সূচনা
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে যে সামাজিক বিভেদ বিদ্যমান ছিল তা সবচেয়ে তীব্র আকার ধারণ করেছিল দক্ষিণ ভারতে। দক্ষিণ ভারতের কেরালায় নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা হিন্দু মন্দিরের প্রবেশ ও মন্দির সংলগ্ন পথ সহ অন্যান্য কিছু পথে যাতায়াত করার অধিকার পেতো না। সেখানে ইঝাবা ও পুলায়া উচ্চ বরণের মানুষের যথাক্রমে ১৬ ফুট ও ৭২ ফুটের চেয়ে কাছে আসতে পারতো না। এভাবে তারা তিন দল বা দূরবর্তী দূষণের শিকার হয়েছিল। তাই দলিত শ্রেণীর প্রতি বিভিন্ন ধরনের বঞ্চনার প্রতিবাদে বিভিন্ন স্তরে যেসব সংস্কার সংগ্রাম শুরু করেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন শ্রী নারায়ন গুরু, এন. কুমারন আসন এবং টি. কে. মাধবন। তাদের উদ্যোগ অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে সচেতন হতে সাহায্য করে।
দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের প্রবেশ সংক্রান্ত ঘটনার গড়ে ওঠা আন্দোলন
ভাইকম সত্যাগ্রহ
কেরালা তত দক্ষিণ ভারতের দলিত ও অস্পৃশ্য হিন্দুদের প্রতি বিভিন্ন সামাজিক বৈষ্ণবের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ভাইকম সত্যাগ্রহ আন্দোলন।
১. কংগ্রেসের ভূমিকা
কংগ্রেসের কাকিনাড়া অধিবেশনে রাজপৃষ্ঠতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর কেরালা প্রদেশে কংগ্রেস কমিটি কে.পি.সি.সি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রচার এবং হিন্দুদের মন্দিরে ও জনপদগুলির অবর্ণ ও হরিজনদের জন্য খুলে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করার উদ্যোগ নেয়।
২. ভাইকম গ্রামে প্রতিবাদ
ত্রিবাঙ্কুর ভাইকম গ্রামে একটি বড় মন্দিরে চারিদিকে ছিল রাস্তা। ইঝাবা, পুলায়া রবিতে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের এই মন্দিরে প্রবেশ ও মন্দির সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে হাঁটার অধিকার পেতো না। এই গ্রাম থেকে কংগ্রেস অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করে।
৩. সত্যাগ্রহ সূচনা
কেরালা প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ ভাইকমের মন্দির সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে উৎস ও নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের একটি মিছিল বের করার উদ্যোগ নেন। এ বিষয়ে সবর্ণদের নৈতিক চেতনা জাগিয়ে তুলতে জোর কদমে প্রচার অভিযান চালানো হয়। নায়ার সার্ভিসে সোসাইটি, নায়ার সমাজম, কেরালা হিন্দুসভা প্রভৃতির স্ববর্ণ হিন্দু সংগঠনগুলি এই আন্দোলনকে সমর্থন করে। নাম্বুদিরি নামে বর্ণের শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের প্রধান সংগঠন যোগ ক্ষমতা সভা মন্দিরের দরজা আবার নদীর জন্য খুলে দেওয়ার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে।
৪. আন্দোলনে বাধা
অভয়ারণ্য হিন্দুদের জন্য ভাই কম মন্দিরে দরজা খুলে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হলে বিভিন্ন দিক থেকে তা প্রতিরোধেরও চেষ্টা শুরু হয়। সেখানকার জেলা শাসক আন্দোলনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। মন্দিরের দিকে আন্দোলনকারীদের অগ্রগতি আটকাতে মন্দির কর্তৃপক্ষ ও তিবাঙ্কুর সরকার মন্দির মুখী সব রাস্তায় ব্যারিকেট তৈরি করে।
৫. আন্দোলনকারীদের মিছিল
সত্যাগ্রহীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠার পরিস্থিতিতে ভাইকম সত্যাগ্রহ সারাদেশে প্রবল উদন্মাদনা সৃষ্টি করে। আন্দোলন যোগ দিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিপুল সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবকরা আসতে থাকে। ৩০ মার্চ সত্যাগ্রহ শিবির থেকে কেশব কেন্দ্রের মেননের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের হয়। ক্রমে ভাইকমের মন্দিরের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ মিছিল আটকাতে দেয় এবং বহু আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করা হয়।
৬. আন্দোলনের ব্যর্থতা
তীব্র আন্দোলনের সাথে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ৩০ মার্চ ভাইকম মন্দিরে দরজা হিন্দুদের জন্য খুলে দেওয়া সম্ভব হয়নি। বরং কিছু গোড়া ও প্রতিক্রিয়া শালী বর্ণ হিন্দু মন্দিরের দরজা নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের জন্য খুলে দেওয়ার ঘটনা কে মানতে পারেনি। তারা সত্যাগ্রহের সমর্থন কংগ্রেসদের বয়কট করা, সত্যাগ্রহের যোগদানকারীদের শিক্ষক বা আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ না করে তাদের ভোট না দেওয়ার প্রকৃতি সিদ্ধান্ত নেয়।
