশ ঘটতে শুরু করে। এক্ষেত্রে প্রথম ব্রিটিশ এবং পরে ভারতীয় পুঁজিপ্রতিরা উদ্যোগ গ্রহণ করে। তাদের উদ্যোগে ভারতের লৌহ ইস্পাত, কাগজ, চা, পাট, কয়লা, সুতি বস্ত্র, সিমেন্ট, কাচ, দেশলাই ও রাসায়নিক প্রভৃতি বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ ঘটে। শিল্পের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নতুন সামাজিক শ্রেণী হিসেবে ভারতের শিল্প শ্রমিকের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রতিষ্ঠিত ৫৬ টি সুতা কলগুলিতে প্রায় ৪৫ হাজার এবং ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত কুড়িটি পাটকল গুলিতে প্রায় ২০ হাজার সমিক কাজ করতো। ভারতের শিল্প শ্রমিকরা প্রথম থেকে পুঁজি প্রতি মালিক ও ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন ধরনের শোষণের শিকার হয়। ক্ষুব্ধ এই শ্রমিকরা পরবর্তীকালে আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়। ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের বিভিন্ন কারণ ছিল। এই কারণগুলি হল –
১. ভারতের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরবর্তী বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ শ্রমিক আন্দোলনের মদত যোগায়।
(১) ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে লক্ষ্ণৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে ঐক্যবোধের প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ভারতের শ্রমিক জাতিগত ভুলে গিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত হয়।
(২) বালগঙ্গাধর তিলক ও আরমানি বেসান্তর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা হোমরুল আন্দোলন শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি করে।
(৩) জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ঘটনা শ্রমিক শ্রেণীকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ করে।
২. রুশ বিপ্লবের প্রভাব
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের কমিউনিস্ট নেতা ভি. আই. লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাফল্যমন্ডিত হয়। এই সফল ভারতীয় শ্রমিকদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। তারা উপলব্ধি করে যে ভারতীয় শ্রমিকদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী আন্দোলন গঠন করা সম্ভব হলে তার সফল হতে পারে।
৩. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের স্বদেশী আন্দোলনের সময় ভারতের কারখানা সংখ্যা এবং সেই সঙ্গে শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে শিল্প ক্ষেত্রে সংকট দেখা দেয়। ফলে ভারতের শিল্প কারখানা গুলি থেকে শ্রমিক ছাটাই শুরু হয় এবং প্রচুর শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। অবশিল্পায়ন চলতে থাকায় ভারতের শিল্পায়ন মুখ থুবড়ে পড়ে। বাণিজ্যেও মন্দা দেখা দেয়। যদি পরিস্থিতিতে জিনিসপত্রের দাম প্রচুর বৃদ্ধি পায়। এরূপ নানা কারণে ভারতের শ্রমিকদের অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
৪. অর্থনৈতিক দুরবস্থা
শ্রমিকরা প্রচুর সময় কাজ করতে বাধ্য হলেও তাদের মজুরি ছিল খুবই কম। আর্থিক অনটনের ফলে তাদের জীবন জীবিকা চালানো মুশকিল হতো। এ সঙ্গে তাদের ওপর বিপুল পরিমাণ করের বোঝা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রভৃতি ঘটনা শ্রমিকদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে। শ্রমিক পরিবার গুলি প্রায় অনাহার, আধাহারে থাকতে বাধ্য হত।
৫. শোষণ
ভারতের শিল্প কারখানা গুলিতে শ্রমিকদের অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। তাদের প্রচুর সময় কাজ করতে হতো। দরিদ্র শ্রমিক পরিবার গুলি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের ফলে তাদের রোগ ভোগ লেগেই থাকতো। শ্রমিক পরিবারের সন্তানদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা বা শিক্ষা লাভের সুযোগ ছিল না। এরূপ সীমাহীন শোষণের ফলে সুমিকা অত্যন্ত ক্ষুদ্র ছিল।
৬. শ্রমিক সংগঠনগুলির ভূমিকা
১৯১৮-১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে। বি. পি. ওয়াবিয়ার নেতৃত্বে এবং সিঙ্গারাভেল্লু চেটিয়ার, রামনাজ্জলু নাইডু, ভি. কল্যাণসুন্দরম মুদিয়ালার-এ সহযোগিতায় প্রথম শ্রমিক সংগঠন মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে গড়ে ওঠে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রথম বৃহত্তম শ্রমিক সংগঠন অল ইন্ডিয়া স্টেট ইউনিয়ন কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে অন্তত ১২৫টি শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে। এগুলিতে সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই লক্ষ। শ্রমিক সংগঠনগুলির ছত্রছায়া শ্রমিকরা তাদের আন্দোলন দাবী দাওয়া তুলে ধরতে সক্ষম হয়।
৭. কমিউনিস্টদের সহযোগিতা
শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা জীবন যাত্রার মনোনয়ন ও শ্রমিক আন্দোলনের প্রসারে ভারতে কমিউনিস্ট দলগুলি যথেষ্ট সহায়তা করেছিল। শ্রমিকদের আন্দোলনে হেমন্ত সরকার, পি. সি. যোশি, মিরাজকর, মুজাফ্ফর আহমেদ, শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, সিঙ্গারাভেল্লু চেটিয়ার প্রমো কমিউনিস্ট নেতা বিশেষভাবে সহায়তা করে। শ্রমিক শ্রেণী কে কমিউনিস্টরা সাম্যবাদী চিন্তা ধারার প্রভাবিত করে শ্রমিক আন্দোলনকে তীব্রতর করে তোলে।
উপসংহার
মার্কসবাদী ঐতিহাসিক রজনী পামদত্ত তার গ্রন্থে বলেছেন যে, “ভারতের শ্রমিক আন্দোলন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রুশো বিপ্লব ও আন্তর্জাতিক বিপ্লবী কার্যকলাপের ফলে এক লাফে পূর্ণ কর্ম তৎপরতার জাগতে এসে পৌঁছায়।” বোম্বাই, বাংলা, বিহার, মাদ্রাজ ও আসাম প্রভৃতি প্রদেশের শ্রমিক আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। বিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতের শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন কে যথেষ্ট শক্তিশালী করে।