“খানিক আগের ঘটনাটা আপনার কাছে অবাস্তব বলে মনে হবে।” -কোন ঘটনার কথা এখানে বলা হয়েছে?
প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপােতা আবিষ্কার গল্পে দেখা যায়, মাছ ধরার উদ্দেশ্যে তেলেনাপােতায় পৌঁছে একটি পানাপুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরার অপেক্ষায় বসে থাকেন গল্পের কথক।
সেই সময় ঘুঘু পাখির ডাকে উদাস হয়ে যাওয়া গল্পকথক হঠাৎই জলের শব্দে চমকে গিয়ে দেখেন যে, পুকুরের স্থির, সবুজ জলে ঢেউ উঠেছে এবং তার বড়শির ফাতনা ধীরে ধীরে দুলছে। ঘাড় ঘুরিয়ে অতঃপর তিনি লক্ষ করেন যে, ঘাটে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে পুকুরের পানা সরিয়ে পিতলের একটি চকচকে কলশিতে জল ভরছে।
মেয়েটির দুটি চোখ কৌতূহলী হলেও, তার চালচলনে লজ্জা বা আড়ষ্টতার লেশমাত্র ছিল না। এরপর জল ভরে নিয়ে মেয়েটি সরাসরি গল্পকথকের দিকে তাকিয়ে তার ফাতনার দিকে দৃষ্টি দেয় এবং মুখ ফিরিয়ে কলশিটা কাখে তুলে নেয়।
মেয়েটির মুখশ্রীর শান্ত, করুণ ও গম্ভীর ভাব দেখে কথকের মনে হয় যে, মেয়েটি দীর্ঘকাল ধরে নিষ্ঠুর জীবনপথ পার হয়ে এসেছে। ফিরে যাওয়ার সময় হঠাৎই পেছন ফিরে তাকিয়ে মেয়েটি গল্পকথককে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করে এবং তাঁকে বড়শিতে টান দিতে বলে।
অভিভূত গল্পকথক এরপর ফাতনাটি ভেসে ওঠার পরপরই বড়শিতে টান দিয়ে দেখেন যে, তাতে মাছ তাে নেই-ই, এমনকি টোপও নেই। বিব্রত হয়ে মেয়েটির দিকে চেয়ে দেখেন যে, সে দীপ্ত হাসি-মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ধীর পদে ফিরে চলেছে। এর বেশ কিছুক্ষণ পরে সেই ঘটনাই কথকের কাছে অবাস্তব মনে হয়েছিল।
“খাওয়া শেষ করে আপনারা তখন একটু বিশ্রাম করতে পারেন”—কোথায়, কীভাবে তারা খাওয়া শেষ করেছিলেন?
প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপােতা আবিষ্কার গল্পে আমরা দেখি যে, কলকাতাবাসী গল্পকথক তাঁর বন্ধু মণির অনুরােধে অন্য আর-এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হন মণিরই পিতৃপুরুষের বাসভূমি তেলেনাপােতার উদ্দেশে।
পরদিন দুপুরে মৎস্য-শিকারে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা গল্পকথককে মণি জানান যে, তাঁদের বাড়ির অদূরে অবস্থিত আর একটি ভাঙা বাড়িতে তাদের তিনজনের দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে এবং সে ব্যবস্থা করেছে তারই সম্পর্কে জ্ঞাতি বোন যামিনী।
যামিনী তাদের বাড়িতে জ্ঞাতিদাদা মণি এবং তার দুই বন্ধুর যে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন, তা ছিল অত্যন্ত সাধারণ। যামিনীর ব্যবহারে কোনাে অনাবশ্যক লজ্জা বা আড়ষ্টতা না থাকায় সে নিজেই খাবার পরিবেশন করছিল।
কিন্তু পরিবেশনের সময় দু-চারবারের জন্য যামিনী চঞ্চল ও উদবিগ্ন হয়ে পড়ছিল। কারণ ওপর তলার কোনাে একটি ঘর থেকে মাঝেমধ্যেই ক্ষীণকণ্ঠে কাউকে ডাকতে শােনা যাচ্ছিল। সেই ডাক শুনে যামিনীকে ব্যস্ত হয়ে ঘরের বাইরে চলে যেতে হচ্ছিল বারবার।
ফিরে আসার পর প্রতিবার তার মুখশ্রী আরও বেদনাময় হয়ে উঠছিল, চোখদুটি হয়ে পড়েছিল অধিকতর অসহায় এবং অস্থির। এভাবেই গল্পকথক ও তার দুই বন্ধু যামিনীদের বাড়িতে সেদিন দুপুরে খাওয়া শেষ করেছিলেন।
ব্যাপারটা কী এবার আপনারা হয়তাে জানতে চাইবেন- কোন্ ব্যাপার অতঃপর গল্পকথক জানতে পেরেছিলেন?