পরবর্তী আন্দোলন
সত্যাগ্রহ আন্দোলনের দ্বারা ভাইকম মন্দিরে দরজা অবর্ণনা হিন্দুদের জন্য খুলে দেওয়া সম্ভব না হলেও দলীয় মানুষের সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেমে থাকে নি। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত আন্দোলন আবাহন হতে থাকে।
১. মহারানীর কাছে আবেদন
ত্রিবাঙ্কুর মহারাজা মৃত্যুর পর সেখানকার মহারানী জেল থেকে সকল সত্যাগ্রহীদের মুক্তি দেন। এরপর উদারপন্থী কিছু বর্ণহিন্দু মন্দিরের দরজা ও সংলগ্ন রাস্তা সকলের জন্য খুলে দিতে মহারানীর কাছে আবেদন করে। কিন্তু মহারানী আবেদনের সাড়া দেননি। কংগ্রেস নেতা গান্ধীজি ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের মারছে মহারানীর রাজ কর্মচারীদের সঙ্গে দেখা করে একটি আপসরফা করেন। ফলে মন্দিরের অভ্যন্তরী রাস্তাগুলি ছাড়া চারপাশে রাস্তাগুলির অভন্য হিন্দুদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
২. গুরুবায়ুর মন্দিরে সত্যাগ্রহ
কেরালার গুরু বায়ুর মন্দিরে অবরোধের প্রবেশের দাবিতে কবি শুব্রমুনিয়ার তিরুমান্বুর এ নীতিতে ১৬ জনের একটি সত্যাগ্রহী দল ১৯ খ্রিস্টাব্দে ২১ অক্টোবর গুরু বায়ু দের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। প্রচুর যুবক আন্দোলনে যোগ দেয়। সমগ্র কেরালা মন্দির প্রবেশ দিবস এক নভেম্বর পালিত হয়। পার্থনা ও মিছিল অর্থ সংগ্রহ ইত্যাদি চলতে থাকে।
৩. গোঁড়াপন্থীদের আক্রমণ
গুরুবায়ুর মন্দিরে প্রবেশ প্রতিরোধ করতে মন্দিরের চতুর্দিক কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা হয়। প্রতিরোধ বাহিনী মোতায়েন করে আন্দোলনকারীদের মারধরের ভয় দেখানো হয়। তা সত্ত্বেও সত্যি সত্যি আমি নিজের মিছিল অগ্রসর হলে বিশাল পুলিশ বাহিনীর মিছিল আটকে দেয়। মন্দির কর্তৃপক্ষ ও গোঁড়া বর্ণহীনদের সত্যাগ্রহীদের ওপর শারীরিক আক্রমণ চালায়। পুলিশের সামনে সত্যাগ্রহী নেতা পি. কৃষ্ণ পিল্লাই ও এ. কে. গোপালকে প্রচন্ড মারধর করা হয়।
৪. কেলাপ্পান ও গোপালনের আন্দোলন
পবনে হিন্দুদের জন্য মন্দিরে দরজা খুলে দেওয়ার দাবিতে কে কেলাপ্পান ও এ. কে. গোপালের নেতৃত্বে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বরের আন্দোলন আবার জোরদার হয়ে ওঠে। সকল হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য মন্দিরের দরজা না খোলা পর্যন্ত তিনি ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ২১ সেপ্টেম্বর থেকে অনশন শুরু করেন। কেলাপ্পান শেষ পর্যন্ত গান্ধীজীর অনুরোধ অনশন ভাঙলে এই আন্দোলন সারাদেশে আবার আলোড়ন সৃষ্টি করে। গোপাল ছাড়া কেরালায় প্রচার করে আন্দোলন সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করেন।
৫. আন্দোলনের জয়
আন্দোলনের জন্য মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া সম্ভব হয়। ত্রিবাঙ্কুর মহারাজা ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জাতপাত নির্বিশেষে সমস্ত হিন্দুদের জন্য সরকার নিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে খুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। চক্রবর্তী রাজগোপালচারির নেতৃত্বে মাদ্রাজ মন্ত্রিসভা ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের সকলের জন্য মন্দিরে দরজা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কংগ্রেসের শাসিত অন্যান্য দেশগুলিতে অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া
উপসংহার
ব্রিটিশ সরকার প্রথম দিকে ভারতীয় সমাজের অগ্রগতির জন্য বেশ কিছু শুভ উদ্যোগ নিয়েছিল। দাঁড়া এদেশে প্রাসাদের আধুনিক শিক্ষা চালু করেছিল, সীতা দাহের মতো কু প্রথা আইন করে বন্ধ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে ভারতীয় সমাজের সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করার প্রয়োজন হলে সরকার সর্বোচ্চ বিভাজন ও শাসন নীতি প্রয়োগ করার চেষ্টা করে। ভারতীয় সমাজে সাম্প্রদায়িক বিভেদ জিইয়ে রাখার উদ্দেশ্যে সরকার নিম্ন বর্ণের মানুষদের মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে আন্তরিক উদ্যোগ নেননি। বরং সরকারের পুলিশ অনেক সময় মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত আন্দোলন দমন করে ও সুবর্ণ হিন্দুদের মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল।