নুন কবিতার মূল বক্তব্য সংক্ষেপে আলােচনা করাে
নুন কবিতায় কবি জয় গােস্বামী এক নিম্নবিত্ত পরিবারের দিনযাপনকে তুলে ধরেছেন। তাদের অভাবী জীবনের নিত্যসঙ্গী অসুখ আর ধারদেনা। রাত্তিরে পিঠোপিঠি দুই ভাইয়ের মতাে পিতাপুত্র গাঁজায় টান দিয়ে নেশায় বিভাের হয়ে থাকে দুঃখকে ভুলে থাকার জন্য। তাদের দরিদ্র জীবনে প্রতিদিন বাজার করা সম্ভব হয় না। আবার কখনও হাতে পয়সা থাকলে বাজার হয়ে যায় মাত্রাছাড়া বাড়িতে ফেরার পথে সৌন্দর্যপ্রিয়তা বা বিলাসিতায় মগ্ন হতে কখনাে-সখনাে আবার গােলাপচারাও কিনে আনে তারা।
কিন্তু কোথায় পোঁতা হবে সেই গােলাপচারা কিংবা কবে তাতে ফুল ফুটবে—এসব প্রশ্নের উত্তরে এইসব নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন ভাবিত নয়। তাদের কাছে সত্য শুধু আবেগতাড়িত হয়ে ক্ষণিক ইচ্ছেপূরণ। মাঝে মাঝে গভীর রাতে বাড়ি ফিরে তারা যখন দেখে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ভাতে খাওয়ার মতাে উপযুক্ত নুনটুকুও নেই, রাগ মাথায় চড়ে যায় তখন। বাপব্যাটা দুজন মিলে সমস্ত পাড়া তখন মাথায় করে। এক ধরনের বেপরােয়া মানসিকতার বশবর্তী হয়ে তখন তারা ঘােষণা করে—“করি তাে কার তাতে কী?” সব মিলিয়ে জয় গােস্বামী যেন তুলে আনেন একটা গােটা মানবিক ভূখণ্ডকে, যেখানে কোনাে বিরাট রাজনৈতিক দর্শন অনুপস্থিত, আছে শুধু ছােটো ছােটো স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকার একান্ত দাবি- “আমরা তাে সামান্য লােক/আমাদের শুকনাে ভাতে লবণের ব্যবস্থা হােক।”
নুন কবিতায় কবির যে জীবনবােধের প্রকাশ ঘটেছে তা উদ্ধৃতিযােগে আলােচনা করাে
“আমরা তাে অল্পে খুশি; কী হবে দুঃখ করে?”-নুন কবিতায় জয় গােস্বামীর ব্যবহৃত এই প্রথম বাক্যটিতে দুঃখ করে কোনাে লাভ নেই বুঝেই নিম্নবিত্ত মানুষেরা অল্পে সন্তুষ্ট হওয়ার উপায় খুঁজে নেয়। ‘চলে যায় দিন’ শব্দবন্ধ বুঝিয়ে দেয় খুশি এখানে অনায়াস নয়। “রাত্তিরে দু-ভাই মিলে টান দিই গঞ্জিকাতে” -অর্থাৎ বস্তুজগৎকে ভুলে গিয়ে বাপব্যাটার দুই বন্ধুর মতাে নেশার ঝেকে চলে সেই খুশিরই সন্ধান। “সব দিন হয় না বাজার; হলে, হয় মাত্রাছাড়া” বাক্যটিতে প্রকাশিত হয় নিম্নবিত্তের অসংযমী জীবনদর্শনও। আর তাকেই কবি সম্পূর্ণ করেন এভাবে- “বাড়িতে ফেরার পথে কিনে আনি গােলাপচারা।” স্থানাভাবের বাসস্থানে কোথায় পোঁতা হবে সেই গােলাপচারা কিংবা কবে তাতে ফুল ফুটবে—সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এইসব গরিব মানুষের কাছে একেবারেই অর্থহীন।
দুপুররাতে বাড়ি ফিরে ঠান্ডা ভাতে নুনটুকুও অনেক সময় পায় না তারা। জীবন তখন আর এতেই খুশি’ বলতে পারে না। তাই তখন—“রাগ চড়ে মাথায় আমার, আমি তার মাথায় চড়ি/ বাপব্যাটা দু-ভাই মিলে সারাপাড়া মাথায় করি” এবং তার সঙ্গে থাকে গরিব মানুষের বেপরােয়া মন, যা ঘােষণা করে—“করি তােত কার তাতে কী?” কুদ্ধ মানসিক অবস্থা থেকেই তখন দাবি ওঠে, “আমরা তাে সামান্য লােক/আমাদের শুকনাে ভাতে লবণের ব্যবস্থা হােক।” সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম দাবির প্রয়ােজনকে জোরালাে সমর্থনের মধ্য দিয়ে কবি জয় গােস্বামীর জীবনবােধ পাঠকের কাছে এই কবিতার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
