সূচনা
ব্রিটিশ শাসনকালে গুজরাট ছিল একটি কৃষি প্রধান রাজ্য। গুজরাটে কৃষকরা কৃষি কাজ করে অতি সাধারণ জীবন যাপন করতো। এখনকার খেয়া ও খেদা জেলা সহ প্রতিবেশী অঞ্চল গুলিতে তামাক চাষ ও গো পালন বিশেষ জনপ্রিয় পেশা ছিল। খেদা গুজরাটের বিভিন্ন অঞ্চলে পতিদার নামে মধ্যবিত্ত কৃষক সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। এদের একাংশ তামাকের দাস ও গোপালন করতো এবং দুগ্ধ জাত সামগ্রী শহরের বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। কিছু কিছু পতিদার মোটামুটি সচ্ছল হলেও অনেকেই ছিল খুব দরিদ্র। এই দরিদ্র কৃষকরা কুনবি নামে পরিচিত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গুজরাটে কৃষকদের দুরাবস্থা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ও তারপর ভারতে যে অর্থনৈতিক সংকর দেখা যায় তা গুজরাটি কৃষকদের দুর্দশা বাড়িয়ে দেয়। তাদের দুরবস্থা বিভিন্ন দিক সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-
১. মূল্যবৃদ্ধি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে গুজরাটি কৃষি ও শিল্প উৎপাদন খুবই ব্যাহত হয়। ফলে দ্রব্য মূল্য যথেষ্ট বেড়ে যায়। বস্ত্র, চিনি, লবণ ও কেরোসিন প্রভৃতির মূল্য সর্বাধিক বৃদ্ধি পায়। অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও যথেষ্ট বাড়ি। ফলে সেখানকার কৃষকদের সমস্যা খুবই তীব্রতর হয়।
২. খাদ্য সংকট
গুজরাটে বারংবার শস্য হানি, দুর্ভিক্ষ ও মহামারী প্রভৃতির ফলে কৃষকরা সীমাহীন দুরবস্থার শিকার হয়। এখানকার কৃষি প্রধান খেদা জেলায় অনাবৃষ্টি ও করায় মাঠের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সেখানকার কৃষকদের ঘরে খাদ্য সংকট দেখা দেয় এবং দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে। তাদের পক্ষে সরকারের আদর্শ পরিষদ করা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। নানা সংকটে সম্মুখীন হয়ে সরকারের কাছে তারার আদর্শ হ্রাসের ব্যর্থ আবেদন জানায়।
৩. দুর্ভিক্ষ ও মহামারী
খেদায় বারংবার শস্য হয়নি, ও মামাবাড়ি প্রভৃতি ফলে এখানকার কৃষকদের দুঃখ দুর্দশা অন্ত ছিল না।। বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নে গুজরাটের খেয়া বা জেলায় অনাবৃষ্টি ও খরায় মাঠের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সেখানকার দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে সেখানকার গরিব কৃষকদের পক্ষে সরকারের রাজস্ব পরিষদ করা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। সংকটে সম্মুখীন হয়ে সরকারের কাছে তারা রাজস্ব হ্রাসের ব্যর্থ আবেদন জানায়।
৪. কৃষকদের বিপর্যয়
গুজরাটের কৃষকরা যখন দুর্ভিক্ষ ও অর্থনৈতিক সংকটে দারুন ভাবে বিপর্যস্ত, তখন ১৯১৭-১৮ খ্রিস্টাব্দে নাগাদ সরকার কৃষকদের ওপর করের বোঝা আরো বৃদ্ধি করে। ফলে পতিদার ও কুনবি সম্প্রদায়ের কৃষকসহ দরিদ্র মানুষ অন্তহীন দুর্দশা শিকার হয়। সরকারের অনুগত ভূস্বামীরা সেই বিপুল পরিমাণ কর আদায় করতে গিয়ে কৃষকের ওপরে নির্মম অত্যাচার চালায়। কর প্রদানের ব্যর্থ ও চাষীদের জমি থেকে উৎখাত করা হতে থাকে। এর ফলে সেখানকার কৃষকদের অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
কর বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গুজরাটে দুর্দশা গ্রস্থ কৃষকরা সরকারি শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়।
১. আন্দোলনের সূচনা
কৃষকদের দুর্দিনে তাদের ওপর করের বোঝা বৃদ্ধি করলে এবং কর আদায়ের জন্য তাদের উপর নির্যাতন শুরু হলে দরিদ্র কৃষকরা প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করে। মোহনলাল পান্ডা ও অন্যান্য কয়েকজন স্থানীয় নেতা খ্রিস্টাব্দের ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনকে শক্তিশালী করেন। আন্দোলন শীঘ্রই রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
২. গান্ধীজীর ভূমিকা
কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধী গুজরাটি কৃষকদের পক্ষ নিয়ে আন্দোলন শুরু করলে আন্দোলনে যথেষ্ট গতি আসে। গান্ধীজীর খেদার ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ২২ মার্চ সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। গান্ধীজীর প্রভাবে খেদায় কৃষকরা দলে দলে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে শামিল হয়। স্থানীয় যুবক সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করে তোলেন।
৩. খাজনা প্রধান বন্ধ
গান্ধীজি ও তার অনুগামী সত্যাগ্রহীরা গ্রামে ঘুরে ঘুরে সরকারকে খাজনা দিতে নিষেধ করেন। তার আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে গুজরাটে বহু এলাকায় সামর্থ্যহীন দরিদ্র কৃষকরা সরকারকে খাজনা দিতে অস্বীকার করে।
৪. দমন নীতি
কৃষকদের আন্দোলন প্রতিরোধ করতে সরকার তীব্র দমন নীতির আশ্রয় নেয়। আন্দোলনকারীদের ওপর তীব্র দমন পীড়ন চালানো হয়। এর ফলে দরিদ্র কৃষকরা ব্যাপক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।
উপসংহার
কৃষকদের ব্যাপক আন্দোলনের পর শেষ পর্যন্ত গান্ধীজীর কৃষকদের পক্ষ নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেন। আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, যাদের খাজনা দেওয়ার সামর্থ্য আছে তারা সরকারকে কাজ না দেবে। যাদের সামর্থ্য নেই, সরকার তাদের খাজনা মুকুব করবে। এভাবে আন্দোলনকারীদের জয়ের মধ্যে দিয়ে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে খেদার কৃষকদের খাজনা বিরোধী আন্দোলনের অবসান ঘটে। খেদা সত্যাগ্রহের সাফল্যের ফলে জাতীয় রাজনীতিতে গান্ধীজীর উত্থান সহজ হয়।