প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপােতা আবিষ্কার গল্পে দেখা যায়, গল্পকথকের বন্ধু মণির পিতৃপুরুষের বাসভূমি তেলেনাপােতায় গল্পকথক ও তার দুই বন্ধুর দুপুরে খাওয়ার আমন্ত্রণ ছিল মণিরই জ্ঞাতিবােন যামিনীদের ঘরে। খাওয়ার পর বন্ধু মণির কাছ থেকে গল্পকথক জানতে পারেন যে, ওপরের ঘরে থাকা যামিনীর বৃদ্ধা, অন্ধ বিধবা মা তাঁর এক দূর সম্পর্কিত বােনপাে নিরঞ্জনের সঙ্গে যামিনীর বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করে রেখেছিলেন।
চার বছর আগে নিরঞ্জন এসে যামিনীর মাকে জানিয়ে গিয়েছিল যে, বিদেশের চাকরি থেকে ফিরে এসেই সে যামিনীকে বিয়ে করবে। সেইসময় থেকেই অন্ধ বৃদ্ধা সেই ঘুমন্তপুরীতে নিরঞ্জনের ফিরে আসার আশায় বসে দিন গুনছেন। প্রকৃতপক্ষে, নিরঞ্জন বিদেশে যায়ইনি।
দরিদ্র বৃদ্ধ যামিনীর সঙ্গে নিরঞ্জনের বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত নাছােড়বান্দা ছিলেন বলেই সে যামিনীর মাকে ফিরে আসার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইতিমধ্যেই অন্যত্র বিয়ে করে দিব্যি ঘর-সংসার করছে।
নিরঞ্জনের এই দাম্পত্য-সংবাদ যামিনী জানলেও সে তার মাকে জানায়নি, কারণ বৃদ্ধা হয়তাে এই সত্য বিশ্বাস করবেন না, আর যদি সত্য সত্যই বিশ্বাস করেন, তবে শ্বাস বন্ধ হয়ে তক্ষুনিই তার মৃত্যু হবে। সবদিক বিবেচনা করে যামিনী বা অন্য কেউ সেই সত্য কথাটা বৃদ্ধাকে জানায়নি। বন্ধু মণির মুখে এই ব্যাপারটিই জানতে পেরেছিলেন গল্পকথক।
“হূ, এতাে বড়াে মুস্কিল দেখছি”—প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বক্তা কাকে মুস্কিল’ বলে অভিহিত করেছেন লেখাে
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপােতা আবিষ্কার ছােটোগল্পে আমরা দেখি যে, তেলেনাপােতায় আসার পরের দিন গল্পকথকের পানরসিক বন্ধু মণির জ্ঞাতিবােন যামিনীদের বাড়িতে কথকরা নিমন্ত্রিত হয়ে দুপুরের খাবার খেতে যান।
খাওয়া-দাওয়ার পর তিনবন্ধু সে ঘরেই যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, তখন দরজার বাইরে থেকে যামিনী কিছুটা ইতস্তত করে মণিকে ডেকে বলে যে, মণিবাবুদের তেলেনাপােতায় আসার খবর পাওয়ার পর থেকেই তার অন্ধ, বৃদ্ধা মা খুব অস্থির হয়ে পড়েছেন।
যামিনীর সঙ্গে কথা বলে এরপর মণি বুঝতে পারেন যে, যামিনীর মা মনে করেছেন যে নিরঞ্জন এসেছে। তার মায়ের মতে, যামিনীকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার দীর্ঘ চার বছরের মধ্যে নিরঞ্জন যেহেতু একবারও আসেনি, তাই লজ্জিত হয়ে নিরঞ্জন আর বৃদ্ধার সামনে যেতে পারছে না।
যামিনী যতই সব কথা গােপন করার চেষ্টা করুক না কেন, নিরঞ্জনের আসা সম্বন্ধে তিনি একেবারে নিশ্চিত। এ কথাগুলাে বলে যামিনী তার অসহায়তা প্রকাশ করে জানায় যে, অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে তার মায়ের ধৈর্যহীনতা এতটাই বেড়ে গেছে যে, কোনাে কথা বােঝালেও তিনি বুঝতে চান না।
প্রায়শই রেগে গিয়ে মাথা ঠুকে এমন সব কাণ্ড ঘটান যে, তখন তাঁর প্রাণ বাঁচানােই সংকটজনক হয়ে পড়ে। এরপর যামিনী মণিকে ওপরে যেতে অনুরােধ করলে মণিবাবু যামিনীর অসুস্থ, বিধবা, অসহায়, বৃদ্ধা মায়ের অবুঝপনাকেই ‘মুস্কিল’ বলে অভিহিত করেছেন।