দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বিভিন্ন দেশের উপনিবেশ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ইউরােপের বিভিন্ন দেশ এশিয়া ও আফ্রিকার যেসব দেশে উপনিবেশ গড়ে তােলে, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নীচে উল্লেখ করা হল一
[1] ব্রিটিশ উপনিবেশ: ইউরােপের দেশগুলির মধ্যে সর্ববৃহৎ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল ব্রিটেন। একদা লােকশ্রুতি তৈরি হয়েছিল যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হয় না। ট্রান্স জর্ডন, ভারত, বার্মা, সিংহল, মালয়, হংকং, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, সাইপ্রাস, ফকল্যান্ডস, জিব্রাল্টার, প্যালেস্টাইন, নাইজিরিয়া, সােমালিল্যান্ড, টাঙ্গানিকা, জাঞ্জিবার, জামাইকা, ট্রিনিদাদ, টোবাগাে, উগান্ডা, উত্তর রােডেশিয়া, বারবাডােস প্রভৃতি দেশে এবং আফ্রিকা মহাদেশের বিস্তীর্ণ অংশে ব্রিটেনের উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল।
[2] ফরাসি উপনিবেশ: বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অধিকারী ছিল ফ্রান্স। সিরিয়া, ইন্দোচিন, টিউনিসিয়া, মরক্কো, গুয়েনা, আইভরি কোস্ট, সেনেগাল, মােরােটানিয়া, নাইজার, মাদাগাস্কার, কঙ্গো, টোগাে, আলজেরিয়া প্রভৃতি দেশে ফ্রান্সের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
[3] অন্যান্য দেশের উপনিবেশ: ব্রিটেন এবং ফ্রান্স ছাড়াও অন্যান্য কয়েকটি শক্তি বিভিন্ন স্থানে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল।
- [i] পাের্তুগাল গুয়েনা, অ্যাঙ্গোলা, মােজাম্বিক ও পূর্ব তিমুরে,
- [ii] ইটালি লিবিয়া, ইথিওপিয়া, ইতালীয় সােমালিল্যান্ড, ইরিট্রিয়া প্রভৃতি স্থানে,
- [iii] হল্যান্ড ইন্দোনেশিয়া ও সুরিনামে,
- [iv] বেলজিয়াম জাইরে, রােয়ান্ডা ও বুরুন্ডিতে,
- [v] স্পেন স্পেনীয় সাহারা, ইফানি, স্পেনীয় মরক্কো, স্পেনীয় গুইনিয়া প্রভৃতি স্থানে উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল।
বিশ্বযুদ্ধের পর অব-উপনিবেশীকরণ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালে এশিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি উপনিবেশে মুক্তিসংগ্রাম তীব্রতর হয়ে ওঠে। এই সময় ভারতীয় উপনিবেশেও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এসব উপনিবেশ তখনই পশ্চিমি শক্তিগুলির অধীনতা মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর উপনিবেশগুলিতে স্বাধীনতা আন্দোলন আরও তীব্রতর হয়ে ওঠে।
[1] অব-উপনিবেশীকরণের সূত্রপাত: ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছুকাল পর থেকে এশিয়া ও আফ্রিকায় দ্রুতগতিতে অব-উপনিবেশীকরণ শুরু হয় এবং বিভিন্ন উপনিবেশ একে একে স্বাধীন হতে থাকে। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিশ্বের অধিকাংশ উপনিবেশ স্বাধীনতা লাভে সক্ষম হয়। কেগলে ও উইটকফ বলেছেন যে, এই সময় ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, স্পেন, পাের্তুগাল প্রভৃতি সামুদ্রিক শক্তিগুলির সাম্রাজ্য ভেঙে গিয়ে অধিকাংশ জাতি ঔপনিবেশিক শাসন মুক্ত হয় এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
[2] অব-উপনিবেশীকরণের অগ্রগতি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় অত্যন্ত দ্রুতগতিতে অব- উপনিবেশীকরণ ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভে (১৯৩৯ খ্রি.) যেখানে আফ্রিকা মহাদেশে একটিমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল, সেখানে যুদ্ধের পরবর্তীকালে স্বাধীন রাষ্ট্রের সংখ্যা বেড়ে হয় পঞ্চাশটি। যুদ্ধের পরবর্তীকালে এশিয়া মহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের সংখ্যা চারগুণ বেড়ে যায়। লাতিন আমেরিকায়ও একইভাবে ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
[3] পরিসংখ্যান: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ৫০ বছরে পৃথিবীর বিপুল পরিমাণ ভূখণ্ড ও বিপুল সংখ্যক মানুষ ঔপনিবেশিক শাসন মুক্ত হয়। সামগ্রিকভাবে দেখা যায় যে, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বের অন্তত ৭৭.২ শতাংশ ভূখণ্ড এবং ৬৯.২ শতাংশ জনগণ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে বিশ্বের অধিকাংশ উপনিবেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৪ শতাংশ ভূখণ্ড এবং ১ থেকে ২ শতাংশ জনগণ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল।