বৈষ্ণব পদের মৌল বিষয় হল-রাধা কৃষ্ণ লীলারহস্য ও লীলা মহাত্ম্য। এই লীলা রহস্য ও লীলা মাহাত্ম্য বৈষ্ণুবীয় তত্ত্বরূপের অন্বয়ে একপ্রকার আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের ধারক ও বাহক হয়ে বৈব-ধর্মাবলম্বীদের কাছে এবং আমাদের মতো ধর্মতত্ত্ব—বর্জিত পাঠকদের কাছে আস্বাদিত হয়ে আসছে। কৃষ্ণকে পরমাত্মা জ্ঞান করে ভগবান ভেবে এবং হ্লাদিনী শক্তিকে ভক্তজনের প্রতীক ভেবে তাঁদের মধ্যেকার রাগ অনুরাগ-প্রেম বিহরকে এক ধরে অপার্থিব লোকের মহিমা দান করে আসা হচ্ছে। বৈষ্ণব পদ পাঠে হয়তো এমন বিশেষ তত্ত্ব সমন্বিত মানসিক প্রস্ততি সবিশেষ জরুরি, তবে তত্ত্ববর্জিত সাধারণ রসিক— পাঠকের মন নিয়েও তো বৈবপদের আস্বাদন চলে।
বৈষ্ণব কবিতায় কবিরা খুব যুক্তিসংগতভাবে রাধা-কৃষ্ণপ্রেমের ক্রমিক বিবর্তনকে দেখিয়েছেন। প্রেমের একেবারে প্রথমস্তরে থাকে পূর্বরাগ-অনুরাগের স্তর। এই স্তরে মানব মানবীর মনে বিচিত্র ভাবরাশি ভয়-শঙ্কা-উদ্বেগ-বিহ্বলতা কিংবা মোহাবেশ উপস্থিত থাকে। রাধা কখনও কৃষ্ণ রূপের অনুরাগে বিহ্বল—
রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে রহিল।
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।।
ঘরে যাইতে পথে মোর হৈল অফুরান
অন্তরে বিদরে হিয়া কি জানি কি করে প্রাণ।।
আবার কখনো রাধাকে দেখে প্রেমের ঐশ্বর্যে চতুর কলাময়ী নবীনা নারীর বৈশিষ্ট্য জীবন্ত—
“সখি হে অপরূপ চাতুরী গৌরী।
সব জন তেজি আগা সবী সঞ্জুরী।
আর বদন তঁহি থোরি।।
রাধা-কৃষ্ণ-প্রেম চিত্রাঙ্কনে বৈশ্বব কবিরা স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। বিদ্যাপতির রাধা নবীনা-ঐশ্বর্যময়ী। তবে এই ঐশ্বর্যই প্রেমের গভীরতাকে মূর্ত করে—
“হাথক দরপণ মাথক ফুল।
নয়নক অঞ্জন মুখক তাম্বুল।
বিদ্যাপতি রাধার যে আকুলিত হৃদয়ের চিত্রটি আমাদের সামনে ফুটিয়েছেন তা ঐশ্বর্যভাবের—
“এ সখি হামারি দুঃখের নাহি ওর
এভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।”
কুলিশ শতশত পাতমোদিত।
ময়ূর নাচত মাতিয়া।
মত্তদাদুরী ডাকে ডাহুকী
ফাটিযাওত ছাতিয়া।
ঐশ্বর্য ভাবের পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ চণ্ডীদাসের এই পদটিতেও ঘটেছে—
“সই কেবা শুনাইলো শ্যাম নাম
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ।”
শুধু ঐশ্বর্য ভাবই বৈক্ষ্ণব কবিতায় লক্ষণীয় নয়, মাধুর্যভাবও পরিলক্ষিত হয়। জ্ঞানদাসের—
‘রঙিন শাঙন ঘন ঘন দেয়া গরজন
রিমিঝিমি শবদে বরিষে।
এছাড়া রসোগারের পদে আদিরসের বাহুল্য থাকলেও জ্ঞানদাসের পদে সম্ভোগের উত্তাপের চেয়েও স্নিগ্ধ সজল মমতার কোমলতা স্পষ্টই লক্ষণীয়। এই রসোগার পর্যায়ের পদ হল : ‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর। রাধার বেদনায় হৃদয়ের যে অপূর্ব প্রকাশ ঘটেছে তা চণ্ডীদাসের কৃতিত্বকে ছাড়িয়ে গেছে—
“বঁধু, তোমার গরবে গরবিনী আমি
রূপসী তোমার রূপে।
অভিসার পর্যায়ের পদ রচনা করে গোবিন্দদাস শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন—
‘কন্টক গাড়ি কমলসম পদতল
মঞ্জীর চীরহি ঝাঁপি।
গাগরি বারি ঢারি করি পিছল
চলতহি অঙ্গুলি চাপি।”
সত্যি মাধুর্যভাবের এত সুন্দর চিত্র আর কোথাও নেই। এরপর রাধিকার অভিসারযাত্রা করার সম্মুখে যে কতবাধা, তা—
“মন্দির বাহির কঠিন কপাট।
চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।”
-পক্তিগুলিতে পরিস্ফুট।
পরিশেষে বলতে হয় বৈষ্ণব পদাবলীতে ঐশ্বর্য ও মাধুর্য ভাবের মেলবন্ধ ঘটায় পদকর্তাগণের শ্রেষ্ঠত্ব ও পদগুলির কাব্যবহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।