‘নুন’ কবিতার শিল্পসার্থকতা আলােচনা করাে
জয় গােস্বামী নুন কবিতাটিতে একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াই, বেহিসেবি স্বপ্ন দেখা আর আশা-আকাঙ্ক্ষার আখ্যানকে রূপ দিতে গিয়ে যে শিল্প আঙ্গিকের ব্যবহার করেছেন, তা অনবদ্য।
প্রথমেই লক্ষণীয় কবিতার ভাষা ব্যবহার। নিম্নবিত্ত মানুষদের জীবনে থাকে দুঃখের অগাধ বিস্তার, কিন্তু তারই মধ্যে খুশি খুঁজে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালায় তারা। এই তাৎপর্যকে স্পষ্ট করতেই কবি সম্ভবত ব্যবহার করেছেন অন্ত্যমিলযুক্ত স্পষ্ট অথচ অনুচ্চকণ্ঠ, ছন্দোময় এক ভাষাশৈলী- “আমরা তাে অল্পে খুশি কী হবে দুঃখ করে?/আমাদের দিন চলে যায় সাধারণ ভাতকাপড়ে”।
নিম্নবিত্ত মানুষদের জীবনে দুঃখ, যন্ত্রণা বা অপ্রাপ্তির দীর্ঘ তালিকা বােঝানাের জন্য কবি এই কবিতায় পূর্ণযতির ব্যবহার অনেক কম করেছেন। যােলাে লাইনের এই কবিতাটিতে পূর্ণযতির সংখ্যা মাত্র চার।
প্রায়শই পক্তি শেষের শব্দকে পরের পঙক্তির শুরুতে ব্যবহার করেছেন। আর এ সবই করেছেন কবিতাকে গতিশীল এবং বক্তব্যকে তীক্ষ্ণ করে তােলার প্রয়ােজনে।
কবিতাটির একেবারে শেষ পক্তিতে কবি নুন শব্দের বদলে ব্যবহার করেছেন লবণ শব্দটিকে। নিম্নবিত্ত সমাজ যেহেতু তাদের ন্যূনতম দাবিটুকু ভদ্র, শিক্ষিত ও শাসক শ্রেণির কাছে পৌঁছে দিতে চাইছে, তাই দাবিপত্রের লেখ্য পােশাকি ভাষার প্রয়ােজনেই কবি এখানে ‘নুন শব্দের বদলে ব্যবহার করেছেন লবণ শব্দটি। বিষয়ের সঙ্গে এভাবেই জয় গােস্বামী তাঁর কবিতায় মানানসই করে তােলেন শিল্প-আঙ্গিক।
“নিম্নবিত্তের নােনা চোখের জলের দিনলিপি নয়, জয় গােস্বামীর নুন’ কবিতাটি শেষপর্যন্ত হয়ে উঠেছে লবণাক্ত সমুদ্রের গর্জন।” -ব্যাখ্যা করাে।
নুন কবিতায় কবি জয় গােস্বামী অত্যন্ত বিশ্বাসযােগ্যতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন এক নিম্নবিত্ত পরিবারের রূঢ় বাস্তব দিনলিপি। অভাব আর অসুখে কোনােরকমে দিন কাটিয়ে দেওয়ার মধ্যেই এই নিম্নবিত্ত পরিবারের লােকজন সন্তুষ্টি খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে। যদিও এই কঠোর বাস্তব থেকে মুক্তির জন্য বা দুঃখকে ভুলে থাকার জন্য রাত্তিরে দুই ভাইয়ের মতাে পিতাপুত্রের গাঁজায় টান দেওয়া চলে। নিম্নবিত্তের স্বভাবধর্ম মেনেই কখনাে কখনাে বাড়িতে ফেরার পথে গােলাপচারাও কিনে আনা হয়। কিন্তু কোথায় পোঁতা হবে সেই গােলাপচারা কিংবা কবে ফুটবে তাতে ফুল?এসব প্রশ্নের উত্তর তাদের কাছে নেই। তাদের কাছে সত্য শুধু মুহূর্তের ইচ্ছেপূরণ। মাঝে মাঝে গভীর রাতে বাড়ি ফিরে দেখা যায়, ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ভাতে খাওয়ার মতাে প্রয়ােজনীয় নুনটুকুও পর্যন্ত নেই। রাগ তখন মাথায় চড়ে যায়। বাপব্যাটা দুজন মিলে এরপর সমস্ত পাড়া মাথায় করে। সেই মুহূর্তে তারা ভুলে যায় সামাজিক শিষ্টাচার। এক ধরনের বেপরােয়া মানসিকতায় তারা ঘােষণা করে করি তাে কার তাতে কী?” চোখের জল তখন যেন লবণাক্ত সমুদ্রের অভিধায় বদলে যায়। আর কবিতার একেবারে শেষ পঙ্ক্তিতে এইসব নিম্নবিত্ত মানুষের বেঁচে থাকার আর্তি হিসেবে এই লবণের জন্য জোরালাে দাবি গর্জে উঠতে দেখা যায়।